07/07/2025
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে, বারবার একতরফা ও অনিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে, শাসক দলের পতন ডেকে এনেছে এবং জনগণের বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই গণতন্ত্রে টিকে থাকার জন্য।
---
ভোট ও ভেঙে পড়া গণতন্ত্র: স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থার পর্যালোচনা
স্বাধীনতা পূর্ব ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। সে নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও, কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলেই শুরু হয় রাজনৈতিক সংঘাত, যার পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে। বহু ত্যাগ ও প্রাণহানির বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
কিন্তু এই স্বপ্নের স্বাধীন দেশটির প্রথম জাতীয় নির্বাচনই—১৯৭৩ সালের নির্বাচন—একটি প্রশ্নবিদ্ধ একতরফা নির্বাচনে পরিণত হয়। এতে অংশ নেয়নি অনেক রাজনৈতিক দল। মুক্তিযোদ্ধা ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের একাংশের মধ্যে তখন থেকেই একধরনের হতাশা দানা বাঁধে।
এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সামরিক প্রভাবের যুগ। ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় একটি 'হ্যাঁ/না' গণভোট, যার মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু রাজনৈতিক অন্তঃকলহ ও দুর্বল গণতন্ত্রের কারণে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১৯৮১ সালে। এরপর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, যিনি ১৯৮৫ সালে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই প্রহসনের নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৯০ সালে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে তার পতন ঘটে।
এভাবেই ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। ক্ষমতায় আসে বিএনপি। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে—তরুণ গণতন্ত্র আবারও হুমকির মুখে পড়ে। ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে আবারও নির্বাচন দিতে হয়। সেই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে।
২০০১ সালে বিএনপির পুনঃঅভ্যুত্থান ঘটে। কিন্তু শাসনকাল শেষে ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন পরিস্থিতি প্রমাণ করে, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য কতটা বিপজ্জনক। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শুরু হয় ‘দুই নেত্রীকে মাইনাস’ করার চেষ্টা।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের আস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগ বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয় অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা নিয়ে। একতরফা নির্বাচনের ধারাবাহিকতা ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকে, যেখানে বহু আসনে প্রার্থী পর্যন্ত ছিল না। এতে জনগণের আস্থা আরও হ্রাস পায়, যা পরিণত হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থায়।
যে রাজনৈতিক দলই হোক না কেন—আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি হোক কিংবা ভবিষ্যতের অন্য কোনো শক্তি—নির্বাচনী ব্যবস্থা কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা করলে পরিণতি হবে ধ্বংসাত্মক। গণতন্ত্রের ধারায় টিকে থাকতে হলে চাই জনগণের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
গণতন্ত্রের শিক্ষা নিতে হলে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোই যথেষ্ট। তা না হলে, ভবিষ্যতও হবে অতীতেরই প্রতিচ্ছবি।
লেখাটি ভাল লাগলে শেয়ার করে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দেবেন।
News of Sylhet