05/06/2023
(আরো একটি শোক সংবাদ)
মানুষটা আমার কাজের এখানে প্রায়ই আসতেন, প্রতিদিন লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। আমি ঠিক সেভাবে চিনতাম না বলে খুব বেশী ঘনিষ্ঠ হতাম না। কে না কে, কই থাকে, কি করে কিছু জানি না, শুধুমাত্র বাঙ্গালি বলে গল্প করতে চান ভেবে একটু অস্থির লাগতো। একদিন বসকে ফোনে বললাম, "এখানে একজন বাঙালি ভদ্রলোক আসেন, প্রায়ই অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকেন। এনাকে চেনেন?" তিনি বললেন, "ফটো তুলে পাঠান তো।" পাঠালাম(এই সেই ফটো)। তিনি ফটো দেখে বললেন, "ওহ! উনি আশেপাশেই কাজ করেন। নিরীহ ভদ্রলোক, ভালো মানুষ।" তখন মাঝে মাঝে গল্প করতাম একটু আকটু। পর্তুগালের পেপার করার জন্য এপর্যন্ত ১২০০০ ইউরো খরচ করেছেন, তীর্থের কাকের মতন অপেক্ষা করছেন কবে পেপার হবে, কবে দেশে যাবেন। একটা মানুষ কী পরিমান সহজ সরল হলে পর্তুগালে পেপার করার জন্য দালালকে ১২০০০ ইউরো দিতে পারেন সেটা এখানে যারা আছেন ধারণা করতে পারেন।
কয়েকদিন আগে তার এক কলিগ আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, চৌধুরী ভাইকে দেখেছি কি না গেলো কয়েকদিনে, আমি সেদিনই জানলাম ভদ্রলোকের নাম চৌধুরী। মনে মনে অবাক হলাম কারণ আসলেই তার দেখা পাই নি গত দিন চারেক। তার কলিগের কাছ থেকে শুনলাম যে, গত ১ সপ্তাহ ধরে তার কোন খবর নেই, দেশে ও বিদেশে কারো সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি তার। পেপার নেই উনার, পুলিশ টুলিশ ধরে নিয়ে গেলো কিনা, দুশ্চিন্তার ব্যাপার। তিনি পর্তুগালও যান নি, সেখানেও কারো সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। আশেপাশে কথা বলে যা বুঝলাম যে, যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাহলে কিছুদিন পরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা। তো আর কী করা যায় অপেক্ষা ছাড়া।
আজ কিছুক্ষণ আগে, আমাদের এখানে এক বিদেশী ভদ্রলোক আমার কাছে এসে খবর দিয়ে গেলো যে, তোদের দেশী ভাই চৌধুরী মারা গেছেন গত দুই সপ্তাহ আগে। আফ্রিকান কিছু দুষ্কৃতিকারী এই ট্রেন স্টেশনের পাশে তাকে প্রচুর মারধোর করে মেরে ফেলে রেখে গেছে। এত মেরেছে যে সে সাথে সাথেই মারা গেছে। তার গায়ে হাতে পায়ে মুখে প্রচুর জখম। পুলিশ যেদিন এই ঘটনা ঘটেছে তার পরদিন সকালেই লাশ উদ্ধার করে মর্গে নিয়ে যায়। তার লাশ এখনো মর্গেই আছে। আজ পুলিশ তদন্ত করতে এসে ঘটনাস্থলের আশেপাশে মানুষদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে, সেই সুবাদেই সবাই জানতে পেরেছে। তার পরিবারের মানুষদের কিছুক্ষণ পর জানানো হবে। লাশটা এখানে তার পরিচিত মানুষজন গিয়ে নিয়ে আসবে। সব হবে, দাফন হবে, কাফন হবে, সবাই মিলে হয়তো একটা ব্যবস্থা করে তাকে দেশেও পাঠানো হবে শেষবারের মত।
শুধু একটা প্রশ্নেরই উত্তর কেউ জানিনা, এর বিচার কবে হবে? এই যে, এইসব সন্ত্রাসী হামলায় প্রতি বছরই একজন দুইজন বাংলাদেশি মানুষ হারাচ্ছি আমরা, এর শেষটা কোথায়? প্রায় বছর খানেক পেরিয়ে গেলো এক বাংলাদেশী ভাইয়ের অপমৃত্যুর জন্য সবাই মিছিলে নেমেছিলো, আর কয়বার এমন মিছিল নামলে এই অন্যায় বন্ধ হবে? জানি না, এসব ভাবার জন্য যেটুকু মানসিক শক্তি দরকার এই মূহুর্তে তা নাই আমার। এই মানুষটা রোজ আসতো, আর আসবেন না, এটাই ভাবি। এতগুলো দিন আসা যাওয়া করতে রোজ তাকে দেখেছি, এখানে এসে সময় কাটাতেন, খবর জানতে চাইতেন, আর দেখবো না, কারণ কিছু মানুষ তাকে নৃশংসভাবে মেরে রেখে গেছে, এটুকু মানতে পারছিনা। আমার এতটা কাছে দাঁড়িয়ে মানুষটা কথা বলতেন, ভাবলে বিষন্ন লাগে।
নিয়তি কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে ভেবে দেখুন, আজকে সকালেই ভদ্রলোকের নোটিফিকেশন মেইল এসেছে যে, তার পর্তুগালের পেপার হয়েছে, তিনি এখন লিগ্যালি দেশে যেতে পারবেন।
চৌধুরী ভাইকে আর কেউ আটকাতে পারবে না, তিনি এখন ঘরে ফিরবেন।
লিখেছেন -------
ইমতিয়াজ আহমেদ রনি
Imtiaz Ronnie