22/07/2025
কিশোর কুমার: সুরের জাদুকর ও মানবিকতার প্রতীক
কিশোর কুমার, ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর কণ্ঠ আর ব্যক্তিত্ব আজও কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে অমলিন। তিনি শুধু একজন গায়কই ছিলেন না, ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ, যাঁর জীবন ছিল বহুমুখী প্রতিভা, রসবোধ আর অকৃত্রিম মানবিকতায় ভরা।
মহান হৃদয়ের পরিচয়: বিনা পারিশ্রমিকে গান
কিশোর কুমারের মহানুভবতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো এক গরিব প্রযোজক ফণী মজুমদারকে বিনা পারিশ্রমিকে গান গেয়ে দেওয়া। ফণী মজুমদার যখন তাঁর সিনেমা 'দূর গগন কি ছাঁও মে'-এর জন্য কিশোর কুমারের কাছে গান গাওয়ার অনুরোধ নিয়ে যান, তখন তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে তাঁর কাছে কিশোরদাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার মতো অর্থ নেই। কিশোর কুমার এই কথা শুনে হেসে বলেছিলেন, "তোমার সিনেমার গল্পটা ভালো লেগেছে। গান গেয়ে দিচ্ছি, কিন্তু একটাই শর্ত—যখন সিনেমা হিট হবে, তখন একটা ছোট্ট মিষ্টি কিনে আমাকে খাওয়াবে!"
তিনি কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই "আ চলকে তুঝে ম্যাঁয় লেকে চলুঁ" গানটি গেয়েছিলেন, যা সেই সিনেমার সবচেয়ে বড় হিট হয়েছিল। সিনেমা হিট হওয়ার পর, ফণী মজুমদার সত্যিই একটি মিষ্টির বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কিশোরদার কাছে। কিশোরদা সেই মিষ্টি খুশি মনে খেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, "এই হাসিটুকুই আমার পারিশ্রমিক।" এই ঘটনাটি তাঁর শিল্পীসত্তা এবং মানবিকতার এক অবিস্মরণীয় উদাহরণ।
বহুমুখী প্রতিভা ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর
কিশোর কুমার শুধু গায়ক হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী। তিনি একাধারে সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেছেন। তাঁর নিজের পরিচালিত চলচ্চিত্র "দূর গগন কি ছাঁও মে" (১৯৬৪) এবং "হালচাল" (১৯৯২) তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার প্রমাণ। তিনি এই সিনেমাগুলোতে শুধু অভিনয়ই করেননি, চিত্রনাট্য লেখা, গান রচনা এবং সঙ্গীত পরিচালনার কাজও করেছেন। এমন বহুমুখী প্রতিভা ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে বিরল।
রসবোধ ও খামখেয়ালী ব্যক্তিত্ব
কিশোর কুমারের রসবোধ ছিল কিংবদন্তীতুল্য। তাঁর জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা তাঁর মজার এবং কিছুটা খামখেয়ালী ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরে:
সায়ানাইড কাণ্ড: একবার তিনি তাঁর বাড়িতে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন যেখানে লেখা ছিল: "সায়ানাইড থেকে সাবধান!" এটি ছিল তাঁর নিজস্ব ঢঙে অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শকদের থেকে নিজেকে দূরে রাখার একটি উপায়, যা তাঁর রসিকতা এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক।
পারিশ্রমিক নিয়ে অদ্ভুত শর্ত: পারিশ্রমিক নিয়েও তাঁর ছিল নিজস্ব ধরন। একবার এক প্রযোজক তাঁকে অর্ধেক টাকা দিয়েছিলেন, যার প্রতিবাদে কিশোর কুমার মেকআপ রুম থেকে অর্ধেক গোঁফ কেটে সেট-এ আসেন এবং বলেন, "যখন পুরো টাকা দেবেন, তখন পুরো গোঁফ নিয়ে আসব!" এটি তাঁর পেশাদারিত্ব এবং নীতির প্রতি অগাধ সম্মানের পরিচায়ক।
গান গাওয়ার আগে অদ্ভুত অভ্যাস: শোনা যায়, তিনি স্টুডিওতে গান গাওয়ার আগে প্রায়শই তাঁর কলারের শার্ট ছিঁড়ে ফেলতেন। অনেকেই এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলতেন, "আর্টিস্টের রক্ত গরম হয়, তাই এমনটা করি!" এই আবেগপ্রবণতা তাঁর প্রতিটি গানে ফুটে উঠত, যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করত।
কিশোর কুমার ছিলেন এমন একজন শিল্পী যিনি শুধু সুরের মাধ্যমে নয়, তাঁর জীবনযাপন এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেও মানুষের মনে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন। এমন সুরের জাদুকর এবং মহান হৃদয়ের অধিকারী শিল্পী শতাব্দীতে একবারই জন্ম নেন।
------------------
📜 Copyright Notice:
This page's entire content is copyright protected © Mahmudul Hasan Jahid.
If you want to copy this text, please include the page's name.
Otherwise, please share it — this maintains respect and avoids copyright issues.