
01/06/2025
সাপ-বিচ্ছুর ঘর
কবরকে আমরা ওয়েটিং রুম হিসেবে বুঝে নিতে পারি। ওয়েটিং রুমে যেমন মানুষ তার পরবর্তী অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে, আরামের হবে নাকি কষ্টের। আরামের হলে হেসে-খেলে সময় পার করে। কষ্টের হলে এক ঘণ্টা এক বছরের মতো মনে হয়। তার পরও সময় যেতে চায় না। অনুরূপ প্রত্যেক কবরবাসীকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে সে জান্নাতি না জাহান্নামি। জান্নাতি হলে আরামে সময় পার করবে। আর জাহান্নামি হলে নিদারুণ কষ্টে সময় অতিবাহিত করবে। কবর এমন এক স্থান যেখানে সাহায্যের জন্য বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজন বলতে কেউই থাকবে না। শুধুই নেক আমল হবে তার সাথী। দুনিয়ার হায়াতে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, কোরআন তেলাওয়াতসহ ইত্যাদি নেক আমল তাকে আজাব থেকে রক্ষা করবে। মুনকির-নকির ফেরেস্তাদ্বয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে কবর হবে উত্তম স্থান। আর উত্তর দিতে না পারলে ভয়াবহ শাস্তির জায়গা। হজরত উসমান (রা.) যখন কোনো কবরের পাশে দাঁড়াতেন তখন এমনভাবে কাঁদতেন যে, নিজের দাড়ি মোবারক ভিজে যেত।
একবার হজরতকে জিজ্ঞাসা করা হলো আপনি জান্নাত ও জাহান্নাম স্মরণ করে এত কাঁদেন না, যতটুকু কাঁদেন কবর দেখে, এর কারণ কী? তিনি বললেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, কবর হচ্ছে আখেরাতের প্রথম ধাপ। এখানে যদি কেউ রক্ষা পেয়ে যায় তাহলে পরবর্তী সব ধাপ অতিক্রম করা তার জন্য সহজ হয়ে যাবে। আর এখানে কেউ যদি রক্ষা না পায় তাহলে পরবর্তী সব ধাপ খুব কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি আরো বললেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, মেরাজের রজনীতে আমি যত ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছি তার মধ্যে কবরের আজাবই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস নং : ২৩০৮)।
প্রিয় পাঠক! বেনামাজির কবরে কী ধরনের আজাব হবে এ সম্পর্কে হাদিসে আছে, বেনামাজির কবরে তিন ধরনের শাস্তি হবে : ১. কবর তার জন্য এমন সংকীর্ণ হবে যে, এক পাশের বুকের হাড় আরেক পাশে ঢুকে যাবে। ২. তার কবরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। ৩. তার কবরে এমন একটি সাপ নিযুক্ত করা হবে যার চক্ষু হবে আগুনের। আর নখগুলো হবে লোহার। তার প্রত্যেকটি নখ লম্বা হবে এক দিনের দূরত্বের পথ। সাপের আওয়াজ হবে বজ্রের মতো বিকট। সাপ ওই বেনামাজিকে বলতে থাকবে ‘আমাকে আমার রব তোর ওপর নিযুক্ত করেছেন যাতে ফজরের নামাজ নষ্ট করার কারণে সূর্যোদয় পর্যন্ত তোকে দংশন করতে থাকি। জোহরের নামাজ নষ্ট করার কারণে আসর পর্যন্ত দংশন করতে থাকি। আসর নামাজ নষ্ট করার কারণে মাগরিব পর্যন্ত। আর মাগরিব নামাজ নষ্ট করার কারণে এশা পর্যন্ত। আর এশার নামাজ নষ্ট করার কারণে ফজর পর্যন্ত তোকে দংশন করতে থাকি।’
এ সাপ যখনই তাকে একবার দংশন করবে তখনই সে ৭০ হাত মাটির নিচে ঢুকে যাবে (উঠিয়ে আবার দংশন করবে) এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত আজাব হতে থাকবে। নেক্কার ও বদকারের কবরের অবস্থা একটি দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, হজরত বারা ইবনে আজিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, মোমিন ব্যক্তির কবরে দুজন ফেরেশতা আসে ও তাকে বসায়। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করে, তোমার রব কে? সে উত্তর দেবে, আমার রব আল্লাহ। তারা তাকে জিজ্ঞাসা করবে, তোমার দীন কী? সে উত্তরে বলবে, আমার দীন হচ্ছে ইসলাম। তারা এবার তাকে জিজ্ঞাসা করবে, ওই ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল? সে উত্তর দেবে ইনি হচ্ছেন আমাদের রাসুল (সা.)। তারা এবার তাকে জিজ্ঞাসা করবে (এ উত্তরগুলো) তুমি কীভাবে জানলে? সে বলবে আমি আল্লাহর কিতাব থেকে জেনেছি এবং তার ওপর ইমান এনেছি। তখন রাসুল (সা.) বলেন, এটাই হচ্ছে আল্লাহতায়ালার ওই বাণীর মর্ম, যেখানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ মোমিনদের দৃঢ় বাক্যের ওপর দৃঢ় রাখেন পার্থিব জীবনে ও আখেরাতে।’ রাসুল (সা.) বলেন, তখনই আসমান থেকে এক ঘোষণাকারী ডাক দিয়ে বলবেন, আমার বান্দা সত্য বলেছে। সুতরাং তাকে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দাও এবং তার দিকে জান্নাতের দরজা খুলে দাও। তখন তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হবে। তার কাছে জান্নাতের শান্তি ও সুঘ্রাণ আসতে থাকবে। কবরকে তার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করে দেওয়া হবে। প্রিয় পাঠক! চলুন, আমরা সবাই কবরের আজাব থেকে বাঁচার উপায় কী? তা জেনে আমলসমূহ বাস্তবায়ন করি।
হাদিসে কবরের আজাব থেকে বাঁচার কয়েকটা আমলের কথা উল্লেখ আছে, সেখান থেকে এখানে আমি মাত্র দুটি উল্লেখ করছি। (১) রাসুল (সা.) বলেছেন, সুরা মুলক কবরের আজাব থেকে রক্ষাকারী। যে ব্যক্তি এ সুরা পাঠ করবে, এ সুরা তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবে। (কুরতুবি) রাসুল (সা.) নিয়মিত রাতে ঘুমানোর আগে সুরা মুলক তেলাওয়াত করতেন। (২) কবরে আলো পাওয়ার আমল হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। হাদিসে আছে ‘নামাজ নুর বা আলো’ কবরে ও হাসরের ময়দানের আলো হবে নামাজ। আল্লাহতায়ালা আমাদের কবরের আজাব থেকে রক্ষা করুন।
কবর দৈনিক পাঁচটি জিনিস মানুষের কাছে অনুরোধ করে : ১. আমি একাকী ঘর, সঙ্গী নিয়ে এসো। উত্তর : সঙ্গী হলো কোরআন। ২. আমি অন্ধকার ঘর, বাতি নিয়ে এসো। উত্তর : বাতি হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। ৩. আমি মাটির ঘর, বিছানা নিয়ে এসো। উত্তর : বিছানা হলো নেক আমল। ৪. আমি সাপ-বিচ্ছুর ঘর, বিষের ওষুুধ নিয়ে এসো। উত্তর : ওষুধ হলো দান-সদকা ও সৎ কর্ম । ৫. আমি প্রশ্নের ঘর, উত্তর নিয়ে এসো। উত্তর : উত্তর হলো কালেমা ও জিকির। মনে রাখবেন, কবরের আজাব ভয়ংকর। কবর যত জটিল কেয়ামত তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। কেয়ামত যত কঠিন, জাহান্নাম তার চেয়ে অনেক... অনেক... অনেক বেশি কঠিন। শেষ বিচারের মালিক একমাত্র আল্লাহ। কবরে খালি হাতে যেও না, সঙ্গে কিছু নিয়ে যাও তার জন্য। নামাজ পড়ো! পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়...! মরণ এক দিন মুছে দেবে সব পরিচয়। শেষ ঠিকানা তো ওই মাটিই...!
আল্লাহতায়ালা সবকিছুর ওপরই ক্ষমতাবান। সুতরাং আল্লাহর সাহায্য বান্দার একান্ত কাম্য। এজন্য আল্লাহতায়ালা এবং রাসুল (সা.) মানুষের জীবন চলার পথের সব কর্মকাণ্ডের জন্য শিখিয়েছেন দোয়া ও আমল। যারা তা যথাযথ নিয়মে পালন করবেন আল্লাহতায়ালা তাদের হিফাজত করবেন। বিষাক্ত প্রাণীর দংশন এবং হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে হিফাজতের একটি দোয়া তুলে ধরা হলো। ওই দোয়াটি সকাল-বিকাল তিনবার পাঠ করলে আল্লাহতায়ালা তাকে বিষাক্ত ও হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে হিফাজত করবেন।
দোয়াটি হলো- উচ্চারণ : আউজুবি কালিমাতিল্লাহিত তামমাতি মিন শাররি মা খালাকা।
অর্থ : আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি আল্লাহর সব পূর্ণ কালিমাসমূহের উসিলায়, তার সৃষ্ট সব প্রাণীর অনিষ্ট থেকে।
ফজিলত : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার এক লোককে বিচ্ছু দংশন করলে লোকটি ব্যথার কারণে রাতে ঘুমাতে পারল না, সকালে রাসুল (সা.) কে বিষয়টি জানালে তিনি বললেন, যদি সন্ধ্যাবেলায় এ দোয়াটি পড়ত তাহলে সকাল পর্যন্ত বিচ্ছুর দংশন তার কোনো ক্ষতি করতে পারত না। (মুসলিম, ইবনু মাজাহ, আবু দাউদ) হজরত সুহাইল ইবনে আবি সালেহ বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই এ দোয়াটি মুখস্থ করে নিয়েছিল এবং নিয়মিত তা পড়ত, একদা আমাদের পরিবারের একটি মেয়েকে বিচ্ছু দংশন করল কিন্তু সে কোনো ব্যথাই অনুভব করেনি। (মুসনাদে আহমদ)