25/04/2024
ফুটবল ইতিহাসে তো অনেক খ্যাত কুখ্যাত ম্যাচই আছে। অনেক ম্যাচ এমনও আছে, যা ফুটবল প্রেমীরা মনে রাখবে যুগ যুগ ধরে। কিছু ম্যাচ আবেগের, কিংবা কিছু ম্যাচ প্রতিশোধের। কিন্তু এসব কিছুকে হার মানিয়ে দেওয়ার মতো স্মৃতি ও আছে ফুটবলে, যাকে স্মৃতি না বলে এক কালো অধ্যায় বলাটাই উত্তম। ব্যাটল অব সান্তিয়াগো, ফুটবলের সবচেয়ে কলঙ্কিত ম্যাচ! যার ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই সুদূর অতীতে।
১৯৬২ বিশ্বকাপ, সেবার গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের আসর বসেছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে। সম্প্রতি হওয়া ভূমিকম্পে চিলি তখনো লণ্ডভণ্ড। নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটি। এমনই অবস্থা যে বিশ্বকাপের ৮ টি ভেন্যুর ৪ টিই তখন বিপর্যস্ত। ভেঙে পড়া দেশটিকে চিলির খেলোয়াড়েরা চেয়েছিল ভালো কিছু উপহার দিতে। তাই টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই আগ্রাসী খেলতে শুরু করে তারা। এমনই এক ম্যাচে চিলি মুখোমুখি হয় ইতালির।
তবে এ ম্যাচের আগেই কোল্ড ওয়ার শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে। ইতালিয়ান মিডিয়া চিলির বিশ্বকাপ আয়োজনে অযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। এমনকি তারা চিলির সার্বিক অবস্থা নিয়েও ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করে বসে। ম্যাচের আগে এ ঘটনা ছড়িয়ে পরে সান্তিয়াগোতে। স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিল ৬৬০০০ দর্শক। গোটা স্টেডিয়াম জুড়ে টানটান উত্তেজনা। লাল আর নীল জার্সিতে ছেয়ে গেছে প্যাভিলিয়ন। তবে ম্যাচ শুরু হওয়ার পূর্বেই দুই দলের মধ্যে এক দফা থুতু ছোড়াছুড়ি হয়ে গেছে। ঘটনা এত টুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তো!
ম্যাচ শুরুর সাথে সাথেই পুরো মাঠ রূপ নিলো যুদ্ধক্ষেত্রে! ১২ সেকেন্ডের মাথায়ই প্রথম ফাউল। ৫ মিনিটের মধ্যে এক দফা হাতাহাতি হয়ে গেছে দুই দলের মধ্যে। এ সময় বল ছাড়াই ঘুষাঘুষিঘুষি শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। বিশ্বকাপে তখনো কার্ডের প্রচলন শুরু হয়নি, তবে বহিষ্কৃত করার নিয়ম ছিল। ১২ মিনিটের মধ্যেই রেফাসি ইতালির জর্জিও ফেরারিকে মাঠ থেকে বের করে দেন। কিন্তু মাঠ ছাড়তে নারাজ ফেরারিকে মাঠের বাইরে পাঠাতে মাঠে পুলিশ প্রবেশ করে। নষ্ট হয় প্রায় ১০ মিনিট সময়। কিন্তু রেফারি যখন এদিকে ব্যস্ত, তখনি হুট করেই ইতালি ক্যাপ্টেন মাশ্চিওর নাকে ঘুষি মারেন চিলির সানচেজ।
রেফারি এসে বাগড়া দিলে যথারীতি ম্যাচ শুরু হয়। কিন্তু ইতালিয়ান হয়তো প্রতিশোধ নিতেই পছন্দ করে। ৪২ মিনিটে এই সানচেজই ফাউলের শিকার হন। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেও ইতালির ডেভিড তাকে ক্রমাগত লাঠি দিয়ে থাকেন। উঠে দাঁড়িয়েই ডেভিডের মুখে ঘুষি মেরে বসেন সানচেজ। রেফারি শুধুমাত্র ফাউল দিলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ইতালি সমর্থকরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে প্রবেশ করে পুলিশ। কিন্তু ডেভিড ছিলেন প্রতিশোধের নেশায় মত্ত। কয়েক মিনিট পরই বাতাসে বল ভেসে আসলে সেই ছুতোতে ডেভিড ফ্লাইং কিক বসিয়ে দেন সানচেজের মাথায়। ডেভিডকে সরাসরি মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেন রেফারি। এবারও সাহায্য নিতে হয় পুলিশের।
দ্বিতীয়ার্ধেও ম্যাচের সার্বিক পরিস্থিত তেমন উন্নতি না হলেও আর কাউকেই মাঠ ছাড়তে হয়নি। ১১ জনের চিলির বিপক্ষে খেলতে হয়েছিল ৯ জনের ইতালিকে। এমনই অবস্থা, দুইদলই গোল দেয়ার থেকে মারামারি করতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। ফলে ম্যাচের ৭৩ মিনিট পর্যন্ত হয়নি কোনো গোল। অবশেষে ৭৩ মিনিটে গেরো খুলে চিলি, দলকে লিড এনে দেন রামিরেজ। ম্যাচের ৮৭ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত শটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন তোরে। রেফারি হয়তো আর কোনো কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি, ৯০ মিনিট সমাপ্তি হওয়ামাত্রই খেলা বন্ধ করে দেন তিনি।
তবে ব্যাটল অব সান্তিয়াগোর পর পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যায়। চিলির প্রায় সব জায়গায় ইতালিয়ানদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি ইতালিয়ান মিডিয়া রেফারি কেইন অ্যাস্টনকে ম্যাচ হারের জন্য দোষারোপ করতে শুরু করে। চিলিয়ানদের ‘ক্যানিবাল’ বলে আখ্যায়িত করা শুরু হয়। বিশ্বকাপে ইতালি গ্রুপ পর্বে বিদায় নিলেও চিলি শেষ পর্যন্ত তৃতীয় হয়, যা এখনো তাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্জন।
রেফারি কেইন অ্যাস্টন বীরত্বে সেদিন কোনো বড় আকারের সংঘাত সৃষ্টি হয়নি। তবে হাতাহাতি, মারামারি, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতাই বলে দেয় সেদিন স্টেডিয়ামে কতটা বাজে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সব ছাপিয়ে এটি হয়ে থাকবে ফুটবলের অন্যতম অন্ধকার অধ্যায় রূপেই।
ব্যাটল অব সান্তিয়াগোকে মানুষ মনে রাখবে ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত ম্যাচ হিসেবে।
Author: Syed Istiak Bashar
Poster: Samin Yasir Tanim