Mustakim HASAN

Mustakim HASAN Fulfilling the Goal is my Own Dream.....

01/04/2025
29/03/2024

নিজের জীবনের গল্প, নিজেরই। অন্যের কাছে সে গল্প বলে ফেললেই, সে গল্পের গভীরতা কিছু কমে বাড়ে না। কেবল সময়ের বিনিয়োগে গল্প একসময় স্বাভাবিক হয়ে যায়।
আমি সবসময় সে সময়টুকু অতিবাহিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করি।
~ভিলেন

20/03/2024

আমারে যে ভালোবাসতে পারলো না; সে অন্য কাউরে ভালোবাসুক।
সে টের পাক- কত'টা তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কাউরে ভালোবাসা লাগে।
--

12/03/2024

একটা গাছের ঠিক ভাবে বেড়ে উঠার জন্য মাঝে মাঝে আগাছা কেটে ফেলতে হয়। যত বড় গাছ তত বেশি আগাছা। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। মানুষের আগাছা হলো অহংকার।

Books of Zunayed Evan

09/03/2024

❑ প্রথম অধ্যায়- স্মৃতিগন্ধা

হেমন্তের বিষন্ন সন্ধ্যা।
খানিক আগেই ভুবনডাঙা স্টেশন ছেড়ে সাইরেন বাজিয়ে চলে গেছে সন্ধ্যার ট্রেন। তারপর থেকে অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। সুনসান নীরবতা। একটা হলুদ পাতা হঠাৎ উড়ে এসে পায়ের কাছে পড়তেই পারু ম্লান চোখে তাকায়। কী রুক্ষ , প্রাণহীন চারপাশ! যেন ক্রমশই নেমে আসছে মৃত্যু। গাঢ় অন্ধকার। মুখভার থমথমে আকাশও মিশে গেছে দূরে কোথাও। কিন্তু পারুর খুব ইচ্ছে হয়, ওই আকাশটাকে টুপ করে বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে। এমন আকাশ কি আর কোথাও আছে? এমন মন কেমনের সন্ধ্যা? ওই যে দূরের গ্রাম, শুকনো খড়ের মাঠ, ভেজা ঘাসের মেঠোপথ? ওই যে নরেন দাদুর ফোঁকলা দাঁতের হাসি? ভুবনডাঙা নদী? এই যে সে বসে আছে পুকুরপারে, ওই যে সামনে শান বাঁধানো ঘাট, স্বচ্ছ জলের আয়না, তুলসি তলার মায়া, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ, এমন কি আর কোথাও কিছু আছে?
পারু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও লুকায়। মানুষ হওয়ার এই এক যন্ত্রণা। জীবনভর কেবল লুকাতে হয়! মিহি কুয়াশার ভেতর থেকে গায়ে এসে বেঁধে সূচের ফলার মতো তীক্ষè হিমেল হাওয়া। জড়সড় চারু ডাকে, ‘দিদি।’
‘হুম?’ সাড়া দেয় পারু।
‘এসব ছেড়ে যেতে তোর ভালো লাগবে?’
‘কই যাব?’
‘কেন? তুই শুনিসনি?’
‘কী?’
‘বাবা যে বলল আমাদের জমিগুলো বিক্রির একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই আমরা কলকাতা চলে যাব! ভুবনডাঙার ট্রেন ধরে বর্ডার পর্যন্ত। তারপর সীমানা পার হলেই ভারত। আমরা আর কখনো ফিরে আসব না দিদি?’
পারু ছোট বোনের দিকে তাকায়। চারুর বয়স চৌদ্দ। তার থেকে বছর চারেকের ছোট। মাথাভর্তি চুল। মা চুপচুপে তেল দিয়ে বেণি করে দিয়েছে চুলে। সে তাকিয়ে আছে ফ্যাকাশে চোখে। পারুর হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, এই বয়সের স্মৃতি কতটা গভীর হয়? আজ থেকে কুড়ি বছর পর কি আজকের এই সন্ধ্যার কথা চারুর মনে থাকবে? কিংবা তার?
‘নাহ।’ পারু ফোঁস করে লুকানো দীর্ঘশ্বাসটা ফেলে। ‘আমরা আর কখনোই ফিরে আসব না।’
‘কখনোই না?’
‘উহু।’ বলেই উঠে দাঁড়ায় পারু। তুলসীগাছের তলায় সন্ধ্যা আরতি দিচ্ছেন মা। তার পাশেই ঠাকুরঘর। ওই যে বাঁশের কঞ্চি কেটে বানানো ঠাকুরমার লাঠিটা ওখানে। তার পাশে কাঠের খড়ম। দরজার কাছে জলচৌকি। ঘরের টিনের চালের ওপর ডালপালা ছড়ানো আমগাছ। গোয়ালঘর থেকে গলগল করে ধূপের গন্ধ বেরুচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই মশা তাড়াতে ধূপ জ্বেলে দেন মা। কালো রঙের বড় গাইটা কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তার চোখ কি ভেজা?
পারু জানে না। তবে সে দু পা এগিয়ে গাইটার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। হাত বোলাতে থাকে পিঠে। বাবা খদ্দের খুঁজছেন। ভালো দাম পেলেই বেচে দেবেন। তারপর? কোথায় চলে যাবে কালু? আর কখনো দেখা হবে না তাদের? পারুর আচমকা কী যে হয়! সে দুই হাতে গাইটাকে জড়িয়ে ধরে। গাল ঘসতে থাকে পিঠে। এত কান্না পাচ্ছে কেন তার কে জানে! এই সবকিছু ছেড়ে সে কোথায় যাবে? কীভাবে যাবে?

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো মহিতোষের। তাঁর পায়ের আওয়াজ পেতেই ছায়ারাণী হাঁক ছাড়লেন, ‘কে ওইখানে? মহি নি?’
‘হ্যাঁ মা।’
‘রাইত কয় ঘড়ি হইছে, সেই খেয়াল আছে? এখন বাড়ি ফেরনের টাইম?’
‘একটু দেরি হয়ে গেল মা।’
‘দিন-কাল ভালো না। এত রাইত করে বাড়ি ফিরিস না।’
মহিতোষ জানেন, দিনকাল ভালো না। তবে ভালো হলেও লাভ নেই। মায়ের এই দুশ্চিন্তা কখনোই যাবে না। সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফেরা ছায়ারাণীর পছন্দ না। এটা সে সেই এতটুকু বয়স থেকে দেখে এসেছে। উঠানের পাশে কলতলা। মহিতোষ সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। অঞ্জলি কেরোসিনের কুপি আর গামছা নিয়ে এলেন। মহিতোষ বললেন, ‘পারু আর চারু ঘুমিয়েছে?’
‘তা জানি না। তবে শুয়েছে।’
‘না ঘুমালে শোবে ক্যান?’
‘কে জানে!’ অঞ্জলির কণ্ঠে বিরক্তি। ‘সারাক্ষণ দুজনে কী গুটুর গুটুর করে কে জানে!’
মহিতোষ হাসেন, ‘দুই বোনে খাতির থাকা ভালো।’ বলে হাতে-মুখে জল ছেটান তিনি। গড়গড় করে কয়েকবার মুখ কুলকুচি করেন। তারপর মাথায় মুখে শেষবারের মতো জলের ছিটা দিয়ে অঞ্জলির হাত থেকে গামছা নেন। অঞ্জলি বলেন, ‘জমি বেচার কোনো বন্দোবস্ত হলো?’
মহিতোষ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। সময় নিয়ে হাত মুখ মুছলেন। তারপর বললেন, ‘লোকে যা মাগনা পাওয়ার আশা করে, তা কি আর টাকা দিয়ে কিনতে চায়?’
‘মাগনা পাওয়া যাবে ক্যান?’
এই প্রশ্নের জবাব দেন না মহিতোষ। অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকান তিনি। ঘরের পুবদিকে ঘন বাঁশঝাড়। সেখানে চারদিক থেকে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে নুয়ে এসে মাথার ওপরের আকাশটাকে ঢেকে দিয়েছে বাঁশঝাড়টা। এই দৃশ্য তাঁর কতকালের চেনা! অথচ এই সব ছেড়ে চলে যেতে হবে? মানুষ যেখানে জন্মায়, সেখানে কেন গাছের মতো শিকড় গজিয়ে ফেলে? শুষে নিতে থাকে আলো, জল, হাওয়া। তারপর কেন আবার তাকে সেই শিকড় উপড়ে নিয়ে চলে যেতে হয় অন্য কোথাও? ক্রমাগত শুকিয়ে যেতে হয় ভেতরে-বাইরে। শিকড় উপড়ানো মৃত গাছের মতোই। রাতে খেতে বসে তিনি বললেন, ‘বড়দা কলিকাতা থেকে চিঠি দিয়েছে।’
‘কী লিখেছে?’ অঞ্জলির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।
‘ভালো কিছু না। পাঁচ-ছ বছর তো হলো ওপারে গেল। কিন্তু এখনো কিছুই গোছাতে পারেন নাই। বলেছেন, দেশে তাঁর ভাগের জমি-জমা যা ছিল, তার একটা ব্যবস্থা যেন করে যাই আমি। কিছু টাকা-পয়সা পেলে খুব উপকার হবে...।’
‘আমাদের জমিগুলাইতো বেচতে পারছেন না। তাঁরটা কেমনে বেচবেন?’
মহিতোষ জবাব দেন না। চুপচাপ ভাত খেতে থাকেন। কুপির আলোয় দেয়ালে তাঁর দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। খানিক ঝুঁকে ভাতের গ্রাস মুখে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ছায়াটাও ঝুঁকছে। ওই ছায়ার দিকে তাকিয়ে অঞ্জলির কেমন অস্বস্তি হতে থাকে। খুব অসহায় আর ন্যুব্জ লাগছে মানুষটাকে। যেন জীবনের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত। বছর পাঁচ-ছয় আগে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, তখন কত কত মানুষ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু মহিতোষ যাননি। বাপের দেশের মাটি ছেড়ে কোথায় যাবেন তিনি? এই গ্রাম, এই ঘর-বাড়ি, ফসলের মাঠ, মাটি ও মানুষ সবই তার হাতের তালুর মতো চেনা। মায়ের মতো মায়াময়। এসব ছেড়ে কেন যাবেন? কিন্তু সময় বদলায়। বদলায় চারপাশের মানুষও। যাকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, জলের মতো স্বচ্ছ-সহজ ভেবে দিনের পর দিন নির্ভরতায় পথ চলেছেন, সেই মানুষটাও আচমকা কেমন অন্যরকম হয়ে উঠতে লাগল। সবাই যে এমন, তা নয়। বরং বেশির ভাগই সহজ-সরল, আত্মীয়সম প্রতিবেশী। কিন্তু তারা বড় নিরীহ, নির্ঝঞ্ঝাট। ফলে নরম ঘাসের মতো তাদের পায়ের তলায় পিষে ভয়াল আদল নিয়ে বেড়ে উঠেছে কিছু দানবীয় মানুষ। তাদের ছায়া ক্রমশই বিস্তৃত হচ্ছে। এই পরিবর্তনটা অনেক দিন ধরেই টের পাচ্ছিলেন মহিতোষ। তারপরও মন সায় দিচ্ছিল না তাঁর। বলতে গেলে মাটি কামড়েই পড়েছিলেন। এ তার বাপ-দাদার ভিটে। এখানেই তাঁর নাড়িপোতা। এ ছেড়ে কোথায় যাবেন তিনি?
কিন্তু গত বছরের বন্যা আর নদীভাঙনে স্কুলটাও বিলীন হয়ে গেল নদীতে। তার ওপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শুরু হলো নানা রাজনৈতিক সংকটও। সেসব সংকটে হঠাৎই কেমন গুমোট হয়ে গেল চারপাশ। কালবোশেখী ঝড়ের আগে যেমন হয়।

মহিতোষের বড় ভাই পরিতোষ খানিক ভীতু প্রকৃতির। যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সীমানা পেরিয়ে ওপারে চলে গিয়েছিলেন। এতকিছু আর ভাবেননি তখন। কিন্তু সীমান্তের ওপারে যে নিরাপদ জীবনের ভাবনায় তখন আচ্ছন্ন ছিলেন, সেই ঘোরও কাটতে লাগল ধীরে ধীরে। বুঝতে পারলেন, একবার যে গৃহত্যাগ করে তার আর কোথাও কখনো ঘর হয় না। পথের ধারের সরাইখানায় হয়তো বছরের পর বছর থাকা যায়, কিন্তু সেখানে কখনো ঘরের মায়া থাকে না। এ যেন মায়ের কোল ছেড়ে পাথুরে পৃথিবীতে নামার মতোই। বুকের ভেতর খানিক স্পর্শের জন্য, মায়ার জন্য, চেনা ঘ্রাণের জন্য ছটফট করতে থাকে। অন্য কোথাও হয়তো অন্য কোনো মমতাময়ী নারী থাকে। আশ্রয় ও ভালোবাসাও থাকে। কিন্তু মা?

মা ছাড়া আর কোথায় মেলে মায়ের স্নেহ?
মহিতোষ ভাত খেয়ে উঠতে উঠতে বলেন, ‘পারু আর চারুর দিকে খেয়াল রেখো। বেলা-অবেলায় এদিক-সেদিক না যাওয়াই ভালো।’
অঞ্জলি কথা বলেন না। তবে মহিতোষের দুশ্চিন্তা তিনি বুঝতে পারেন। রাতে ঘুমাতে গিয়ে মহিতোষ বললেন, ‘মনে হয় না জমি-জমা ঠিকঠাক মতো বেচতে পারব। আর পারলেও দাম পাব দশ ভাগের এক ভাগ। সবাই ভাবছে আজ হোক, কাল হোক, দেশ তো ছাড়বোই। তখন উড়ে এসে জুড়ে বসবে। শুধু শুধু টাকা-পয়সা দিয়ে কিনে কী লাভ?’

টিনের চালে টুপটাপ শিশিরের শব্দ হয়। একটা পাতা, ছোট ডাল, একটা নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ রাতের এই নীরবতার বুকে সুই-সুতোর মতো দুঃখ গেঁথে দিতে থাকে।

কাক ভোরে ঘুম ভাঙে পারুর। সে ফিসফিস করে চারুকে ডাকে, ‘এই, ওঠ। ওঠ।’
চারু ঘুম ঘুম গলায় বলে, ‘আরেকটু ঘুমাই না দিদি।’
‘আর কত ঘুমাবি? ওঠ।’
চারু অবশ্য ওঠে না। সে কাঁথা টেনে নিয়ে নিজেকে আরো জড়িয়ে নেয়। ভোরের এই হিম হিম অনুভবে কাঁথার ওই ওমটুকু যেন তাকে আরামে অবশ করে দেয়। গাছের পাতার ফাঁক গলে ভোরের সোনালি আলোর প্রথম আভাটুকু তখন কেবল উঁকি দিতে শুরু করেছে। পারু হাত বাড়িয়ে সেই আলোটুকু হাতে মেখে নেয়। গরম চায়ের পেয়ালা থেকে ভেসে আসা ধোঁয়ার মতো পাতলা কুয়াশা ভাসতে থাকে সেই আলোর ভেতর। সে পা টিপে টিপে বাড়ির উঠোনটা পেরোয়। তার ওপাশে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের পাশেই খোলা চাতাল। মা গোবর আর মাটি দিয়ে লেপে চকচকে করে রেখেছে চাতালটা। শীতের ভোরে যখন আরো খানিকটা আলো ফুটবে, ওম ছড়াবে সূর্য, তখন এখানে এসে সবাই রোদ পোহাতে পোহাতে ভাত খেতে বসবে। রাতের বেঁচে যাওয়া কড়কড়ে ঠাÐা ভাত। বেগুন, আলু, টমেটোর সঙ্গে ছোট মাছের ঠাÐা-জমাট ঝোল-তরকারি। তারপর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন মা। গাছ-গাছালির জন্য বাড়ির উঠানে তেমন রোদ পড়তে পারে না। ফলে ফসল শুকানো থেকে শুরু করে রোদ লাগে এমন সব কাজ এখানেই করতে হয়। দিনভর সূর্য এখানে দাপিয়ে বেড়ায়। আরামদায়ক ওমে বুক পেতে রাখে মাটি। বাঁশের আড়ায় লেপ, তোশক শুকাতে দেন মা। যাতে আরাম করে ঘুমানো যায় রাতে। দুপুরের দিকে বড় পাতিলে করে কলতলা থেকে জল এনে এখানে রোদে রাখা হয়। সেই জল গরম হতে থাকে। ঠাকুরমাকে তখন জলচৌকিতে দাঁড় করিয়ে স্নান করিয়ে দেন মা। ড্যাবড্যাব করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে পারু আর চারু।
ছায়ারাণী অবশ্য খেঁকানো গলায় বলেন, ‘আমি চান করতেছি, আর তোরা দুইটা অমনে চাইয়া থাকস ক্যান?’
পারু দাঁত বের করে হাসে, ‘তোমার রূপ-যৌবন দেখি ঠাকুমা।’
‘আমার রূপ-যৌবন দেখন লাগব না। নিজেদের রূপ-যৌবন দেখানোর নাগরের ব্যবস্থা কর।’
‘তুমি কি ছোট থেকেই এমন জোয়ান ছিলা?’ পারু চোখ টিপে বলে, ‘না হলে ঠাকুরদা ক্যান অত অল্প বয়সের তোমাকে দেখে পাগল হলো!’
‘তোর এই বয়সে আমি দুই পোলা, এক মাইয়ার মা হইছি। আর তোগো বোহেই তো এখনো ঠিকঠাক মাংস জমে নাই। পোলাপান হইলে খাওয়াবি কী?’
ছায়ারাণীর মুখ বড় নির্লজ্জ। ঠোঁটকাটা। এমন আচমকা কথা বলায় তাঁর জুড়ি নেই। কথাগুলো মনে হতেই পারু একা একা হাসে। মন খারাপও হয়। এই যে এমন সোনালি আলো, ওই যে দূরের মাঠ, শিশির ভেজা ঘাস, ঠাকুরমার সঙ্গে এই এখানে এত এত খুনসুঁটি, এসবকিছুই কেবল স্মৃতি হয়ে যাবে? আর কখনো এখানে ফিরে আসা হবে না তাদের? এখানে অন্য কেউ থাকবে? অন্য কারো গল্প জমা হতে থাকবে? আর তাদের স্মৃতির ভাড়ার নিয়ে তারা চলে যাবে অন্য অজানা কোথাও?

চাতালের ডান দিকটায় তাকাতেই মন ভালো হয়ে গেল পারুর। হেমন্তের রাতই মূলত শীত নিয়ে আসে ভুবনডাঙায়। সারা রাত টুপটাপ ঝরে পড়তে থাকে শিশির। নেমে আসতে থাকে কুয়াশা। তারপর ভেজা মাটি, ঘাস আর ফুল। চাতালের ওই দিকটা শিউলি ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। পারু ছুটে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। মুক্তোর মতো শিশির জমে আছে শুভ্র ফুলের পাপড়িতে। সে আঙুলের ডগায় ছুঁয়ে দেয়। অদ্ভুত এক শিহরণে গা শিরশির করে ওঠে। ওড়না মেলে ফুল কুড়াতে থাকে সে। আর গুনগুন করে গাইতে থাকে-
‘তুমি এমন করে কুড়িয়ে নিয়ো আমায়, এমন ঝরা ফুলের মতো,
আমি তোমার ছোঁয়ায় বাঁচবো নতুন করে, ভুলবো ভুলের ক্ষত’।

সাইকেলের টুংটাং শব্দটা ঠিক সেই মুহূর্তেই কানে এলো পারুর। মাটির উঁচু রাস্তা থেকে ক্ষেতের আইলঘেঁষা সরু মেঠোপথ ধরে নেমে আসছে ফরিদ। তার পরনে লুঙ্গি। গায়ে হাফহাতা শার্ট। শার্টের ওপর আড়াআড়ি চাদর জড়ানো। তবে সাইকেল চালাতে গিয়ে চাদরটা সরে গিয়ে বুকের খানিকটা উন্মুক্ত হয়ে আছে। ভোরের হিমেল হাওয়ায় চোখ-মুখ আড়ষ্ট। এত ভোরে এখানে এভাবে ফরিদকে দেখে ভড়কে গেল পারু। সে চকিতে উঠে দাঁড়াল। তারপর ত্রস্ত পায়ে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে। ফরিদ ডাকল, ‘পারু।’
পারু খানিক থমকাল। তবে থামল না। ফরিদ আবার ডাকল, ‘পারু, শোন। এই পারু।’
পারু এবারও থামল না। হাঁটতেই থাকল। তবে ফরিদ হাওয়ার মতো উড়ে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়াল। তারপর শক্ত গলায় বলল, ‘ডাকছি, শুনছো না?’
পারু প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘পথ ছাড়েন। কেউ দেখে ফেললে খুব খারাপ হয়ে যাবে।’
‘হোক। আমার তাতে কিছু যায় আসে না।’
‘আমার যায় আসে। বাবা দেখলে খুন করে ফেলবে আমাকে।’
‘কিন্তু কী করব আমি? তুমি কিছুই বলছো না!’
‘বলেছি তো, আমি জানাব।’
‘রোজ বলছো জানাব। কিন্তু কখনোই কিছু জানাও না!’
‘ইচ্ছে করে যে জানাই না, তা তো নয়। আপনি বোঝেন না?’
ফরিদ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘কী জানি! আজকাল আর তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিছুই বুঝতে পারি না। এই মনে হয় সব ঠিকঠাক। তুমি ঠিক আগের মতোই আছো। আবার পরক্ষণেই মনে হয় তোমাকে চিনি না আমি।’
পারু জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। সে নিজেও কি আজকাল নিজেকে ঠিকঠাক চেনে? কীভাবে চিনবে? তার চারপাশের পৃথিবীটা যে ক্রমশই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এই পৃথিবীতে সে একা নয়। তার বাবা আছেন, মা আছেন। ঠাকুরমা, চারু আছে। আছে আরো কতকিছু! এখানে সে ফরিদকে নিয়ে কীভাবে ভাববে? কী ভাববে?
ফরিদ খানিক চুপ করে থেকে নরম গলায় বলল, ‘তোমরা সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছো, পারু?’
‘হুম।’ ফরিদ সবই জানে। পারু তাকে বলেছে। কিন্তু তারপরও তার কিছুতেই কিছু বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয়, এটা সত্যি নয়। পারু হঠাৎ করেই ফিক করে হেসে ফেলবে। তারপর ঝলমলে গলায় বলবে, ‘পুরুষ মানুষের এত অল্পতেই ভয় পেলে চলে?’
‘এটা এত অল্প?’
‘অল্প নয়?’
‘উহু।’
‘তাহলে?’
‘এটা আমার জীবনের চেয়েও বড়।’
‘জীবনের চেয়েও বড় কী জানেন?’
‘কী?’
‘বাবা বলেন জীবনের চেয়ে বড় হলো মৃত্যু। আমার চলে যাওয়া কি তবে আপনার কাছে মৃত্যুর মতো?’
এই কথায় ফরিদ চুপ করে থাকল। আসলেই তো, পারু ছাড়া তার জীবনের আর অর্থ কী! সেই জীবন তো মৃত্যুরই মতো।

ফরিদ দীর্ঘ নীরবতার পর আবারও ডাকল,
‘পারু?’
‘হুম।’
‘সত্যিই চলে যাবে? আর কখনো কোনোদিন ফিরবে না?’
‘উহু।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কী?’
‘তাহলে আমি কী করব?’
এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। ফরিদ মুসলমান একটা মেয়ে দেখে বিয়ে-টিয়ে করে সংসারি হবে। পারু চলে যাবে কলকাতা। সেখানে তার হিন্দু কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবে। এই যে এত জটিলতা, এত দুশ্চিন্তা, সমীকরণ এর কিছুই তখন আর থাকবে না। হয়তো কখনো কখনো মাঝরাত্তিরে তাদের পরস্পরের কথা মনে পড়বে। তারপর মন খারাপ হবে। তাদের কিছু মিষ্টি স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতিগুলো বুকের ভেতর সুবাস ছড়াবে। হয়তো কান্না জমবে চোখে। আবার শুকিয়েও যাবে।
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে তারা যন্ত্রণা আড়াল করে হাসিমুখে মিশে যাবে জীবনের চোরাস্রোতে।

❏ পরের অধ্যায় পড়তে চোখ রাখুন এই পেজে... আসছে শীঘ্রই...
লেখক -Sadat Hossain - সাদাত হোসাইন

09/03/2024

প্রতিটি সফল পুরুষের পেছনে নারী পরিশ্রম
অবশ্যই থাকে,প্রথমে মা,বোন, যে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, ভালোবাসা,যত্ন দিয়ে সামনে এগোতে সাহায্য করে,তাদের প্রত্যেককে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।🌸

Happy women's day ❤️

29/02/2024

ইন্না-লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজিয়ুন।
আমার চাচা মুফোজ্জিল আলি লস্কর আজ সকালে ইন্তেকাল করেছেন। জানাজার নামাজ পরে জানানো হবে।
সবার দোয়া ও জানাজায় উপস্থিতি কামনা করি। 😭😭🙏

মিছিলেও প্রেম হোক , ভেঙে যাক মোহ্ 😊তুমি সাজো ব্যারিকেড, আমি বিদ্রোহী🌸
25/02/2024

মিছিলেও প্রেম হোক , ভেঙে যাক মোহ্ 😊
তুমি সাজো ব্যারিকেড, আমি বিদ্রোহী🌸

20/02/2024

মহান ২১শে ফেব্রুয়ারী আমি কি বুলিতে পারি।
রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা,।ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা।আমি কি ভুলিতে পারি একুশে ফেব্রুয়ারি’। চেতনার পথে দ্বিধাহীন অভিযাত্রী বেশে বাঙালিকে সর্বদা চলার প্রেরণা জোগায় একুশ। আজ সেই অমর একুশে। শোক বিহ্বলতা, বেদনা আর আত্মত্যাগের অহংকারে উদ্বেলিত হওয়ার দিন আজ। সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই💕💕

15/02/2024

নিদ্রাহীন, ঘোর লাগা, বিষন্ন এক রাতে
আত্মহত্যা থেকে পালাতে যেয়ে
ফিরলাম তোমার কাছে ;
সেই তুমিই কি না গলা চেপে ধরলে!🌸😅

Address

Sylhet

Telephone

+8801721963202

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Mustakim HASAN posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Mustakim HASAN:

Share

Category