07/08/2025
"সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড: দায়হীন নিন্দা-
প্রতিবাদের সংস্কৃতি ও সংগঠনগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা"
বাংলাদেশে সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন—কারও কারও ভাগ্যে জুটেছে প্রাণ হারানোর নির্মম পরিণতিও। অথচ এসব ঘটনায় সাংবাদিক সংগঠনগুলোর এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভূমিকা দিনে দিনে আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।
সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং হামলার পর বিচার দাবিতে সোচ্চার হওয়া যেসব সংগঠনের নৈতিক ও সাংগঠনিক দায়িত্ব—তাদের অনেকেই আজ মুখে প্রতিবাদ করে, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। বিবৃতি নির্ভর এই প্রতিবাদ আন্দোলন কার্যত 'নিন্দার আনুষ্ঠানিকতা'তে পরিণত হয়েছে।
ফেসবুক কেন্দ্রিক প্রতিবাদ: দায়সারা আচরণঃ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, কোনো সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা দ্রুত ফেসবুকে "তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ" জানিয়ে স্ট্যাটাস দেন, কিন্তু বাস্তব কোনো আন্দোলন, অনুসন্ধান, বা আইনি সহায়তা দিতে তেমন একটা দেখা যায় না। যেন প্রতিবাদের দায়িত্ব কেবল মাত্র ভার্চুয়াল মাধ্যমে 'সম্পন্ন' করা হচ্ছে।
এধরনের আচরণ সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের বিরুদ্ধে যায়। একটি পেশাদার সংগঠনের প্রধানের ভূমিকা শুধু ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়াতে সীমাবদ্ধ থাকলে, প্রশ্ন উঠবে সংগঠনের কার্যকারিতা নিয়েই।
মানবাধিকার সংস্থার নীরবতাঃ
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়েও অসন্তোষ বাড়ছে। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা যখন ঘটে, তখন কিছু সংস্থা গৎবাঁধা বিবৃতি দেয়, তারপর তাদেরও আর দেখা যায় না। অথচ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে গুরুতর উদাহরণগুলোর একটি হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত—যা সাংবাদিকদের ওপর হামলা বা হয়রানির মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
এই ধরনের ঘটনায় সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা জনমনে প্রশ্ন তোলে—তাদের মানবাধিকারের মাপকাঠি কি নির্বাচিত ও সুবিধাভিত্তিক? নাকি সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় তারা আদৌ আগ্রহী নয়?
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এ ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান শুধু গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য হতাশাজনক নয়, বরং পুরো মানবাধিকার আন্দোলনকেই দুর্বল করে দেয়। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ বিশ্বাস হারাবে—এবং যখন একজন সাংবাদিক প্রাণ হারাবে, তখন তা আর শুধু একজনের মৃত্যু থাকবে না, সেটি হবে সমাজের বাক-স্বাধীনতার একটি কোণা ছিন্ন হওয়ার ঘটনা।
রাজনৈতিক বিভাজনে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর অকার্যকারিতাঃ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে যে রাজনৈতিক বিভাজন রয়েছে, তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। একই ঘটনার পর এক অংশ প্রতিবাদ করে, অন্য অংশ তা এড়িয়ে যায়—বা কখনো কখনো উল্টো অবস্থান নেয়।
এই অভ্যন্তরীণ বিভাজনের ফলে সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষা নয়, বরং নিজেদের অবস্থান ও পরিচয় টিকিয়ে রাখাই যেন হয়ে উঠেছে সংগঠনগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলে সাংবাদিকদের ওপর বারবার আক্রমণ হলেও, তার কোনো জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না।
এই পরিস্থিতি সাংবাদিক সমাজের জন্য চরম হতাশাজনক। সংগঠনগুলো যদি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ভুলে এক হয়ে না দাঁড়ায়, তবে সাংবাদিক নির্যাতনের অবসান আসবে না—বরং তা আরও বৈধতা পাবে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় দায়ঃ
অধিকাংশ সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার হয় না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা—কখনো কখনো তারা বরং আরও ক্ষমতাবান হয়ে উঠে।
এই বিচারহীনতা হামলাকারীদের সাহসী করে তোলে। তারা জানে, ‘কিছু হবে না’। আর সংগঠনগুলো যদি কেবল বিবৃতি দিয়ে দায় শেষ করে, তাহলে এই পরিবেশ কখনো বদলাবে না।
রাষ্ট্রের দায়িত্বও এখানে অস্বীকারযোগ্য নয়। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, হামলার ঘটনার তদন্ত করা, ও বিচার নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু দেখা যায়, রাষ্ট্র অনেক সময় নিরব থাকে কিংবা মিথ্যা মামলা বা হয়রানির মাধ্যমে উল্টো সাংবাদিকদেরই কোণঠাসা করে তোলে।
করণীয়ঃ
বর্তমান বাস্তবতায় কেবল নিন্দা নয়, চাই প্রতিষ্ঠানগত প্রতিরোধ ও বাস্তব পদক্ষেপ।
১. সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে নিজেদের ভেতরের বিভাজন দূর করে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
২. নির্যাতিত সাংবাদিক বা পরিবারকে অর্থনৈতিক, আইনি ও মানসিক সহায়তা দিতে একটি নির্ভরযোগ্য তহবিল গঠন করা জরুরি।
৩. মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে মুখস্ত বিবৃতির বদলে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
৪. প্রতিটি হামলার ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান ও সঠিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রাষ্ট্রকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যেন বিচার হয়।
৫. আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশের বাস্তবতা তুলে ধরা দরকার।
সাংবাদিকদের ওপর প্রতিনিয়ত হামলা হচ্ছে, তাদের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা চলছে—এটা নিছক পেশাগত সমস্যা নয়, এটা একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর সরাসরি আঘাত।
এই আঘাত প্রতিবারই যদি বিবৃতি ও ফেসবুক পোস্টে শেষ হয়ে যায়, তাহলে প্রশ্ন উঠবেই—সাংবাদিক সংগঠনগুলো আর কিসের জন্য?
এখন সময় এসেছে মুখস্থ প্রতিবাদের এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে বাস্তব, সংগঠিত ও সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার। তা না হলে সাংবাদিকদের পাশাপাশি হারিয়ে যাবে সমাজের বিবেক, তথ্যের স্বাধীনতা এবং জনগণের জানার অধিকার।