08/08/2024
"এই দেশ তোমাদের, এটাকে তোমরা তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলবে" - ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস তরুণ সমাজের উদ্দেশ্যে বলেছেন, "এই দেশ তোমাদের, এটাকে তোমরা তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলবে।" দেশে ফিরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এ কথা বলেন। এসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন।
ড. ইউনূস বলেন, "আজকে আমাদের গৌরবের দিন। যে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ নতুন বিজয় দিবস সৃষ্টি করল, সেটাকে সামনে রেখে এবং আরও মজবুত করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।"
তিনি তরুণ সমাজের প্রতি তার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, "যারা এটাকে সম্ভব করেছে—তরুণ সমাজ—তাদের প্রতি আমি আমার সমস্ত প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা আমার পাশে আছে। তারা এ দেশকে রক্ষা করেছে, এ দেশকে পুনর্জন্ম দিয়েছে এবং এ পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশকে পেলাম, সে বাংলাদেশ যেন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পারে, সেটাই আমাদের শপথ। সেটা আমরা রক্ষা করতে চাই।"
ড. ইউনূস আরও বলেন, "আজকে আবু সাঈদের কথা মনে পড়ছে আমাদের। যে আবু সাঈদের ছবি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। কী অবিশ্বাস্য এক সাহসী যুবক! বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর থেকে আর কোনো যুবক-যুবতী হার মানেনি, সামনে এগিয়ে গেছে। তারা বলেছে, যত গুলি মারো মারতে পারো, আমরা আছি। যার কারণে এই আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেছে এবং বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করেছে।"
"এই স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতেই হবে," বলেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, "শুধু স্বাধীনতা রক্ষা করা নয়, এই স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছাতে হবে। তা না হলে এই স্বাধীনতার কোনো দাম নেই। এই স্বাধীনতা প্রতিটি ঘরে পৌঁছানোই আমাদের প্রতিজ্ঞা।"
ড. ইউনূস আরও বলেন, "মানুষ যেন জানে, যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ হলো তার নিজের পরিবর্তন, ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, সুযোগের পরিবর্তন, তার ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের পরিবর্তন।"
তরুণ প্রজন্মকে তিনি বলেন, "আজকের তরুণ সমাজকে এটা বোঝানো যে এই দেশ তোমাদের। এটাকে তোমরা তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলবে। তোমরা যেহেতু স্বাধীন করতে পেরেছ, তোমরা এটাকে তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলতেও পারবে। তোমাদের দেখে সারা দুনিয়া শিখবে যে কীভাবে একটা দেশকে তরুণ সমাজ গ্রহণ করতে পারে এবং পাল্টে ফেলতে পারে।"
তিনি বলেন, "আমি বারেবারে উপদেশ দিই, পুরোনোদের বাদ দাও। পুরোনোদের চিন্তা দিয়ে কিছু হবে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দুনিয়ার কথা বলছি। তোমাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, সৃজনশীলতা আছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। শুধু বইখাতাতে লেখার জিনিস না, সেটা প্রকাশ করার জিনিস।"
ড. ইউনূস বলেন, "আজকে আমাদের দায়িত্ব হলো, যেটা তারা অর্জন করে নিয়ে এসেছে সেটা এখন তাদেরকে দিয়ে করিয়ে দেওয়া। সরকার বলতে একটা জিনিস আছে, কিন্তু মানুষের কোনো আস্থা নেই। মানুষ মনে করে, সরকার হচ্ছে একটা দমনপীড়নের যন্ত্র। এটা একটা ভয়ের জিনিস, যাকে সামাল দিয়ে চলতে হবে। এটা সরকার হতে পারে না। সরকারকে দেখে মানুষের বুক ফুলে উঠবে। মনে করতে হবে সরকার আমাকে রক্ষা করবে, সহযোগিতা করবে, আমার সরকার আমার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু সরকার কারো জন্য পাশে দাঁড়ায় না কোনো সময়।"
তিনি আরও বলেন, "এখন যে সরকার হবে, সে সরকার মানুষকে রক্ষা করবে, আস্থাভাজন হবে। তোড়জোর করে তাকে ভালো বলাতে হবে না। সে নিজে নিজে বিশ্বাস করবে যে সরকার ভালো, সরকারি লোক দেখলে বলবে যে এ আমার লোক, আমাকে রক্ষা করার লোক। সেই আস্থাটা আমাদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে মানুষের মধ্যে। তাহলে মানুষও যোগ দেবে এর মধ্যে।"
দেশের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, "সারা বাংলাদেশ একটা পরিবার। এই পরিবার আমরা একসঙ্গে চলতে চাই। আমাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব যা কিছু আছে, সরিয়ে ফেলতে চাই। যারা বিপথে গেছে, তাদেরকে পথে আনতে চাই, যাতে করে একসঙ্গে আমরা কাজ করতে পারি।"
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, "এর মধ্যে আসার পথে শুনলাম, এখানে আইনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত হচ্ছে। মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, সম্পদ জ্বালিয়ে নষ্ট করছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে, অফিস-আদালতে আক্রমণ করছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আহমাদিয়া সবার ওপর আক্রমণ করছে। এগুলো ষড়যন্ত্রের অংশ। এগুলো আমাদের বিষয় না।"
ড. ইউনূস বলেন, "আমাদের কাজ হলো সবাইকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, আমাদের বোন, তাদের রক্ষা করা এবং আমাদের একটা শৃঙ্খলায় ফিরে আসা উচিত। এগুলো হলো অগ্রগতির সবচেয়ে বড় শত্রু। আমাদের যে যাত্রা শুরু হলো, সে যাত্রার শত্রু। কাজেই এই শত্রুকে যাতে রোধ করা যায়, তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে হোক, তাদের আইনশৃঙ্খলার হাতে দিয়ে হোক, এটা মনে রাখতে হবে। তাদের মেরে ফেলা ঠিক না। আইনশৃঙ্খলা নিজের হাতে নেওয়া ঠিক না। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন হতে হবে, তাদের হাতে সোপর্দ করতে হবে, এতে আমরা নিশ্চিত থাকব যে, এর একটা বিহিত হবে। এমন হলো আমরা দিয়ে দিলাম, তারা টাকা নিয়ে ছেড়ে দিলো, এটা যেন না হয়।"
তিনি বলেন, "আপনারা আমার ওপর আস্থা রেখে আমাকে আহ্বান জানিয়েছেন, ছাত্ররা আহ্বান জানিয়েছে। সেটাতে আমি সাড়া দিয়েছি। দেশবাসীর কাছে আমার আবেদন, আপনারা যদি আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, তাহলে নিশ্চিত করেন যে দেশে কোনো জায়গায় কারও ওপর কোনো হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব। এটা যদি আমি করতে না পারি, আমার কথা যদি না শোনেন আপনারা, তাহলে আমার কোনো প্রয়োজন এখানে নেই। আমাকে বিদায় দেন, আমি আমার কাজে থাকি। সেটা নিয়েই আমি ব্যস্ত থাকি। আর যদি আমাকে প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে এটা দেখাতে হবে যে আমার কথা আপনারা শোনেন। আমার কথা না শুনলে মনে করব আমার কোনো প্রয়োজন নেই।"
তিনি আরও বলেন, "আমার প্রথম কথা হলো, আপনারা এই বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করেন। আপনারা সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করেন, যাতে আমরা আমাদের ছাত্রদের দেখানো পথে এগিয়ে যেতে পারি।"
ড. ইউনূস বলেন, "বাংলাদেশ একটু খুব সুন্দর দেশ হতে পারে। এটা খুবই সম্ভাবনাময় দেশ। এই সম্ভাবনাকে আমরা নষ্ট করে দিচ্ছে। এখন আবার সেই বীজতলা তৈরি করতে হবে। আবার আমাদের জেগে উঠতে হবে। ছাত্ররা এই বীজতলা তৈরি করবে। তাদের হাত দিয়েই হবে এবং তাদের দিকেই আমরা তাকাব।"
তিনি বলেন, "এখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন, সেনা বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনীর প্রধানরা যারা আছেন—তাদের প্রতিও অনুরোধ, আমরা একটা পরিবার। এই পরিবারের মধ্যে যেন কোনো গোলোযোগ না হয়। আমরা যেন একযোগে, একসঙ্গে চলতে পারি এবং তড়িৎগতিতে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে পারি।"
"আপনাদের সবার কাছে আমার আবেদন, আমাদেরকে সেই সুযোগ দিন।"