27/10/2022
গুরুপ্রসাদী প্রথা: বাঙালি হিন্দু সমাজের কলঙ্কিত অধ্যায়
-----লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত
হিন্দু সমাজের কুপ্রথা ও কুসংস্কার সমূহের কথা তো আমরা অনেক শুনেছি। কিন্তু কখনো কি গুরুপ্রসাদী নামক জঘন্য প্রথার কথা শুনেছি আমরা?
চরম ভাবাপন্ন হিন্দুসমাজে এই নীচ রীতি প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে, বিবাহের পর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে স্বামীর সহবাস করার আগে তাঁর গুরুর কাছে নিজের স্ত্রীকে নিবেদন করতে হত। 'গুরুর খাওয়া হয়ে গেলে তার প্রসাদ পেতেন শিষ্য'- এই ধারণা থেকেই এই বিধানের নাম হলো "গুরুপ্রসাদী"।।
গুরুপ্রসাদী প্রথার প্রামাণ্য বিবরণ ও এর ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র কালীপ্রসন্ন সিংহের "হুতুম প্যাচার নকশা" গ্রন্থে।
কাহিনীটি তুলে ধরা হলো :
পূর্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে বৈষ্ণবতন্ত্রের গুরুপ্রসাদী প্রথা প্রচলিত ছিল। নতুন বিয়ে হলে গুরুসেবা না করে স্বামীর স্ত্রীর সাথে সহবাস করবার অনুমতি ছিল না। বেতালপুরের রামেশ্বর চক্রবর্তী পাড়াগাঁ অঞ্চলে একজন বিশিষ্ট লোক ছিলেন। চক্রবর্তীর কেবলমাত্র ছিল একটি কন্যা। শহরের ব্রকভানু চক্রবর্তীর ছেলে হরহরি চক্রবর্তীর সাথে তার বিয়ে হয়।
শহুরে জামাইকে দেখার জন্য গ্রামের নানা দিক থেকে লোক আসতে লাগলো, সে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। এমন সময় মেয়ের পরিবারের লোকদের মনে পড়লো গুরুপ্রসাদী প্রথার কথা। তাই পঞ্জিকাতে ভালো একটি দিন দেখে গোঁসাইগুরুকে খবর পাঠানো হলো। গোঁসাইও খোল করতাল নিয়ে তার দলবলের সাথে আগমন করলেন।
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত শহুরে আধুনিক মনস্ক হরহরি গুরুপ্রসাদীর ব্যাপারে ব্যাপারে তেমন কিছু জানতেন না। কিন্তু তাঁর স্ত্রীকে নতুন কাপড়, আর প্রচুর গয়না পড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে এবং শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত দেখে তাঁর মনে সন্দেহ হলো । তিনি এক ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “ কিহে, আজকে বাড়িতে কিসের এত আয়োজন?” ছেলেটি বললো- “ জামাই বাবু, তুমি জানো না, আজ আমাদের গুরুপ্রসাদী হবে। “
গুরুপ্রসাদীর কথা শুনে বর হরহরি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। কীভাবে এই গুরুপ্রসাদী হতে তার স্ত্রীকে রক্ষা করা যায় তিনি তার উপায় ভাবতে লাগলেন। আর এর মধ্যে গোঁসাই বরের মত সেজেগুজে জামাইবাবুর ঘরে গিয়ে বিছানায় শুলেন। এরপর গুরুপ্রসাদীর জন্য হরহরি বাবুর স্ত্রীকে নানা রকমের অলঙ্কার পড়ে সেই ঘরে প্রবেশ করানো হলো।
হরহরিও গোঁসাইয়ের ঘরে ঢোকার আগেই বুদ্ধি করে একটি লাঠি নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন। হরহরি দেখলেন, তার স্ত্রী গোঁসাইকে প্রণাম করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। নিজের স্ত্রীর এই তীব্র কষ্টে হরহরির চোখ ফেটে পানি বের হতে লাগলো!
গুরু অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে মেয়েটিকে বিছানায় নিয়ে গেলেন। আর মেয়েটির বা কী করার- ‘বংশপরম্পরানুগত ধর্ম না মানা মহাপাপ’- এমন ধারণা তার মনে গেঁথে ছিল । তাই সেও আপত্তি করলো না। এবার গুরুদেব মেয়েটিকে স্পর্শ করে মেয়েটিকে বলতে বললেন- “আমি রাধা তুমি কৃষ্ণ”। মেয়েটিও গুরুদেবের কথামতো বললো,““আমি রাধা তুমি কৃষ্ণ”। মেয়েটি সবে তিনবার বলেছে- “আমি রাধা তুমি কৃষ্ণ” হরহরি বাবু আর থাকতে পারলেন না। খাটের নিচ থেকে উঠে এসে গুরুদেবের চরম ধোলাই শুরু করলেন। ধোলাই খেয়ে গুরুদেব সজোরে চিৎকার করতে থাকেন। গুরুপ্রসাদী করতে যাওয়ার আগে গুরুদেব তার শিষ্যদের বলে এসেছিলেন প্রসাদী সেড়ে উনি ‘হরিবোল’ বললে সবাই যেন খোল করতাল বাজায়। এখন গোঁসাইয়ের আর্তনাদকে ‘হরিবোল’ ভেবে শিষ্যরা খোল করতাল বাজাতে শুরু করলো, বাড়ির মেয়েরা উলু দিতে লাগলো। সবকিছুর শব্দে চারপাশে হুলস্থূল পড়ে গেল।
হরহরি বাবু দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। তাকে দেখে সবাই অবাক। সকলে ঘরে ঢুকে গুরুকে অচেতন, আহত অবস্থায় দেখতে পেলেন। আর হরহরি সোজা থানায় গেলেন।
“সেই থেকে গুরুপ্রসাদী প্রথা বন্ধ হয়ে গেল, লোকের চৈতন্য হল, গুরুদেবরাও ভয় পেল।”
আর এভাবেই না জানি কত শত নিরীহ নারীর সম্ভ্রম হৃত হয়েছে কুসংস্কারাচ্ছ বিভৎস জনসমাজটিতে। নারীদের ছিলো না কোনো সম্মান। ব্যবহার করা হতো পণ্যের ন্যায়। মজার ব্যাপার হলো- নিজের স্ত্রীর সম্ভ্রমই যাদের কাছে নিরাপদ ছিল না তারাই আজ মুসলিমদের প্রগতিশীলতা শেখাতে আসে!! মুসলিম শাসকদের সমালোচনা করে!
এরপরও কি আমরা গর্ব করে বলতে পারিনা যে- "আমি গর্বিত আমি মুসলিম?"
[সোর্স: 'হুতুম প্যাচার নকশা' - কালীপ্রসন্ন সিংহ]
--------------------------------------------------
লেখক : রাজিত তাহমীদ জিত
#মুসলমানদের_স্বর্ণকণিকা