29/06/2025
গল্প নাম: “দশ বছরের আকাশ, সাত মাসের পাথর”
লেখক: মোঃ জাহিদুল ইসলাম
রিয়াদ শহরের গ্রীষ্ম তখন বেশ চড়া। দুপুরের রোদে দোকানের বাইরে গরম বাতাস যেন আগুনের হলকা ছুড়ে মারছে। শহরের এক কোণে ছোট্ট একটি রেস্টুরেন্টে আমি, রফিক ভাই, কাজ করি প্রায় দশ বছর ধরে। একঘেয়ে হলেও জীবনের ছন্দটা এভাবেই কেটে যাচ্ছিল।
সেই দুপুরেই ঘটল ঘটনাটা। রেস্টুরেন্টের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ডেলিভারি ড্রাইভারের চোখে আমি দেখলাম ক্লান্তি, হতাশা আর একটা অদ্ভুত শূন্যতা। সে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখল, বলল,
“ভাই, আপনি কি বাংলাদেশি? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক কষ্টের মধ্যে আছেন।”
আমি একটু হেসে বললাম,
“হ, ভাইজান, ১০ বছর হইল এই দেশে। বাঁচা-মরার মতোই চলতেছি।”
ড্রাইভার ছেলেটার নাম ছিল মারুফ। জানাল, সে মাত্র সাত মাস হলো সৌদি এসেছে। এখনো কোনো আইডি কার্ড, আকামা কিছু পায়নি। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তাহলে দেশে যাবেন কিভাবে?”
উত্তরে বলল,
“শুনছি মক্কায় পুলিশ ধরে দেশে পাঠায় দিতেছে। ভাবতেছি ওদিকেই যামু। ধরা পড়লেই দেশে যেতে পারমু।”
পাবনা জেলার ছেলে সে। দেশে মা আছে, স্ত্রী আছে। এসেছিল স্বপ্ন নিয়ে—বাবার ঋণ শোধ করবে, ঘরের মেরামত করবে, ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাবে। কিন্তু আজ সে বিদেশের মাটিতে শূন্য হাতে, কাগজপত্র ছাড়া, ভবিষ্যত্হীন এক যাত্রায় আটকে আছে।
আমি বললাম,
“যে দালাল তোকে পাঠাইছে, তারে কিছু কস নাই?”
লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল,
“ভাই, বলার সুযোগ নাই। আত্মীয়ের আত্মীয়। ভাইয়ের শ্বশুরের কাছের মানুষ। বলল ঢাকা অফিসে সমস্যা হইছে।”
জানলাম, সে এক গ্রুপে ৫৭ জনসহ এসেছে। সবাই একই অবস্থা—কেউ চাকরি পায়নি, কেউ আকামা পায়নি। এজেন্সি নাকি তাদের সৌদি পাঠিয়েই দায়মুক্ত হয়ে গেছে।
সেদিন অনেকক্ষণ আমরা দুজনে বসে ছিলাম। আমার ১০ বছরের পথ আর ওর সাত মাসের যুদ্ধ এক অদ্ভুত মিল তৈরি করল। দুজনেই যেন ভিন্ন দুই ধারার ট্র্যাজেডির ভাগীদার।
বিদেশে এসে মানুষ শুধু টাকা রোজগারের যন্ত্র না—তারা মানুষ, যাদের আশা আছে, পরিবার আছে, স্বপ্ন আছে। কিন্তু দালাল আর দুর্নীতির জালে তারা অনেকেই জীবনের শুরুতেই হেরে যায়।
আমি এই লেখার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, বিশেষ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রতিটি রেমিট্যান্স পাঠানো মানুষের পেছনে একটি গল্প থাকে, একটি সংগ্রাম থাকে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা শুধু সরকারের দায়িত্বই নয়, এটি একটি মানবিক দায়।
আমরা চাই—প্রতারণা বন্ধ হোক, দালালচক্রের বিচার হোক, এবং প্রতিটি প্রবাসী যেন নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে দেশের নাম উজ্জ্বল করে কাজ করতে পারে। কারণ আমরা সবাই মানুষ, আর মানুষের কষ্টের গল্প কখনো যেন অদৃশ্য না হয়।
⸻
শেষ কথা:
এই গল্পটা শুধুই মারুফের না। এটা হাজারো মারুফের, যারা এখনো পথে। আজও যারা “দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছি” বলেই বাঁচার আশা রাখে।
⸻