09/06/2025
চীন নজরদারি প্রযুক্তিতে এক যুগান্তকারী অগ্রগতি অর্জন করেছে। চীনের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (USTC)-এর গবেষকেরা সম্প্রতি এমন একটি লেজার-ভিত্তিক দূরদর্শী যন্ত্র তৈরি করেছেন যা প্রায় এক মাইল দূরত্ব (১.৩৬ কিলোমিটার) থেকে একটি খোলা বইয়ের পৃষ্ঠায় লেখা ৩ মিলিমিটার আকারের অক্ষর পাঠ করতে সক্ষম।
এই প্রযুক্তি, যা “Active Intensity Interferometry” নামে পরিচিত একটি জটিল পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তৈরি, মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানে দূরবর্তী নক্ষত্র বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। এবার প্রথমবারের মতো এ পদ্ধতি স্থলভিত্তিক পর্যবেক্ষণে প্রয়োগ করে অভাবনীয় সফলতা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। লেজার ব্যবহার করে এত দীর্ঘ দূরত্ব থেকে এত স্পষ্টতা সহকারে কোনো পৃষ্ঠার লেখা শনাক্ত করার ঘটনা নজরদারি প্রযুক্তিতে এক বিশাল মাইলফলক।
কীভাবে কাজ করে প্রযুক্তিটি?:
গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক চেন জিয়াওজু, যিনি জানিয়েছেন, যন্ত্রটি আটটি ইনফ্রারেড (অদৃশ্য) লেজার বিম নির্গত করে লক্ষবস্তুতে প্রক্ষেপণ করে। এই বিমগুলো বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসার সময় দুইটি ভিন্ন টেলিস্কোপ দিয়ে তা সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই ডেটা একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার সিস্টেম দ্বারা বিশ্লেষণ করে মূল চিত্র পুনর্গঠন করা হয়।
তারা বলছেন, সাধারণ টেলিস্কোপ ব্যবহারে যে ছবির গুণগত মান পাওয়া যায়, এই প্রযুক্তি তা থেকে ১৪ গুণ বেশি স্পষ্ট চিত্র দিতে সক্ষম। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রযুক্তিটি ৩ মিলিমিটার আকারের একটি ছাপা অক্ষর এমনকি ঘোলাটে পরিবেশেও পড়তে পারছে।
বাস্তব পরীক্ষায় সাফল্য:
পরীক্ষামূলকভাবে গবেষকেরা একটি চিত্র লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করেন, যা ছিল ১.৩৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সেখানে স্থাপন করা হয়েছিল একটি খোলা বইয়ের পৃষ্ঠা, যাতে ইংরেজি ও চীনা অক্ষরে লেখা ছিল। পরীক্ষায় দেখা যায়, লেজার পদ্ধতিটি এমনকি কাচের আবরণের মধ্য দিয়েও সেই অক্ষর স্পষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারে।
এই উদ্ভাবনের ফলে অদূর ভবিষ্যতে এমন সময় আসতে পারে যখন কেউ জানালার পাশে বসে একটি বই পড়ছে, আর দূর থেকে কেউ সেই লেখাটি নির্ভুলভাবে পর্যবেক্ষণ করছে—এমনকি জানালার কাচ ভেদ করেও।
সম্ভাব্য ব্যবহার:
গবেষকেরা বলছেন, এই প্রযুক্তির নানা ধরণের ব্যবহার হতে পারে। যেমন:
• অন্তরীক্ষ গবেষণা: মহাকাশে ভাসমান ক্ষুদ্র বস্তুর চিহ্নিতকরণ এবং পর্যবেক্ষণ।
• আর্কিওলজি: প্রাচীন পাথর বা স্তম্ভে খোদাই করা লেখা দূর থেকে নাড়াচাড়া ছাড়াই বিশ্লেষণ করা।
• বন্যপ্রাণী গবেষণা: দূরবর্তী প্রাণীর গায়ে বসানো ট্যাগ বা লেবেল পড়া, যেখানে কাছে যাওয়া সম্ভব নয়।
• শহুরে নিরাপত্তা: গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বা সামরিক স্থাপনার নিরব পর্যবেক্ষণ।
নজরদারির নয়া দিগন্ত?:
যদিও প্রযুক্তিটির উন্নয়ন একবিংশ শতাব্দীর নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে, তবে এতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগও দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এই প্রযুক্তি যদি বাণিজ্যিক বা সামরিক প্রয়োজনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। জানালার কাচ দিয়ে কেউ যদি বই পড়েন, সেখান থেকেও লেখা পড়ে ফেলা গেলে সেটা একপ্রকার ‘অদৃশ্য নজরদারি’র সামিল।”
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশের আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত জায়গায় চুপি চুপি তথ্য সংগ্রহ বা চিত্রগ্রহণ আইনবিরুদ্ধ। ফলে প্রযুক্তিটির ব্যবহার নীতিগতভাবে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেটি এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরাপত্তা বনাম গোপনীয়তা:
বেইজিং ইউনিভার্সিটির প্রযুক্তি ও সমাজবিষয়ক অধ্যাপক ইউ মিং বলেন, “প্রযুক্তি হিসেবে এটি সত্যিই বিস্ময়কর। কিন্তু এটি হাতে থাকা এক ধরনের ‘দূরদর্শী চোখ’, যা ভালো বা মন্দ—দুই কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারি পর্যায়ে যদি এই প্রযুক্তি ব্যবহারে নীতিমালা ও সীমারেখা না নির্ধারণ করা হয়, তাহলে এটি গণতান্ত্রিক সমাজে এক ধরণের ‘অদৃশ্য নজরদারির সংস্কৃতি’ সৃষ্টি করতে পারে।”
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সংযোজন:
গবেষকেরা আরও জানান, এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করার জন্য তারা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-কে সংযুক্ত করার কাজ করছেন। AI-এর মাধ্যমে ছবি পুনর্গঠন আরও দ্রুত, নিখুঁত এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো টেক্সট ঝাপসা হলে AI সেটি পুনরুদ্ধার করতে পারবে, অথবা মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে ভাষা ও ফন্ট অনুযায়ী পাঠযোগ্যতা বাড়ানো যাবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
এই উদ্ভাবনের খবরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কিছু গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেছেন, “চীনের এই প্রযুক্তি সামরিক নজরদারির একটি বিপজ্জনক নতুন দিক খুলে দিয়েছে।” অন্যদিকে, প্রযুক্তিবিদেরা একে বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের একটি বড় সাফল্য হিসেবেও বিবেচনা করছেন।
বিশ্বব্যাপী এখনো এ ধরণের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, দূরপাল্লার রিমোট রিডিং প্রযুক্তি এত স্পষ্টতা সহকারে কাজ করতে পারে এমন নজির বিরল। এই প্রযুক্তি যদি সামরিক রপ্তানিতে বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে আসে, তাহলে তা বৈশ্বিক নজরদারির ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে।