21/03/2025
১৯৯৭ এর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটের খোঁজ খবর কতটা রেখেছি মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, বাজারে নিখিল দর্জির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমি তখন হাফ প্যান্ট পরা ছোট্ট বালক। বড় বড় মানুষের পেছনে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকি, তখন লং অন, লং অফ, ওভার দ্যা টপ, আপিস, এরাউন্ড দ্যা উইকেট, ওভার দ্যা উইকেট... কিচ্ছু বুঝি না। কিন্তু কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রেডিওর ধারাভাষ্য শুনি। তখন এমসিসি (মেরিলিবন ক্রিকেট ক্লাব) ফী বছর এই দেশে ক্রিকেট খেলতে আসত। চারদিনের ম্যাচ। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ জাতীয় দল খেলত। ফারুক, নান্নু, আকরাম, বুলবুল রা। বাংলাদেশ হরহামেশা প্রথম ২৫ রানে ছয় উইকেট হারাত। আমি তাও দাঁড়িয়ে থাকতাম।
এনামুল হক মনি মাঝে মাঝেই ওই অবস্থায় ত্রাণকর্তা হতেন। একবার ৮৬ রান করে ফেললেন। ধারাভাষ্যকার আব্দুল হামিদ খান কান্দেন, আমি গালের কাছে হাত নিয়ে দেখি আমার গালও ভেজা!
ধুত্তর ক্রিকেট!!
ভরা বাজারে লোকজনের সামনে কাঁদতেছি, এটা কেমন কথা!
আইসিসি ট্রফি গেল, বিশ্বকাপ গেল, বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারাল। বাংলাদেশের মানুষ তখন ফুটবল বাদ দিয়ে ক্রিকেট স্টেডিয়ামে যায়। বাজারে পেন্সিল ব্যাটারির রেডিওর দাম বেড়ে গেল। কারণ গাঁও গ্রামেও লোকজন কানের কাছে রেডিও নিয়ে ঘোরে। খেলার ধারাভাষ্য শোনে।
বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ খেলতে গিয়েছিল কেনিয়ায়। যাদের হারিয়ে আমরা আইসিস ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই তারা তখন আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ। কেনিয়া দলে তখন মরিস ওদুম্বে, স্টিভ টিকলো, আসিফ করিম, টমাস ওবুয়া, ওদোয়া, হিতেশ মোদী। পৃথিবীর যেকোনো টিম কাঁপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা তাদের আছে।
ফলে আইসিস ট্রফির হারের শোধ তারা তুলল। প্রতি ম্যাচে ৫০ ওভারে সেই সময়ে তারা করে ৩০০, ৩৫০! আর আমরা টেনেটুনে ২০০। সমস্যা কোথায়?
সমস্যা অনেক। তবে মূল সমস্যা টপ অর্ডারে। বিশেষত ওপেনিংয়ে। ক্রিজে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই উইকেট শেষ। ওপেনারদের মাঠে নামতে দেখে ওয়ান ডাউন, টু ডাউন ব্যাটসম্যানদের কেউ একজন হয়তো ওয়াশরুমে গেছেন। কেবল প্যান্টের জিপার খুলছেন, এইসময়ে দরজায় ধরাম ধরাম শব্দ, 'বের হও, বের হও, উইকেট গেছে!'
এই হলো অবস্থা!
মোহাম্মদ রফিক তখন ৯ নাম্বারের হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান। তাকে প্রায়ই ওপেন করতে দেখা যায়। সেই রফিক কালেভদ্রে যদি একটা ফিফটি মেরে ফেলেন, তখন পুরো জাতি লুঙ্গী কোমরে বেঁধে নাচে, 'রয়েল বেঙ্গল টাইগার এই একটাই, মোহাম্মদ রফিক।
একে আজীবন ওপেনিং ব্যাটসম্যান করা হোক।'
তা কখনো কখনো হয়ও। কিন্তু রফিকেও সমাধান মেলে না। ফলে, খালেদ মাসুদ পাইলট থেকে শুরু করে সুজন, মনি, ফারুক, নান্নু পর্যন্ত ওপেনিং করেন!
কিন্তু ফলাফল ২ থেকে শূন্যতে নামে, কিন্তু শূন্য থেকে ১ -এ কখনো ওঠে না।
ঘরোয়া 'দামাল সামার ক্রিকেট লীগে' তখন ইমরান হামিদ পার্থ নামে এক ওপেনার ছিলেন, আবাহনীতে খেলতেন। তার রানের বন্যায় লীগ ভেসে যেত। তবে ন্যাশনাল টিমে গেলেই তিনি ব্যাটিং করা ভুলে যেতেন। তার ব্যাটিং এভারেজ দেখলে তখন তাকে ১১ নাম্বার ব্যাটসম্যান মনে হতো।
উপায় কী?
উপায় শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ।
আর?
আর মেহরাব হোসেন অপি।
বাংলাদেশের ওপেনিং জুটির ইতিহাসে এই জুটি একটা স্বপ্নময় যাত্রা। এই প্রথম বাংলাদেশ দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যানরা ক্রিজে গেলেও ওয়ান ডাউন, টু ডাউনরা মোটামুটি স্বস্তি নিয়ে হলেও ওয়াশরুমে যাওয়া শুরু করলেন। সম্ভবত ১৯৯৮ সাল, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল বাংলাদেশে এসেছে। সেই জিম্বাবুয়ে এই জিম্বাবুয়ে না। হিথ স্ট্রিক, নেইল জনসন, পল স্ট্র্যাং, ব্লিগনট, ফ্লাওয়ার ব্রাদার্সের ভয়াবহ জিম্বাবুয়ে। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড, ভারত-পাকিস্তান অবধি তখন তাদের সমঝে চলে। বাংলাদেশতো দুধভাত। সেই জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ওপেনিং জুটিতে অপি আর বিদ্যুৎ মিলে অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। ১৭৫ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপ করে ফেললেন!
আমার ধারণা, এই ১৭৫ পর্যন্ত আমি একবারও সচেতনভাবে দম নেইনি। নেব কীভাবে? দম নেয়ার কথাতো ভুলেই গিয়েছিলাম!
অপি প্রথম বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করলেন, ১০১। বিদ্যুৎ সম্ভবত ৬৭।
তুমুল সম্ভাবনাময় সেই জুটি অবশ্য তাদের সম্ভাবনা শেষ করতে সময় নিলেন না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে অপির চেয়েও বেশি পছন্দ করতাম বিদ্যুৎকে। সুদীর্ঘকাল ধরে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে বাংলাদেশ দলের ইতিহাসের সেরা ওপেনারের নাম শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ।
সেই ধারণা অবশ্য একজন ভাঙ্গালেন। এমনভাবেই ভাঙলেন যা তা আর অন্য কেউ ভাঙতে পারলেন না। আজ এখন অবধিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেই একজনের নাম তামিম।
তামিম ইকবাল খান।
তার প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে আরও আগের কথা সেরে নেই। সেই সময়ে বিদ্যুৎ বাংলাদেশ দলের এমনই এক ওপেনার যে যার একটা ইনিংস পুরো টিমের ওপর প্রভাব ফেলত। মনে আছে, এমসিসির সাথে এক চার দিনের ম্যাচে, বাংলাদেশ ফলোঅন করতে নেমেছে, সেই ফলোঅনের ফার্স্ট ইনিংসে বিদ্যুৎ অপরাজিত সেঞ্চুরি করেছেন, ফলোঅন করতে নেমে সেকেন্ড ইনিংসেও করলেন সেঞ্চুরি! সে এক অভাবিত ব্যাপার।
একটি চারদিনের ম্যাচের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি!
সেই সময়ের বাংলাদেশ দলের ওপেনার!
বিদ্যুৎ টিকলেন না, কেন টিকলেন না, জানি না। কতটা নির্বাচকদের দায়ভার আর কতটা বিদ্যুতের সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ! বিদ্যুৎ ক্রিকেট থেকে চলে গেলেন, ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করলেন, কী মনে করে আবার বছর কয়েক পরে ব্যাকও করলেন।
তারপর আবার ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্টে ব্যাক করে ৫৬ আর ৪৮। এরপর কী হলো মনে নেই। তবে একদিন শুনলাম, তিনি আর ক্রিকেট খেলবেন না।
বিদ্যুৎ অধ্যায় শেষ।
বাংলাদেশের ওপেনার অধ্যায়ও শেষ।
এরপর জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা। এনাকে পারলে সবাই গালাগালি করে। যা ইচ্ছা তাই বলে। তিনি যেন অপমানসূচক শব্দের ডিসকোর্স হয়ে গেলেন। কেউ একটু ধীরগতির , ধীরস্থির স্বভাবের হলেই তাকে শুনতে হতো, 'আরে তুইতো দেখি একটা জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা!' -এই ধরনের বিশেষণ দেশের আনাচে কানাচের অজস্র ব্যাটসম্যানকেই শুনতে হয়েছ।
তখন শ্রীলংকায় জয়াসুরিয়া আর কালুভিতরানার যুগ। ওপেনিং-এ এরা নামলে বিপক্ষ দলের পেসাররা বল করা নিয়ে একে ওকে ঠেলাঠেলি করে। কেউ ভয়ে বল করতে চায় না টাইপ অবস্থা!
প্রথম ১৫ ওভারের ৩০ গজ রেস্ট্রিকশনের পুরা ফায়দা এই দুই ব্যাটসম্যান ওঠান। বলে বলে ডাউন দ্যা উইকেট, ওভার দ্যা ফিল্ডার! চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা।
সেই সময়ে জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা আমাদের ওপেনিং ব্যাটসম্যান!
আমরা তাকে গালি দেই, টিভির দিকে কটুবাক্য ছুড়ে মারি, কিন্তু কেউ বোঝে না, যেই টিম ৫০ ওভার পুরো খেলতে পারে না, সেই টিমে কালুভিতরানা, জয়াসুরিয়া দরকার না, দরকার আসলে ১১ জন জাভেদ ওমর বেলিমই।
জাভেদ ওমর ঠিকই ঠুকঠুক করে একপাশে থেকে যান, কিন্তু অন্যপাশে?
অন্যপাশে শুরু হল চমৎকার সব দৃশ্য, আজ এ- তো - কাল সে, কাল সে - তো, পরশু আরেকজন!
মৃদুল নামের এক ব্যাটসম্যান এসেছিলেন, সম্ভবত এক ম্যাচ খেলেছেন, তারপর বাদ। মাহফুজুর রহমান মুন্না নামেও একজন। এবং তিনিও ওই এক ম্যাচ।
ওপেনিং পজিশন যেন তখন ধুধু এক কারবালার প্রান্তর!
হান্নান সরকারের কথা মনে আছে?
তিনি এলেন। এলেন রাজিন সালেহও। ওপেনার! অলক কাপালি ও ওপেনার! মাঞ্জারুল ইসলাম রানা নামের বাঁহাতি এক স্পিনার ছিলেন। যিনি পরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি বোলার হয়ে এলেন। কিন্তু উপায়ন্তর নেই বলে তিনিও একসময় হয়ে গেলেন ওপেনার। দুয়েকটা ম্যাচে সম্ভবত হাবিবুল বাশার সুমনও ওপেনিং- করেছিলেন।
করেছেন সুজন, পাইলট, রফিকও।
ওহ, নাইমুর রহমান দুর্জয়ের কথা ভুলে গেছি। তিনিও কিন্তু ওপেনার ছিলেন ... 😄
অবশ্য লাভ তাতে কিছুই হয়নি। স্কোর বোর্ডে সেই শূন্য রানে দুই উইকেট। এক রানে ৩ উইকেট। ৩ রানে ৫ উইকেট। পঁচিশ রানে ৬ উইকেট। নিয়মিত দৃশ্য।
বাংলাদেশ তারপরও একশ কুড়ি- পঁচিশ করে, টেল এন্ডারদের কল্যাণে। শান্ত, মনি, পাইলটদের কারণে।
ওপেনিং-এর অবস্থা তখন এমন যে বোর্ড সভায় নাকি একবার সিদ্ধান্তও হয়েছিল যে ১১ নাম্বার থেকে ক্রমানুসারে ব্যাটিং এ নামানো গেলে যদি কিছু ঘটে! 😛
এই ভয়াবহ অবস্থায় তুমুল সম্ভাবনা নিয়ে এলেন নাফিস ইকবাল।এবং যথারীতি আলোর ঝলকানি দেখালেন, এবং নিভেও গেলেন। এলেন শাহরিয়ার নাফিস। ঝলমলে আলোর পূর্বাভাষ, এবং... সমাপ্তি। এবং.... আশরাফুল।
হ্যাঁ, উনিও কিন্তু ওপেনিংয়ে খেলেছিলেন!
মেহরাব জুনিয়রের কথা মনে আছে? অনেকেই নিশ্চয়ই তার নামও ভুলে গেছেন... তিনিও তখন ওপেনিংয়ের গিনিপিগ। ও, সেইদিনের সেই নাইম ইসলামও কিন্তু ওপেনিং করেছেন। সব ভুলে যাই, ওহো, জুনায়েদ সিদ্দিকী? তিনিও কিন্তু ছিলেন! ইমরুল কায়েস... ছিলেন তিনিও। আরও কী কেউ ছিল। ও হ্যা, আরেকজনের নাম মনে পড়েছে। তিনি বিস্মৃত, আনোয়ার হোসেন নাম। গোল্লাদের সময়ে একবার ফিফটিও করেছিলেন ওপেনিংয়ে নেমে। সানোয়ার হোসেনও কি আকরাম, বুলবুলদের সময়ে কখনো ওপেনিংয়ে নেমেছিলেন? কিংবা ফারুক আহমেদ? সম্ভবত!
আসলে ওই ওপেনিং এর জন্যই কার পজিশন যে কী ছিল দলে সব ওলট-পালট হয়ে যায়, স্মৃতিতেও...
ধুর, এই দলে পজিশন বলতে কিছু নাই... এরা 'সবে মিলে করি কাজ, হারি হারি নাহি লাজ' দলের সদস্য। এরা সকলেই ওপেনার...
আমার সবাই রাজা (ওপেনার) আমাদের এই সেই ওপেনিংয়ের কারবালায়।
আর? আর একটা ব্যাপারও ছিল। সেটা রীতিমতো কান্নাকাটির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের তখন এক আফসোস, একজন বাঁ হাতি স্বীকৃত ব্যাটসম্যান। একজন মাত্র বাঁ হাতি... কিন্তু... শূন্য এ বঙ্গ বালুচর..
কী করা যায়? কী করা যায়?
ইয়ন বিশপ একবার ঠাট্টা করে বললেন, বাংলাদেশ টিম ওপেনিং পজিশন ছাড়াই খেললে কেমন হয়? এমনিতেই তো এই দলে ৯ জন ব্যাটসম্যান!
মানে, ওপেনিং দুইজন ছাড়া! এরা থাকলেও যা, না থাকলেও তা।
আমাদের দর্শকদের তখন সবকিছু সহ্য হয়ে গেছে। আমরা টিভির সামনে গিয়ে দাঁড়াই বাংলাদেশ ইনিংসের প্রথম ৫-৭ ওভার পরে। কারণ, ততক্ষণে ৯ রান ৩ উইকেট নিয়মিত দৃশ্য। ১৫ রানে চার-চার-পাঁচ উইকেট নিয়মিত ঘটনা।
আমরা বরং অপেক্ষায় থাকি, কখন পাইলট, মনি, রফিক নামবে? কখন সুজন?
মাঝে মাঝে ৫ ওভার পর টিভির সামনে গিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায়, দুহাতে চোখ কচলে তাকিয়ে দেখি বাংলাদেশ পনের, কুড়ি বা পঁচিশ রান বিনা উইকেটে!
ও আল্লাহ, এ ও কী সম্ভব! এ কী করে সম্ভব! আমাদের চোখে মুখে অবিশ্বাস!
ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনের ১৫ ওভারে বাংলাদেশের রান থাকে ত্রিশ, পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশ।
চল্লিশ হলে সেদিন ঈদ!
ঈদ উল আজহার ঈদ না, ঈদ উল ফিতরের ঈদ!
জীবন বড়ই আনন্দময়। আমরা বলি, পাইছিরে পাইছি, অবশেষে ওপেনিং ব্যাটসম্যান পাইছি!
কিন্তু ওই ওপেনিং পার্টনারশিপ আর কুড়ি রানও একসাথে করতে পারে না। আমরা আবার সেই নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে ফিরে যাই। স্বাভাবিক দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখি। ৫ ওভার পর টিভি দেখি! ১০ ওভার পর টিভি দেখি!
সেই আমরা, আটপৌরে ক্রিকেট দর্শক, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সন্ধিক্ষণ দেখে আসা দর্শকরা হঠাৎ করে মাদাম তুসোর জাদুঘরের মোমের মূর্তির মতন হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, স্থানুর মতন, নড়তে ভুলে যাই!
ছেলেটার নাম কী?
বড় বড় চোখ করে চায়?
ফার্স্ট বোলাররা নতুন বলে বাউন্স দিল, ছেলেটা ডাক করল না, চিত-কাঁত হয়ে ক্রিজে পরে গেল না, বাতাসে চাবুক চালানোর মতন করে পুল করল, বল চলে গেল... লং অনের উপর দিয়ে গ্যালারিতে!
কে এই ছেলে!
ক্রিজের মাঝখানে এসে ফার্স্ট বোলারের চোখে চোখ রেখে আগুন দৃষ্টিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলো! পরের বাউন্সারটাকেও আছড়ে ফেলল সীমানার বাইরে! প্রথম ১৫ ওভারে ডাউন দ্যা উইকেট, ফ্রন্টফুট, ব্যাকফুট, স্ট্রেট, লফটেড শট!
বোলারের নাম কি? ধ্যাৎ, বোলারের নাম কে জানতে চায়!
'ইউ কান্ট প্লে অ্যা বোলার, ইউ ক্যান প্লে অনলি অ্যা বল... '।
কে এই ছেলে? বাংলাদেশ দলে ওপেনিং করে?
কে?
তামিম ইকবাল!
ছেলেটার নাম তামিম ইকবাল খান।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওপেনিং-এর ইতিহাসকে বা হাতের উইলোয় ঘা মেরে কাঁপিয়ে দেয়া এক ব্যাটসম্যান। নতুন করে গাঁথুনি দেয়া এক ব্যাটসম্যান। টানা চার বছরে তিনি কাঁপিয়ে দিলেন বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটিঙের সকল রেকর্ড। সব ভেঙেচুরে হুড়মুড় করে তার পায়ের কাছে লুটাল।
২০০৭ বিশ্বকাপে মাত্র ৫২ রানের এক ইনিংস খেলে পুরো ইন্ডিয়া টিমের মেরুদণ্ড ভেঙে দিলেন। জহির খান তেড়ে এলেন, ছেলেটি বলটাকে তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ইশারায় পপিং ক্রিজ দেখিয়ে দিয়ে যেন বললেন, 'যাও, বল কর'।
জহির খান বল করলেন, বাউন্সার, তিনি লং অন দিয়ে পাঠালেন সবচেয়ে দূরের গ্যালারীর মাথায়, ছক্কা! পরের বল চার, পরের বল চার... পুরো ভারত, দেড়শ কোটি মানুষের দেশ, ৩০০ কোটি চোখ, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো, হেসে খেলে হারানো
এতোদিনকার বাংলাদেশ দলে, হু ইজ দিস এরোগেন্ট, দৌজ বার্নিং আইস?
ছেলেটার নাম তামিম ইকবাল! তামিম ইকবাল খান!
ইন্ডিয়ার সাথে টেস্টে ১৫২, হু ওয়াজ দ্যা বোলারস?
'এক্সকিউজ মি, আই ডু নট প্লে বোলারস, আই প্লে বল অনলি...
তামিম ইকবাল... লর্ডস? ডু ইউ নো হোয়াট ইজ লর্ডস ইন ক্রিকেট ?
তামিম ইকবাল জানেন লর্ডস কী?
তিনি গেলেন। গিয়ে বললেন, আমি লর্ডসের অনার্স বোর্ডে আমার নাম দেখতে চাই... ইংল্যান্ডের বাউন্সি পিচ। সেকালে শচিন, শেওয়াগ, সৌরভ, ধনি, কোহলিরা গিয়ে গুটিয়ে থাকেন। তামিম থাকলেন না। ওই বাউন্সি পিচে ইংল্যান্ডের গা হিম করে দেয়া পেসারদের পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে করলেন সেঞ্চুরি! সম্ভবত ৯৮ বলে!
পরের টেস্ট, আবারও সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ডের মাটিতে... সেই বাংলাদেশ, সেই ওপেনিং পজিশন! সেই বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটসম্যান!
আপনারা চোখ কচলান না, আমি কচলাই। গাঁয়ে চিমটি কাটি! আমার অবিশ্বাস্য লাগে। মনে হয় স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু!
এ অসম্ভব!!
জিম্বাবুয়ে সেবার ৩২১ করল। আমরা টিভি টুভি অফ করে কাজ কামে মন দিয়েছি। তামিম ইকবাল প্যাড পরে মাঠে নামার আগে ফিসফিস করে নিজেকে কী বলেছিলেন জানি না। তবে ১৫০ রানের এক ইনিংস (সম্ভবত, এক্স্যাক্ট পরিসংখ্যান ভুল হতে পারে, মেমোরি থেকে লেখা)!
বাংলাদেশ ৩২১ তাড়া করে জিতলো!
এই সেই তামিম ইকবাল, তামিম ইকবাল খান!
বাংলাদেশ ক্রিকেটে ওপেনিং এর সংজ্ঞা বদলে দেয়া নাম! বাংলাদেশের ক্রিকেটকে স্বপ্ন দেখানো এক নাম।এক অবিনশ্বর ইতিহাস।
প্রিয় Tamim Iqbal , আমরা আপনাকে ভুলব না। কখনোই না। যতদিন বাংলাদেশের ক্রিকেট থাকবে, ততদিন আপনার নাম আর কোথাও না হলেও আমাদের হৃদয়ে প্রগাঢ় ভালোবাসার অবিনাশী অক্ষরে লেখা থাকবে। মনে থাকবে।
যুগ যুগ জিও তামিম ইকবাল খান 🙏❤️
হ্যাপি বার্থডে প্রিয় খান সাহেব... 🥳
[কি অসাধারণ লেখা, আহা! প্রাণ জুড়ানো, মন মাতানো! বিশেষ ধন্যবাদ Sadat Hossain - সাদাত হোসাইন 🙏🏻]*