05/07/2025
"শেষ চাকা"
রফিক প্রায় বিশ বছর ধরে রিকশা চালায় ঢাকায়। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, কিন্তু চেহারায় ক্লান্তি যেন আশি বছরের এক বৃদ্ধের মতো। চোখের নিচে কালি, পা দুটো কাঁপে একটু দূর গেলেই।
শুরুতে একটানা কাজ করত। সকালে বেরিয়ে রাত দশটা পর্যন্ত রিকশা চালাত, যাত্রী তুলত সদরঘাট, গুলিস্তান, কখনো ধানমণ্ডি। ঘামে ভিজে যেত গায়ের জামা, তবু রফিক হাসত। কারণ তখন তার একটা লক্ষ্য ছিল—নিজের একটা রিকশা কেনা।
বছর দুয়েকের মধ্যেই কিনে ফেলেছিল সে রিকশাটা, পুরনো হলেও নিজের ছিল। কিস্তি করে টাকা শোধ করেছিল অনেক কষ্টে। সেই রিকশাই তার গর্ব, তার রুটি-রুজি, তার আত্মসম্মান।
কিন্তু সময় সব সময় এক থাকে না।
সন্তান বড় হচ্ছে, স্কুলের খরচ, বাজারের দাম, বউয়ের ওষুধ—সব মিলিয়ে চালাতে হিমশিম। তার ওপর কয়েক মাস ধরে রিকশা নিয়ে বের হলেও ভাড়া নাই, রাস্তায় যাত্রী কম।
শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ে আগের মতো জোর থাকল না। হাত কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে। তবুও চালায়। পকেটে টাকা না থাকলে চুলায় আগুন জ্বলে না।
একদিন সকালবেলা ছেলে বলে উঠল—"বাবা, ভাত নাই, স্কুলে না গেলে চলবে?"
বউ চুপ করে বসে ছিল, কিছু বলে না। তার মুখেও ক্ষুধার ছাপ স্পষ্ট।
সেইদিন রফিক রিকশা নিয়ে বের হলো না। অনেকক্ষণ বসে রইল রিকশাটার দিকে চেয়ে। রোদ উঠেছে, চাকা দুটো আলোয় চকচক করছে। তার মনে হচ্ছে, যেন ওগুলো চিৎকার করছে—"আমাকে বিক্রি কোরো না!"
কিন্তু কী করবে?
ঘরে চাল নেই, ছেলের মুখ শুকনো, বউয়ের মুখে ক্ষত।
তার মাথায় একটা চিন্তা আসে।
সে ধীরে ধীরে রিকশা নিয়ে যায় পুরান ঢাকার একটি গ্যারেজে। গ্যারেজ মালিক চেনে রফিককে, বছর দশেকের সম্পর্ক।
“বিক্রি করবি?”
রফিক মাথা নিচু করে বলে, “হ্যাঁ ভাই। আর পারছি না।”
গ্যারেজ মালিক দেখে রিকশাটা, একটু পুরনো, তবু চলনসই। দাম দেয় কম।
“আট হাজার দিব। চলবে?”
রফিক কিছু বলে না। শুধু হাত বাড়িয়ে টাকাটা নেয়। গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে আসার সময় চোখের কোণ গরম হয়ে ওঠে। মনে হচ্ছে বুকের একটা অংশ রেখে যাচ্ছে সে চাকার নিচে।
সেই রাতে ছেলে পেটভরে খায়। বউ রান্না করে হাসিমুখে, অনেকদিন পর।
কিন্তু রফিকের ঘুম আসে না। ঘরের কোণে পড়ে থাকা হ্যান্ডেল ধরা হাত দুটো কাঁপে।
ভেবেছিল একদিন নিজের রিকশা থাকবে, ছেলে বড় হবে, পড়াশোনা করে অফিসার হবে। এখন শুধু ভাবছে—আগামীকাল কীভাবে বের হবে রাস্তায়?????