09/10/2025
রাণীখং: পাহাড়, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির এক চিরন্তন উপাখ্যান
শেখ একেএম জাকারিয়া
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে, নেত্রকোণার দুর্গাপুরের এক কোণে লুকিয়ে আছে এক অপূর্ব জগৎ, 'রাণীখং'। সোমেশ্বরী নদীর স্বচ্ছ জলরাশি আর পাহাড়ি টিলার সবুজে মোড়া এই ভূমি যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক চিত্রপট। এখানে এসে মনে হয় নদী, পাহাড় ও মানুষের জীবন একে অপরের সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা; প্রকৃতি, ইতিহাস ও মানুষের অস্তিত্ব যেন একে অপরের প্রতিধ্বনি।
দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার উত্তরে, কাল্লাগড়া ইউনিয়নের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে, এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী নিদর্শন- রাণীখং মিশন। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ক্যাথলিক ধর্মপল্লী আজ কেবল উপাসনালয় নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যের এক অবিচ্ছেদ্য মিলনক্ষেত্র। পাহাড়ের বুক চিরে উঠে যাওয়া গির্জার ঘণ্টাধ্বনি যেন সময়ের সীমা পেরিয়ে ভেসে আসে-প্রার্থনার মতোই পবিত্র এক নীরবতায়। রাণীখং মিশনে প্রবেশ করতে হলে তিনটি গেইট অতিক্রম করতে হয়। গির্জার তৃতীয় গেইটে লেখা আছে, “সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী, রাণীখং। প্রতিষ্ঠিত: ১৯১২ সন।” এই কারণে স্থানীয়দের কাছে গির্জাটি ‘সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী’ নামেই পরিচিত।
রাণীখং নামের পেছনে রয়েছে এক মুগ্ধকর লোককাহিনি। বহুদিন আগে এ অঞ্চলে ‘খং-রাণী’ নামে এক রাক্ষসীর বাস ছিল। গারো আদিবাসীরা তাকে বধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনে। সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় ‘রাণীখং’। কিংবদন্তিটি মিথে পরিণত হলেও নামটি আজও বহন করছে ইতিহাসের স্মৃতি আর পাহাড়ি জনজীবনের প্রতীক।
অন্য এক তথ্যে জানা যায়, একসময় এই জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে এক রাজা বসবাস করতেন। জনশ্রুতি আছে, রাজার কন্যা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে রাজপ্রাসাদের পেছনে সোমেশ্বরী নদীর তীরভূমি রাক্ষসী রূপ ধারণ করে। ক্রোধান্ধ রাজা রাজ-জল্লাদের হাতে স্ত্রী ও নবজাত কন্যাকে হত্যা পর টিলায় গর্ত খনন করে সমাধিস্থ করেন। সেই থেকেই টিলাটির নাম হয় ‘রাণীখং’। আমার ধারণা, ‘খনন’ শব্দ থেকেই ‘খং’ শব্দটির উৎপত্তি। আবার কারো মতে, খং-রাণী ও কন্যার করুণ মৃত্যুর ঘটনাই এই টিলার নামের উৎস। যদিও এর পক্ষে কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায় না।
পরবর্তীতে গারো বৈশ্যা রাজা এই স্থানীয় রাজাকে পরাজিত করে এখানে গারো জনবসতি স্থাপন করেন।
তবু নামটি এক অর্থে সত্যেরই প্রতীক; কারণ এই পাহাড়ি অঞ্চল সত্যিই সৌন্দর্যের রাণী। সবুজ টিলা, নীরব বন, আর গারো সংস্কৃতির নৈসর্গিক আবেশ যে কোনো আগন্তুককে মুগ্ধ করে, পরিচয় করিয়ে দেয় এক অপূর্ব নতুন পৃথিবীর সঙ্গে।
গির্জার ইতিহাসও এক শিকড়মুখী অধ্যায়। স্থানীয় ধর্মভক্তদের অনুরোধে ঢাকার বিশপের উদ্যোগে ১৯১২ সালে সোমেশ্বরীর পাড়ের পাহাড়চূড়ায় নির্মিত হয় এই গির্জা। চারপাশে সাদা বালির প্রান্তর, দূরে নীলচে পাহাড়ের রেখা; সব মিলিয়ে রাণীখং গির্জা যেন এক স্বপ্নীল দৃশ্য। নীরব দুপুরে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে এলে মনে হয়, সময় থমকে গেছে; বাতাসে মিশে যাচ্ছে শত বছরের প্রার্থনা, বিশ্বাস ও শান্তির প্রতিধ্বনি।
রাণীখং মিশনের প্রাঙ্গণে রয়েছে গির্জার পাশাপাশি দাতব্য চিকিৎসালয়, দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ডাকঘর ও ‘শান্তিনিকেতন’ নামের বিশ্রামাগার; যেখানে বসে প্রকৃতিপ্রেমীরা উপভোগ করেন পাহাড়, নদী ও মেঘের লুকোচুরি। আকাশের রঙ যেমন প্রতিদিন বদলায়, তেমনি বদলায় মানুষের মুখের হাসিও-যেন প্রকৃতি ও মানুষ একে অপরের প্রতিবিম্ব।
দুর্গাপুর অঞ্চল মূলত গারো ও হাজং সম্প্রদায়ের বসতি। তাদের জীবনযাপন প্রকৃতিনির্ভর, সরল ও ছন্দময়। পাহাড়ের ঢালে তাদের নাচ, উৎসবে ঢোলের তালের ছন্দ, হাসিতে পর্বতের সুর; সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক অনন্য নান্দনিকতা। কৃষিকাজ, সামাজিক আচার, বিয়ে-উৎসব সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রকৃতির উপস্থিতি। এখানকার মানুষ এখনো প্রকৃতির সন্তান; তারা প্রকৃতির ভাষায় কথা বলে, আর তাদের গানে থাকে বৃষ্টি ও ধানের সুবাসের গল্প।
১৯৭৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য রক্ষায় বিরিশিরিতে প্রতিষ্ঠা করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি। প্রতি বছর গারো, হাজং, কোচ, হদি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে মিলিত হন নিজেদের উৎসব, নাচ, গান ও রীতিনীতি নিয়ে। রঙিন পোশাক, ঢোলের তালে তালে নৃত্য আর মাটির গন্ধে ভরা হাসিতে গড়ে ওঠে সহাবস্থানের উৎসব; যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি ও প্রকৃতি একাকার হয়ে যায়। তাছাড়া বিরিশিরিতে রয়েছে একটি বধ্যভূমি স্মৃতিফলকও, যেখানে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ৭৫ জন শহীদের নামের তালিকা সংরক্ষিত রয়েছে। রাণীখংয়ের আশেপাশে রয়েছে হাজং মাতা রাশিমণির স্মৃতিসৌধ, কমরেড মণি সিংহের টঙ্ক আন্দোলনের স্মারক, রাজা সুসঙ্গের রাজবাড়ি, ফান্দা ভ্যালি ও কমলরানীর দিঘি। এসব নিদর্শন যেন সাক্ষ্য দেয়; দুর্গাপুর শুধু প্রকৃতির নয়, ইতিহাসেরও এক মহাগ্রন্থ।
রাণীখংয়ে পৌঁছাতে হলে সুনামগঞ্জ থেকে জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, মোহনগঞ্জ ও নেত্রকোনা, শ্যামগঞ্জ হয়ে দুর্গাপুর আসতে হয়। এরপর সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে রিকশা বা মোটরবাইকে অল্প সময়েই পৌঁছানো যায় এই মনোমুগ্ধকর পাহাড়চূড়ায়; যেখানে প্রকৃতি নিঃশব্দে প্রতিটি দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা বলে।
রাণীখং তাই কেবল একটি স্থান নয়; এটি এক অনুভব; যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতি পরস্পরের সীমানা ভেঙে একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। এখানে পাহাড় কথা বলে, নদী গান গায়, আর মানুষ সেই সুরে খুঁজে পায় শান্তির ভাষা। শতবর্ষ পেরিয়েও রাণীখং মিশন আজও বহন করছে সহাবস্থানের সেই চিরন্তন সঙ্গীত, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে জাগিয়ে তোলে এক অবিনশ্বর সৌন্দর্যবোধ।
তথ্যসূত্র:
১. রাণীখং মিশন, জেলা তথ্য বাতায়ন, নেত্রকোনা জেলা।
২. “অনন্য পর্যটনকেন্দ্র নেত্রকোনার দুর্গাপুর”, নাগরিক সংবাদপত্র।
৩. “অপার সৌন্দর্যের রাণীখং”, সঞ্জয় সরকার, রাইজিংবিডি ডটকম।
৪. মৌখিক সাক্ষাৎকার ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
ভ্রমণকাল: ৪ অক্টোবর ২০২৫