26/08/2024
*বন্যার ছোবলে নিস্তব্ধ জীবন*
রাতের অন্ধকার তখনও গাঢ় হয়নি, হঠাৎ করেই গ্রামের মানুষদের কানে এলো অদ্ভুত এক গর্জন। নদীর বুক চিরে উঠে আসা সেই শব্দ আর বাতাসের গর্জন যেন একসঙ্গে মিশে মুষলধারায় বৃষ্টি নিয়ে এলো। রেহানা তখন ঘুমিয়ে ছিলো, হঠাৎ পানি ধাক্কা মারতেই সে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। চোখের পলকেই তার ঘরের মেঝেতে পানি ঢুকতে শুরু করে।
রেহানার স্বামী সুমন দরজার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেখানে ইতোমধ্যেই কোমর পানি জমে গেছে। সে হতবিহ্বল হয়ে গেলো, কী করবে, কোথায় যাবে— কিছুই বুঝতে পারছিল না। রেহানা তখন ছোট ছেলে রিজভীকে কোলে তুলে নিলো, মেয়ে তানিয়াকে হাত ধরে বললো, "চল, বাইরে যেতে হবে।"
তারা যখন ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো, তখন চারপাশে কেবল পানি আর পানি। গ্রামের রাস্তা, বাড়িঘর—সব কিছু পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সুমনের মাথা কাজ করতে চাইছিল না, কোথায় যাবে তারা? রেহানা অসহায়ের মতো সুমনের দিকে তাকিয়ে ছিলো, আর সুমন বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।
তাদের এই অসহায়তার মধ্যেই চারপাশের মানুষের হাহাকার শোনা যাচ্ছিল। কেউ তাদের গরু-বাছুরের জন্য বিলাপ করছে, কেউ বা নিজের সন্তানের জন্য। গ্রামের মোড়ল আজিজ মিয়া তখন গ্রামের সব মানুষকে একত্রিত করতে লাগলেন। "কেউ একা একা কোথাও যাবি না, একসঙ্গে থাকলে হয়তো বাঁচতে পারবো," মোড়ল সাহেব চিৎকার করে বললেন।
গ্রামের মানুষ একসঙ্গে একটি উঁচু স্থানে জড়ো হলো। কিন্তু সেখানে থাকার মতো যথেষ্ট জায়গা ছিল না। রেহানা তার সন্তানদের নিয়ে একটি কোণায় দাঁড়ালো। সন্তানদের ক্ষুধায় কাঁদতে দেখে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। আশপাশে যতদূর চোখ যায়, কেবল পানির বিশাল ঢেউ। সুমন একবার চেষ্টা করলো খাবারের সন্ধানে যেতে, কিন্তু পানির স্রোত এতটাই প্রবল ছিল যে সে টিকে থাকতে পারলো না। সে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিল, তার পরিবারকে বাঁচাতে না পারার বেদনা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
এইভাবে দিন পার হলো, রাত পার হলো। একসময় বৃষ্টি থামলো, কিন্তু পানি কিছুতেই নামছে না। খাবার ফুরিয়ে এসেছে, পানির অভাবে মানুষ ক্লান্ত, কিন্তু কোথাও থেকে কোনো সাহায্যের চিহ্ন নেই। রেহানার চোখে তখন নিস্তেজতা আর হাল ছেড়ে দেওয়ার ছাপ। কিন্তু ছোট ছোট সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তার আবার বাঁচার ইচ্ছে জাগে।
অবশেষে, একদিন সকালে দূর থেকে একটা হেলিকপ্টারের আওয়াজ শোনা গেল। সুমনের মুখে একটু আশার আলো ফুটলো। হেলিকপ্টারটি আস্তে আস্তে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। তবে সাহায্য পৌঁছাতে সময় লাগবে, আর তাদের এই সময়টুকু টিকে থাকতে হবে।
রেহানা তখন ভেতর থেকে শক্তি সঞ্চয় করলো। সে জানতো, এটাই বেঁচে থাকার লড়াই। ছোট্ট রিজভী তার মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো, তানিয়া তার বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। এই কঠিন সময়ে তাদের একমাত্র সম্বল ছিলো একে অপরের প্রতি বিশ্বাস।
হেলিকপ্টার এসে অবশেষে সাহায্য করলো, কিন্তু তাদের জন্য এই ক্ষতি আর দুর্ভোগের কোনো সান্ত্বনা ছিল না। বন্যার পানিতে সব কিছু হারিয়ে গেলেও তারা নিজেদের আশা হারায়নি। রেহানা ও সুমন জানতো, এই দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে, কিন্তু তারা বেঁচে থাকবে—এই আশাতেই তারা আবার নতুন করে শুরু করবে।