26/07/2025
কে এই নুরুল আমিন। আমরা তাকে অনেকেই চিনি বা জানি। তার সংক্ষিপ্ত জীবনী বর্ণনা করা হলো:
বহুদিন পূর্বে তার পূর্ব পুরুষগণ সুদুর ভারতের আসাম রাজ্যে বসতী স্থাপন করেছিলেন। সেখান থেকে পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের রসুলপুরের ঢলুয়াতে পরিবার পরিজন নিয়ে বসতী স্থাপন করেন তার পিতা আঃ জলিল, চাচা আঃ করিম ও রহিম উদ্দিন। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৪ সালের ১০ মে এই ঢলুয়াতেই তিনি জন্ম গ্রহন করেন। তিনি যখন ৪থ শ্রেণির ছাত্র তখন তার বাবা মারা যায়। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে তাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। এর মাঝেই তার চাচা রহিম উদ্দিন কড়ই আটার বিখ্যাত সাপের উঝা হযরত আলীর নিকট সাপের বিষ ঝাড়ানো মন্ত্র শিখে। এবং এলাকায় ঐতিহ্যবাহী বেহুলা গানের সূত্রপাত ঘটায়। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে নুরুল আমিন কে বেহুলা সাজিয়ে বাড়ি বাড়ি গান করে ডালা ভাসানো শুরু করে। এই থেকেই নুরুল আমিন বেহুলা গানে জড়িয়ে পড়েন। তার গানের তাল লয় সুর ও নাচের বাচন ভংগি দেখে একটি গানের দলের ম্যানেজার তাকে আহবান করেন তাদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য। তাই সে আশ্রা সাধক মেম্বারের রুপবান যাত্রা গানের দলে যোগদান করেন। এবং সেই রুপবান গানের দলে রুপবানের অভিনয় করে খুব সুনাম অর্জন করেন। সেখানেই তিনি পাচ বছর থেকে যান। পাচ বছরের মাঝে তিনি সংসারের কোন খোজ খবর নেন নাই। শুধু গান নিয়ে পড়ে থাকতেন। সাধক মেম্বারের গানের দল বিলুপ্ত হলে তিনি আবার গ্রামে ফিরে এসে সংসারে মনযোগ দেন।
এরপর নুরুল আমিন অনেক নাটক থিয়েটারে যাত্রা গানে নায়িকার অভিনয় করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। রাম যাত্রা গানে সীতা হরণ পালায় সীতার অভিনয় করে এবং রাজা হরিশ্চন্দ্র যাত্রা পালায় বামা ঠাকুরের অভিনয় করে অনেক পুরস্কার লাভ করেন। এলাকার ছোট ও যুবক ছেলেদের নিয়ে বেহুলা গানের দল গঠন করেন। ততকালীন সময়ে ঢোল,বাশি, হারমোনিয়ামের কোনো প্রচলন ছিলো না। শুধু চটক তায়া ও খোঞ্জন বাজিয়ে পাড়ার এ বাড়ির ও বাড়ির উঠান আংগিনায় বেহুলা গান গাইতেন। তখন থেকেই তার বেহুলা গানের দল প্রকাশ হতে থাকে।
পাশাপাশি তিনি বাড়ীর পাশে পীর ক্যাবলা মুর্শিদ চান মরহুম হাফিজ উদ্দিন ব্যাপারীর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। তখন থেকে তিনি বিভিন্ন বৈঠকী গান শিখেন এবং ফকিরা বৈঠকে গান পরিবেশন করেন। কত সহস্র ফকিরা বৈঠক করেছেন তার কোনো হিসাব নিকাশ আমাদের নিকট নেই। এর থেকেই তিনি ফকির উপাধি লাভ করেন। এবং অনেকে তাকে ফকির নুরুল আমিন বলে ডাকতে শুরু করে।
তিনি একসময় ফকিরা গান গাইতে গাইতে বাউল শিল্পী বনে যান। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বায়না করে বাউল গান করতেন। এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সংগে কীর্তন পরিবেশন করতেন। পাশাপাশি তিনি কোরআন ও হাদীস শরীফ সম্পর্কে অনেক জানাশোনা ছিলেন। তিনি অনেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোরআন শরীফ শিক্ষা দিতেন।
এরপর তিনি চাচা রহিম উদ্দিন এর কাছ থেকে ওঝা বিদ্যা অর্জন করেন। শুধু তাই নয় দাদা ওস্তাদ কড়ই আটার হযরত আলীর থেকেও সাপের বিষ নামানো শিখে। পাশাপাশি নিজ গ্রামের মুন্সী শুকুর মাহমুদ থেকেও অনেক মন্ত্র ও কবিরাজী শিক্ষা গ্রহন করেন।
এরপর ধলাপাড়ার বিখ্যাত আরেক ওঝা রামরুপ থেকেও তিনি সাপধরা এবং সাপের বিষ নামানো মন্ত্র শিখে। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের শেষ দিন নৌকা নিয়ে বেহুলা গান গাইতে রামরুপের বাড়ী যাইতেন এবং নদীতে ডালা ভাসাতেন।
ততকালীন সময়ে গ্রামে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ছিলো না। তাই, তিনি সাপের বিষ নামানো মন্ত্র শিখে মানুষকে সাপে কামড় দিলে তা বিনামূল্যে ঝেরে নামাতো এবং আল্লাহর রহমতে মানুষ সুস্থ হয়ে উঠতো।
তিনি বিভিন্ন দল থেকে বিভিন্ন রকমের বেহুলা গান সংগ্রহ করতেন এবং তিনি বহু রকমের বেহুলা গান মুখস্ত করেছেন ও নিজে রচনা করেছেন। বর্তমানে অনেক বেহুলা গানের দল এ সমস্ত গান জানেই না।
তার কিছুদিন পর, মতি মেলেটারীর পরিচালনায় বেহুলা দল আবার সংগঠিত হয়। এবং নুরুল আমিন বেহুলার অভিনয় করে বহু সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করে। তার মতো নাচের বাচন ভংগি এখন পর্যন্ত কোনো দলের কোনো বেহুলার হয় না। এবং ভবিষ্যতে হবে কিনা তাও আমাদের জানা নেই। সেই দল ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে।
অনেকদিন পর ওস্তাদ নুরুল আমিন ও আরফান ম্যানেজারের উদ্যোগে পুনরায় বেহুলা গানের দল সংগঠিত হতে থাকে। ভুট্টু মেম্বার সাহেব কে সভাপতি করে ধলপুর গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম রাউন্ডে খুব সুনাম অর্জন করে আসে।
২য় দফায় যখন গানের আসর করে তখন শালিকা রসুলপুর হতে বেশ কিছু সংস্কৃতিমনা লোক বেহুলা গানের দলে যোগদান করে।
ততকালীন সময়ে ডাঃ হাফিজ উদ্দিন এর পরিচালনায় এই গানের দল আরো একধাপ এগিয়ে যায়। এই গানের দল কে আরো দুইধাপ উপরে উঠার জন্য ফজলুর রহমান তালুকদারের মাথায় এমন এক বুদ্ধি আসলো যে আমরা সর্বপ্রথম যাত্রা স্টেজের মতো মঞ্চ করে গান পরিবেশন করবো। এবং তার খরচ আমরা বহন করবো। তার পরামর্শ অনুযায়ী সর্ব প্রথম বেহুলা গান মঞ্চে পরিবেশন হলো। সেই প্রতিযোগিতায় টাংগাইল জেলার ২২ টি দলের শালিকা রসুলপুর দল প্রথম স্থান অধিকার করলো এবং পুরস্কার এনে শিরোপা জয় করলো। ইহাতেই নুরুল আমিন ওঝার সারাজীবনের সাধনা সার্থক হলো। ফজলুর রহমান তালুকদারের কারিগরি নির্দেশনায় যে মঞ্চ হয়েছিলো সেই থেকে সারা বাংলায় বেহুলা গান এখন আর মাটিতে হয় না। সেই তালুকদারের মঞ্চ এখন সকল দলের বেহুলা গান মঞ্চে পরিবেশন হয়। তিনি যে মডেল করেছিলেন সেই মডেলেই চলছে এই লোকসংগীত বেহুলা গান। বেহুলা গান আসলে লোকসংগীত। অঞ্চল ভেদে একে ভাষান যাত্রা বলে থাকে।
পরিশেষে ওঝা নুরুল আমিন ফকির তার জীবদ্দশায় প্রতিবছর বাংলা সনের শ্রাবণ মাসের শেষ দিন তার বাড়িতে বেহুলা গানের আসর জমাতো। এবং আমৃত্যু তিনি মানবসেবা করে গেছেন। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ডায়াবেটিস নামের দুরারোগ্য ব্যাধিতে ১ লা জুন, ২০১৭ সালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। গ্রামের হিন্দু মুসলিম সকলে মিলে তার অন্তিম যাত্রায় শরীক হয়। তিনি মৃত্যুর আগে তার ছোট ছেলে রুহুল আমিন কে অনেক কিছু শিখিয়ে যান। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে রুহুল আমিন প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের শেষদিন তার বাড়িতে বেহুলা গানের আয়োজন করে এবং মনসার ডালা ভাষায়।
ওঝা নুরুল আমিনের জীবনে অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি এই গান ছাড়েন নাই। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষায় এই গান কে উজ্জীবিত রেখেছিলেন। পাশাপাশি তিনি তার বিদ্যার দ্বারা আল্লাহর রহমতে অনেক মানুষের জীবন সংশয় দূর করেন। তার অনেক বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী বর্তমানে রয়েছে। আপনারা সকলেই তার জন্য দোয়া করবেন। তার বিদেহী আত্মা যেনো বেহেশত বাসী হয়।