26/06/2025
🕊️ বিদায়ের বাণী: একজন আধ্যাত্মিক সাধকের মহাপ্রয়াণ
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন...
আজ বাংলার লোকসংগীত হারাল এক নীরব শ্রষ্টাকে, হারাল এক সুরতীর্থ সাধককে।
আজ চিরতরে চলে গেলেন “পিরিতের পাগল”, আমাদের প্রিয় খোয়াজ মিয়া।
তিনি শুধু একজন গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন হৃদয়ের কবি, মরমি চেতনার দীপ্ত প্রতিনিধি, এক অদৃশ্য আলোর দূত— যিনি আমাদের শিখিয়েছেন....
🎙️ খোয়াজ মিয়া: মরমি সাধক ও গানরচনার এক অবিস্মরণীয় নাম
“লাগাইয়া পিরিতের ডুরি আলগা থাইকা টানেরে আমার বন্ধু মহাজাদু জানে…”— এই জনপ্রিয় গানের কথাগুলো কেবল সুর নয়, হাজারো মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যাওয়ার এক অমোঘ বার্তা। এই গানসহ শত শত হৃদয়স্পর্শী গান রচনা করেছেন মরমি সাধক, গীতিকার ও লোকশিল্পী খোয়াজ মিয়া।
শৈশব: বাঁশি আর গান নিয়ে এক কিশোর
১৯৪২ সালের ১২ মার্চ সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে জন্ম নেন খোয়াজ মিয়া। তার পিতার নাম মৌলভী আজিজুর রহমান ও মায়ের নাম মোছাঃ আছতুরা বিবি।
জন্ম থেকেই তিনি ছিলেন একটু আলাদা— স্কুলের লেখাপড়ায় মন না দিয়ে গান আর বাঁশি বাজানোর প্রতি আকর্ষণে মাতাল হয়ে উঠতেন। পিতৃবন্দিত পরিবেশে বাঁশি বাজানো নিষেধ থাকলেও বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গ্রাম-গঞ্জে গিয়ে গান গাইতেন তিনি। এক ধরনের প্রবল সংগীতের নেশায় ভরা ছিল তাঁর কিশোর জীবন।
সংগীত সাধনা ও গুরু দর্শন
১৯৬২ সালে, বয়স ২২ বছর, তিনি যোগ দেন গুরুমহৎপৃষ্ঠ দুর্বিন শাহের শিষ্যত্বে। তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর আধ্যাত্মিক যাত্রা। গানের মাধ্যমে তিনি শুধু মনোরঞ্জন করেননি, মানবজীবন, প্রেম, আত্মা, ধর্ম ও সমাজ নিয়ে গভীর ভাবনা তুলে এনেছেন। নিজের জীবনের দুঃখ-কষ্ট, সমাজের অবিচার, মানবতা এবং স্বপ্নগুলো গানেই ফুটিয়েছেন। “প্রেমাগুনে দেহ আত্মা, করো ভাজা ভাজা…” গানটি যেমন তাঁর আধ্যাত্মিকতা ও মানবিক প্রেমের চিহ্ন।
জনপ্রিয় গান ও শিল্পীদের কণ্ঠে প্রশংসা
ডলি সায়ন্তনী, শিমুল খান, আশিক, সাজ্জাদ নূরসহ অনেক খ্যাতিমান শিল্পীর কণ্ঠে তার গানগুলো জনপ্রিয় করে তুলেছেন। বহু অ্যালবামের শিরোনাম হয়েছে তাঁর লেখা গানের বাণী। সিলেট ও তার আশপাশের মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন খোয়াজ মিয়া।
🕊️ বিয়ে ও সংসার: সুরভরা এক নিঃসঙ্গ জীবন 💔👨👦
গান ছিল তাঁর ধ্যান, সাধনা, জীবনের ধ্রুবতারা। অথচ সময় ও সমাজ কখনও একমত ছিল না তাঁর এই জীবনের পথচলার সঙ্গে। ২৫ বছর বয়সে পরিবারিক চাপে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন খোয়াজ মিয়া। সে সময় হয়তো গান ছিল হৃদয়ে, কিন্তু বাস্তবতা তাকে নিয়ে গিয়েছিল এক ভিন্ন জীবনের দিগন্তে।
প্রথম সংসারের শুরুতেই আসে অন্ধকার। প্রথম সন্তান জন্ম নেবার কিছুদিন পরেই তার স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, ফলে এই সংসার ভেঙে যায় অকস্মাৎ। সেই সময় পিতা আজিজুর রহমান এর মনে একধরনের হতাশা জন্ম নেয়— গানপাগল এই ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েন। খোয়াজ মিয়ার সন্তানের প্রতি উদাসীনতা ও বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন দেখে তিনি পুত্রকে আবারও বিয়ের পিঁড়িতে বসান।
তবে বিধির নির্মম পরিহাস— দ্বিতীয় স্ত্রীও, পাঁচ সন্তান জন্ম দিয়ে, চিরদিনের মতো পরপারে পাড়ি জমান। এই ধাক্কায় ভেঙে পড়েন খোয়াজ মিয়া। জীবনের এক দীর্ঘ সময় তিনি সন্তানদের মুখ চেয়ে, গানের জগৎকে একপাশে সরিয়ে রেখে পিতার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
🎼 গান একদিকে, সংসারের ঘানি অন্যদিকে— দুইয়ের টানাপোড়েনে যেন জীবন হয়ে পড়ে অগোছালো, অবিন্যস্ত।
অবশেষে জীবনের গভীর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, এক পর্যায়ে তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দেন। গান লেখা চালিয়ে যান ছেঁড়া কাগজে, ব্যবধান গুনে নেওয়া ফুরসতের সময়টুকুতে। এর ফাঁকে জীবিকা নির্বাহের জন্য মাটির সঙ্গে মিশে থাকা নানা কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন।
পরবর্তীতে তৃতীয়বারের মতো তিনি আবারও বিয়ে করেন। সেই সংসারে জন্ম হয় আরও চার সন্তানের। এভাবেই কালের আবর্তে গানের সাধক খোয়াজ মিয়া পরিণত হন এক সংগ্রামী পিতায়, এক ক্লান্ত যোদ্ধায়— যিনি জীবনের চাপে ভেঙে পড়েও গানের ভেলায় নিজেকে টিকিয়ে রাখেন।
এই সুরভরা, অথচ নিঃসঙ্গ জীবন তাঁর গানেও মাঝে মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়—
“নাইরে সুখের ঘর, নাইরে সঙ্গী সাথী
সুরের বনে ঘুরে ফিরি, নিঃসঙ্গ এই পাথি।”
সংসারের দায়িত্ব যেমন তাঁকে একজন দায়িত্ববান পিতায় রূপ দিয়েছে, তেমনি বিচিত্র জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর গানের গহিনতাকে আরও মর্মস্পর্শী করেছে।
🌍 সীমান্ত পেরিয়ে সুরের সফর: খোয়াজ মিয়ার যুক্তরাজ্য ভ্রমণ 🎤🇬🇧
দীর্ঘদিন দেশে মাটির গান গেয়ে মানুষের হৃদয় জিতে নেওয়ার পর, ২০১৯ সালে জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ে প্রবেশ করেন মরমি গীতিকার খোয়াজ মিয়া। স্থানীয় কয়েকজন প্রবাসী ভক্ত ও সংগীতানুরাগীর আন্তরিক সহায়তায় প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্য ভ্রমণের সুযোগ ঘটে তার।
এই সফর ছিল কেবল ভ্রমণ নয় — এটি ছিল তার সাধনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বহির্বিশ্বে বাঙালির হৃদয়ে যে তার গান গভীর ছাপ ফেলেছে, সেটি যেন প্রমাণিত হলো এই সফরের মাধ্যমে।
প্রবীণ বয়স হলেও ভ্রমণসঙ্গীদের সহযোগিতায় তিনি যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ম্যানচেস্টারসহ কয়েকটি শহরে বাঙালি কমিউনিটির আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সেখানে একাধিক লোকসংগীত ও মরমি গানের আসরে নিজের লেখা গান পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন তিনি। মঞ্চে বসে থাকা সেই সাদা পাগড়ি পরা নরম চোখের বৃদ্ধ কবিকে দেখে যেমন শ্রদ্ধা জাগে, তেমনি তার কণ্ঠে যখন উঠে আসে— “আমার বাড়ি আয় রে বন্ধু…”
— তখন উপস্থিত শত শত প্রবাসীর চোখে জল দেখা যায়।
সেই গানের আসরগুলো কেবল অনুষ্ঠান ছিল না — প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে দেশের লোকসংস্কৃতির এক আত্মিক মিলন ঘটে সেখানে। তারা শুনেছিল সেই মানুষের কণ্ঠ, যিনি শুধু গান লেখেন না, গান জাপন করেন।
যুক্তরাজ্যের বাতাসে যখন বাংলার বাউল ধ্বনি গমগম করে ওঠে, তখন প্রবাসী শ্রোতারা যেন অনুভব করেন মাটির ঘ্রাণ। বহু প্রবাসী আবেগাপ্লুত হয়ে তার গানে নিজেদের শেকড় খুঁজে পান।
কয়েক সপ্তাহের সফরে খোয়াজ মিয়া যেমন শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যান, তেমনি সাংস্কৃতিক মঞ্চে বাংলাদেশের লোকসাধনার প্রতিনিধিত্ব করেন একজন জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে।
অবশেষে সফল সেই সফরের পর দেশে ফিরে এসে আবারও নিঃশব্দে, নির্জনে গান ও সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি — যেন যুক্তরাজ্যের আকাশেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন সিলেটের মরমি সুরের স্নিগ্ধতা।
🕊️ বিদায়ের বাণী: একজন আধ্যাত্মিক সাধকের মহাপ্রয়াণ
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন...
আজ বাংলার লোকসংগীত হারাল এক নীরব শ্রষ্টাকে, হারাল এক সুরতীর্থ সাধককে।
আজ চিরতরে চলে গেলেন “পিরিতের পাগল”, আমাদের প্রিয় খোয়াজ মিয়া।
তিনি শুধু একজন গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন হৃদয়ের কবি, মরমি চেতনার দীপ্ত প্রতিনিধি, এক অদৃশ্য আলোর দূত— যিনি আমাদের শিখিয়েছেন,
👉 কিভাবে ভালোবাসা হয় আত্মার,
👉 কিভাবে গান হয় সাধনার,
👉 আর কিভাবে জীবন হয় জ্ঞানের পথে হাঁটা এক দীর্ঘ হাওর।
তার গানে ছিল প্রেম, প্রতিবাদ, মানবতা, ছিল আধ্যাত্মিক চেতনার এক গভীর রূপ।
“আমার বাড়ি আয় রে বন্ধু, আমার বাড়ি আয়”—এই ডাক শুধু প্রিয়জনের ছিল না, ছিল আত্মার মিলনের অনন্ত আহ্বান।
“লাগাইয়া পিরিতের ডুরি, আলগা থাইকা টানেরে…” — এই সুরে কান্না মিশেছে, মিশেছে সাধকের নিঃশ্বাস।
🎶 আমরা হারালাম—
✅ এক আধ্যাত্মিক শিল্পী
✅ এক স্বপ্নবান সাধক
✅ এক মানবিক পথপ্রদর্শক
✅ আর হারালাম গ্রামবাংলার ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক বাউলমন
যিনি সারা জীবন গান লিখেছেন নিজের মতো করে,
নিন্দা সহ্য করেছেন, সমাজের চোখ রাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে শুধু সুরের পেছনে ছুটেছেন।
কখনো ফজরের আজান পর্যন্ত লিখে গেছেন,
কখনো হাওরের মাঝখানে একা বসে বাঁশি বাজিয়েছেন।
👨👩👧👦 জীবনের শেষ প্রান্তে—
অনেক কষ্ট আর দায়িত্বের বোঝা বয়ে,
নয়টি সন্তানের পিতা হয়ে,
সংসারের ঘানি টেনে গিয়েও,
তিনি গান ছাড়েননি।
কারণ এ গানই ছিল তার জীবন,
তার আত্মা, তার পথ।
🕯️ আজ আমরা কী হারালাম?
আমরা হারালাম সেই মানুষটিকে— যার ডায়েরির পাতায় লেখা আছে হাজারো অমর লাইন,
যার কথা আর সুরে বাঁধা আছে মাটি, প্রেম, দুঃখ আর আকাশ।
আমরা হারালাম সেই পুরুষটিকে— যিনি তিনটি বিয়ের পরও ছিলেন নিঃসঙ্গ সাধক,
যিনি নিজের জন্য নয়, গান আর মানবতার জন্য বেঁচে ছিলেন।
🤲 চলুন, আমরা বলি—
আল্লাহ্ তুমি তাকে কবুল করে নাও।
তোমার জান্নাতের সব থেকে সেরা জায়গাটিতে ঠাঁই দাও,
যেখানে গান থামে না, ভালোবাসা মরে না, আর আত্মা পায় সত্যিকারের মুক্তি।
📢 এখন আমাদের দায়িত্ব:
🔸 তার গানের সংগ্রহ সংরক্ষণ করা
🔸 একটি আর্কাইভ বা স্মারক প্রকাশ
🔸 রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে সম্মানিত করার দাবি
🔸 এবং নতুন প্রজন্মকে জানানো—
বাংলা গানের ইতিহাসে খোয়াজ মিয়া নামটি একটি শ্রদ্ধাভরা চিরন্তন অধ্যায়।
🌿 শেষ কথা...
"কয় খোয়াজ মন বাঁধব কীসে, মরলাম গো তার প্রেম বিষে..."
আজ সত্যি—
আমরা সবাই সেই বিষে একটু একটু করে পুড়ছি।
কিন্তু তার রেখে যাওয়া গানের আলো
আমাদের মনটাকে এখনো জ্বালিয়ে রাখে।
বিদায় খোয়াজ মিয়া!
আপনার গান বেঁচে থাকবে যতদিন এই বাংলার মাটি আছে,
আমরা গাইব, কাঁদব, ভালোবাসব—
আর বলব, আপনি ছিলেন আমাদের হৃদয়ের সাধক। 🎶🕊️
লেখক: সাংবাদিক আমিনুর রহমান জিলু
সভাপতি, জগন্নাথপুর রিপোর্টার্স ইউনিটি
তারিখ: ২৬ জুন ২০২৫ ইংরেজি