07/11/2024
আমরা ইকোনো যুগের মানুষ—
ইকোনো বলপেন।
তিন টাকা দাম। সেই কলম প্রায়ই পেছন দিক দিয়ে কালির উদগীরণ ঘটায়। স্কুল কলেজের ছেলেদের দেখা যায় শার্ট বা প্যান্টের পকেটের নিচে ঘন কালির দাগ নিয়ে ঘুরছে। এই নিয়ে কেউ তেমন আগ্রহ দেখায় না। কারণ সকলেই জানে, তিন টাকার ইকোনো কলম কারণে অকারণে, সময়ে-অসময়ে এই কাণ্ড ঘটায়। এই কাণ্ডের প্রচলিত শব্দ হল, 'কলম হেগে দিয়েছে'!
কী উদ্ভট শব্দ! কিন্তু এই এক শব্দই সেকালে পুরো কলমকাহিনী বর্ণনায় যথেষ্ট।
তিন টাকার ইকোনো কলমের যুগে হঠাৎ চলে এল সাড়ে তিন টাকার ইকোনো ডিএক্স এবং রাইটার। ইকোনোর চেয়ে পঞ্চাশ পয়সা বেশি। এই কলম কালো, লাল, নীল রঙেরও হয়। কিন্তু যেখানে বাড়তি পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে কালো রঙের ইকোনো কেনাতেই মায়ের কঠোর নিষেধাজ্ঞা, সেখানে লাল, নীল রঙ কেনাতো অসম্ভব! এগুলো দিয়ে কি কাজ হয়, হ্যা? হয় কিচ্ছু? খালি পয়সা নষ্টের ধান্ধা! অথচ আমার যে কী ইচ্ছে হয়, লাল আর নীল রঙের দুখানা কলম কিনে বইয়ের পাতার সাদা কালো ছবিগুলোয় রঙ করি।
আকাশটাকে নীল করি। ঘোমটা পরা বউয়ের কপালে টুক করে একখানা লাল টিপ এঁকে দেই! আহা! কিন্তু সব ইচ্ছেরা কি ডানা মেলে? মেলে না। বেশিরভাগই টুপ করে ডানা ভাঙ্গা পাখি হয়ে যায়। তারপর পড়ে যায় কঠিন পাথুরে পৃথিবীতে!
লিখতে লিখতে কলমের কালি শেষ! আম্মার কাছে গিয়ে বলি, 'তিন টাকা দেন, কলম লাগব'।
আম্মা এসে তীক্ষ্ণ চোখে কলমের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কলমের ভেতর এখানে সেখানে কালি জমে আছে। আম্মা কেরোসিনের কুপির আগুনের তাপে সেই জমাট কালি গলিয়ে ফেলেন। কলমে আবার তরতর করে চলে।
আমার আর নতুন কলম কেনা হয় না। জমে থাকা কালি গলে গিয়ে আবার কলমের নিবের কাছে জমা হয়, আরও দিন দুই চার লেখা হয়!
আহা কলম! দাগে দাগে ঘ্রাণ... রঙে রঙে প্রাণ...
আমরা স্বপ্নের ডানা ভাঙ্গা পাখিরা অবশ্য দমে যাই না। ওই তিন টাকার ইকোনো কলম দিয়েই আমরা কত কত স্বপ্ন বানাই! রাস্তায় কুড়িয়ে পেলে, কারো কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে আমরা সেসব যত্ন করে জমিয়ে রাখি, এক, দুই, তিন... তারপর একদিন সেই সব কলমের পেছন আর সামনের দিক আগুনে গলিয়ে একটা আরেকটা সাথে জোড়া লাগাই, তারপর আরেকটা... সেই জোড়া লাগা কলমেরা কত কিছু হয়, কত কিছু!
কাপড় টানানোর হ্যাঙ্গার, অবিকল দেখতে স্টেনগান, পেনবক্স, একবার কে যেন আস্ত আলনা অব্ধি বানিয়ে ফেলেছিল!
আর স্কুলে গিয়ে, আঙুলের ডগায় টোকা দিয়ে 'কলম-কলম' খেলা, কলমের মুখের দিকটা আগুনে গলিয়ে পেছনের ফুটো দিয়ে ফু দিলেই- গলে যাওয়া স্বচ্ছ গোলাকার বল বের হত, আহা.!
সে কী উচ্ছ্বাস.!
কলমের নিবের গুঁতোয় কারো গাল , চোখ , কপাল ফুটো করে দেয়ার ভয়ংকর গল্পও কিছু কম নেই.!
কম কিছু নেই আক্ষেপ ও অক্ষমতার গল্পও। চৌদ্দ টাকার রেডলিফ , সাত রিফিল করে করে লিখতে পারা সেই 'অভিজাত' কলম দেখে কত যে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়েছি বুকের ভেতর , তার খবর আমার চোখ ও মন ছাড়া আর কে জানতো.!
আহা.!
আজ কী যেন লিখব , কাগজ হাতে নিয়ে কলম খুজছিলাম। ঠিক দশ মিনিট খুঁজেও কোথাও কলম পেলাম না। কোথাও না। একটা কলমও না।
এই রুমে কোথাও একটা কলম নেই.? নেই.? আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে ভাবলাম , ঘটনা কী.? কলম নেই কেন.? আমি কি তবে- কিছু লিখি না.?
কিচ্ছু না.? কিন্তু তাতো না। আমি রোজ রোজ লিখি , প্রচুর লিখি। উপন্যাস , গল্প , কবিতা , হাবিজাবি.... নানান কিছু। তাহলে.? আমি হতভম্ব হয়ে আবিষ্কার করলাম , আমার সামনের ল্যাপটপ , ল্যাপটপের কী বোর্ড , কী বোর্ডের উপরের অক্ষরগুলোর ঝাপসা অবয়ব.!
আমার আঙুলের মাথা- ক্ষয় হয়ে গেছে , একটু একটু করে , একটু একটু করে.?আর কলম.!
কলম হারিয়ে গেছে আমার শৈশবের মতন , গল্পের মতন , আনন্দের মতন , অনুভূতির মতন।
আমার হটাৎ প্রবল ইচ্ছে হতে লাগলো , একটা ৩ টাকা দামের ইকনো কলমের ক্লিপ খুলে নাকের কাছে ধরতে , সেখানে যদি খানিক ঘ্রাণ লেগে থাকে এখনো.!
কালির ঘ্রাণ , দাগের ঘ্রাণ , গল্পের ঘ্রাণ , শৈশবের ঘ্রাণ।
জীবনের ঘ্রাণ , যন্ত্রণারও ঘ্রাণ...