04/03/2023
তাবলীগ জামাত নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি ও তার জবাব।
দাওয়াত ও তাবলীগ। দাওয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহর দ্বীন ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করা। আর তাবলীগ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। নবী-রাসূলদের মূল দায়িত্ব ছিল দাওয়াত এবং তাবলীগ। নবুয়াতের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আম্বিয়ায়ে-কেরাম (আ.) বা নবীরা যে কাজ করতেন সে কাজের দায়িত্ব পড়ে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ওপর। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর একটি বাক্য যদি আমাদের কারো জানা থাকে, তা অন্যদের পৌছে দিতে। রাসুল (সা.)-এর এই নির্দেশ পালন করা সব মুসলমানের জন্য জরুরী। তাবলীগ জামাত এ কাজটিই করছে। আর এই তাবলীগ জামাত বা এর কার্যক্রম সর্ম্পকে কারো কারো কিছু বিভ্রান্তি, ভুল ধারনা বা অজ্ঞতা রয়েছে। তাই এ সর্ম্পকে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করা হল।
..
প্রশ্নঃ তাবলীগের মূল দাওয়াত ছয় উছুলের মাধ্যমে বিন্যস্ত হয়েছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?
উত্তরঃ তাবলীগের মূল দাওয়াতকে ছয়টি উছুলে বা গুনে বিন্যস্ত করা হয়েছে এবং এর মধ্যেই সব কথা সন্নিবেশিত হয়েছে। কেননা রসূল (সা.) ও সাহাবীদের আমালি জিন্দেগী পর্যালোচনা করলে এগুলোই প্রস্ফুটিত হয়। সেগুলো হলো কলেমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন বা মুসলমানের সেবা, তাছহীহে নিয়্যাত বা সহীহ নিয়্যত ও নাফরুন ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় সফর।
তবে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানুষের আত্মিক বা ঈমানী পরিবর্তন। মাল ও আমল আল্লাহর জন্যই কেবলমাত্র নিবেদন করা। সবচেয়ে বড় কথা হলো পৃথিবীতে মানুষ সকল কাজ বুঝে করে, আর একমাত্র দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত মানুষ করে বুঝতে পারে।
..
প্রশ্নঃ তাবলীগের চিল্লা পদ্ধতি কি ইসলামী শরীয়াহ সম্মত? পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চিল্লায় ঘুরে বেড়ানোর উদাহরণ ইসলামে কিভাবে এসেছে?
উত্তরঃ তাবলীগের চিল্লা পদ্ধতি ইসলামী শরীয়াতে অবৈধ কিছু নয়। ইসলামে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমনঃ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য মাদ্রাসার বিভিন্ন ক্লাসের সময় নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। তাছাড়া তাবলীগের চল্লিশদিনের সময়টি আমরা বরকতপূর্ণ মনে করে থাকি। কারণ আমাদের জন্ম প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন, রক্ত অবস্থায় চল্লিশ দিন থাকে। এই চল্লিশদিন পর গোশতের টুকরায় পরিণত হয়। এর চল্লিশদিন পর হাড্ডি সঞ্চার করা হয়। তার চল্লিশদিন পর তাতে চামড়ার আবরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। তাছাড়াও এই চল্লিশদিনের উদাহরণ অন্য প্রেক্ষাপটে আছে। যেমনঃ হযরত ইব্রাহীম (আ.) চল্লিশদিন অগ্নিকুন্ডের মধ্যে শান্তিতে ছিলেন। হযরত মুসা (আ.) চল্লিশদিন তুর পাহাড়ে ছিলেন। হযরত ইউনুস (আ.) চল্লিশদিন মাছের পেটে ছিলেন। হযরত ইউসুফ (আ.) চল্লিশদিন কুয়ার মধ্যে ছিলেন। এ সমস্ত কারণে আমরা উক্ত সংখ্যাটিকে বরকতপূর্ণ মনে করে থাকি। তবে আমরা তাবলিগের কাজে ৩, ৭, ১০, ৪০, ৬০ ও ১২০ দিনের জন্যও বের হই। আর পরিবার-পরিজন থেকে বিছিন্ন হয়ে চিল্লায় ঘুরার বিষয়টি সম্পর্কে বলতে চাই, আমাদের কেউ বিচ্ছিন্ন থাকে না বরং সবাই পরিবারের খোঁজ খবর নেন। যোগযোগ রাখেন। তাছাড়া যারা মুসলমান তাদের এই বিশ্বাস রাখা উচিত, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে বের হয় আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরতি ফেরেশতা দ্বারা তাদের হেফাজত করেন।
..
প্রশ্নঃ কোরআনে বলা হয়েছে নিজে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো এবং আহাল বা পরিবার পরিজনদেরকেও বাঁচাও। অথচ নিজে পরিবার ও আহলদেরকে পরিশুদ্ধ না করে দেশের বিভিন্ন এলাকা ও বিদেশে তাবলীগে যাওয়া কতটুকু শরীয়াহ সম্মত?
উত্তরঃ একথা ঠিক যে আগে নিজে সংশোধন হওয়া উত্তম তারপর পরিবারকে সংশোধন করা উত্তম। অতঃপর আহালদেরকে। কিন্তু এরা সকলেই সংশোধন না হলেও আমরা বাইরে যাই। তার কারণ হলো, নিজের আত্মিক উন্নতি ও দ্বীন শিক্ষার জন্য। বাইরে না গেলে কোন ব্যক্তির রুহানী পরিবর্তন সম্ভব নয়। দ্বীন শিখতে হলে ঘর ছাড়তে হবে। সকল নবী রাসূলেরা এই কাজ করে গেছেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) নবুওয়াতের পূর্বে দীর্ঘদিন যাবত হেরা গুহায় মেহনত করেছিলেন কিভাবে জাতিকে তাওহিদমুখী করা যায়। অতঃপর আল্লাহ তাঁকে নব্যুওয়াতের মতো মর্যাদাকর সার্টিফিকেট প্রদান করেন। সুতরাং মেহনত ছাড়া এই পৃথিবীতে কোন কিছুই সম্ভব নয়।
..
প্রশ্নঃ আপনারা কি ধরনের জিকির করেন?
উত্তরঃ আফজাল জিকির হলো কুরআন তেলাওয়াত। সেটা আমরা করে থাকি। তাছাড়া সকাল-বিকাল তিন তাসবীহ পড়ি। একশতবার সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার। একশতবার তাওবা ইসতেগফার ও একশতবার দূরূদে ইব্রাহীম বা অন্য যে কোন দরুদ। তাছাড়া চব্বিশ ঘন্টাই আমরা সকল স্থানের প্রয়োজনীয় সব দোয়া বা মাসনুন দোয়া সমূহ পড়ার চেষ্টা করি।
..
প্রশ্নঃ অনেকে বলে থাকেন তাবলিগের মধ্যে ব্যাপক ভাবে কোরআনের তাফসীর, হাদীস ও ইসলামী গ্রন্থ পড়তে দেয়া হয় না। বরং কেবলমাত্র ফাযায়েলের উপর কিছু নির্দিষ্ট কিতাব পড়তে দেয়া হয়। সে ব্যাপারে আপনাদের বক্তব্য কি?
উত্তরঃ এ কথা সঠিক নয়। আমাদের মধ্যে কোরআন এর তাফসীর পড়াতে কোন নিষেধ নেই। হাদীস পড়তেও কোন নিষেধ নেই। ইসলামী গ্রন্থ পড়তেও নিষেধ নেই। তবে যে লোকটি এখনো অ, আ, ক, খ-ই পড়তে শিখেনি। তাকে যদি একটি সাহিত্য গ্রন্থ দেয়া হয় তাহলে সে-তো পড়তে পারবে না বরং তাকে এখন দিতে হবে একটি আদর্শলিপি। যাতে সে পড়া শিখতে পারে। তদ্রুপ, আমাদের জামায়াতে যে সমস্ত ভাইয়েরা আসেন তারা যাতে দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের পড়া শিখতে পারে তার জন্য সে অনুযায়ী ফাযায়েলে আমল, ফাযায়েলে সাদাকাত, মুন্তাখাব হাদীস, হায়াতুস সাহাবা ইত্যাদি গ্রন্থ পড়তে দেয়া হয়। ফাযায়েল অর্থ হলো লাভ। মানুষ যে জিনিসে লাভ দেখে তা পাওয়ার জন্য কখনো কখনো জীবনও দিয়ে দেয়। সেজন্য, তাবলিগের ভাইদের দ্বীনের জ্ঞান চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে এই ধরনের গ্রন্থ গুলো আগে পড়তে উৎসাহিত করা হয়।
..
প্রশ্নঃ ইসলামে কোন বৈরাগ্যবাদ নেই। কিন্তু, সমাজ-সংসার, বাড়ী-ঘর ছেড়ে যেভাবে আপনাদের কর্মকাণ্ড চলছে তাতে বিষয়টি কি বৈরাগ্যের মতো মনে হয় না?
উত্তরঃ তাবলীগের মেহনত কোন বৈরাগীর মেহনত নয়। তাবলীগ করতে হলে বাড়ি-ঘর, চাকরি-বাকরি, ব্যাবসা-বাণিজ্য চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে বনে-জঙ্গলে চলে যেতে হবে এমন নয়। বরং আমরা তো বলি, ভালো ছাত্র ভালো রেজাল্ট করবেই। যে সৎ ব্যবসায়ী সে ধনীই হবে। তেমনিভাবে যে আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে সে আল্লাহরই হয়ে যাবে। তখন আল্লাহ তাকে যেভাবে চালাবেন সেভাবেই সে চলবে। সে হবে অন্যান্য মানুষ হতে পরিপূর্ণ ভিন্ন একটি মানুষ। তাই বাড়ি-ঘর চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে বনে-জঙ্গলে চলে যাওয়া নয় বরং কিছুদিনের জন্য মসজিদওয়ালা পরিবেশে থেকে সবচেয়ে বড় দ্বীনদার হয়ে যাওয়া তখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয়ে যায়।
..
প্রশ্নঃ তাবলীগের ইজতেমাকে অনেকে হজ্বের সাথে তুলনা করেন। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?
উত্তরঃ তাবলীগের ইজতেমাকে হজ্বের সাথে তুলনা করা সম্পূর্ণ অন্যায়। কারণ হজ্ব হলো একটি ফরজ ইবাদত। যা না করলে গোনাহগার হতে হয়। কিন্তু, তাবলীগের ইজতেমায় আসা ফরজ নয় এবং না আসলে গোনাহগারও হতে হবে না। দুটি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। যার একটির সাথে অন্যটির কখনোই তুলনা করা চলে না। হজ্বের মত লোক সমাগম হলেই সেটাকে দ্বিতীয় হজ্ব বলা সমীচীন নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাবলীগের পক্ষ থেকে এধরনের কোন কথা কখনোই বলা হয় না। তবে কোন সাধারণ মুসল্লি যদি আবেগের কারণে এমন কোনো কথা বলে থাকেন তাহলে সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
..
প্রশ্নঃ আপনাদের ফান্ড কি এবং কোথা হতে আসে?
উত্তরঃ আমাদের ফান্ড হলো আল্লাহ তায়ালার খাজানা বা ভান্ডার। যেহেতু, আমাদের মেহনত হচ্ছে নিজের জান ও মাল দিয়ে। সেহেতু সব উম্মতের পকেটই আমাদের ফান্ড। সুতরাং যে আসবে সে নিজের টাকা খরচ করে খাবে। আপনারা শুনে অবাক হবেন যে, প্রতি বছর ইজতেমায় লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ও কাকরাইসহ সারা দেশের মারকাজ মসজিদে দেশী-বিদেশী মেহমানদের খেদমতের ইন্তেজাম আল্লাহ তায়ালার অশেষ অনুগ্রহেই সম্ভব হয়। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, ❝মানুষের কাছে চাওয়া হলো ভিক্ষা। আর আল্লাহর কাছে চাওয়া হলো দোয়া। মানুষের কাছে চাইলে মানুষ রাগ করেন। অপরপক্ষে আল্লাহর কাছে না চাইলে আল্লাহ রাগ করেন।❞ সুতরাং যাঁর কাছে চাইলে ইন্তেজাম হবে তাঁর কাছেই আমরা চাই। সবারই উচিত তাঁর কাছে চাওয়া।
..
প্রশ্নঃ আপনাদের দপ্তর বা অফিস কোথায়?
উত্তরঃ পৃথিবীর সমস্ত উম্মতের দিল বা হৃদয়ই আমাদের দপ্তর। তবে বাংলাদেশের কাকরাইলসহ সারা দেশের অনেকগুলো মসজিদ ও ভারতের নিজামুদ্দিন বাংলাওয়ালী মসজিদ আমাদের মারকাজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
....
সংগ্রহ ও পরিমার্জনায় মোঃ ইব্রাহীম