08/04/2025
পর্ব ৩: আগুনের শপথ (গ্রামবাংলার গুপ্ত রহস্য)
পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাশরাফির মনে হচ্ছিল, যেন সময়ের ভেতর দিয়ে এক অতল গহ্বরে ঢুকে পড়েছেন। সেই গহ্বরের একদিকে লুকিয়ে আছে গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের আতঙ্ক, অন্যদিকে রয়েছে ‘অগ্নিকোষ’ নামের এক অদৃশ্য দানবের ছায়া।
লাইব্রেরির ভেতর আলো কম, কিন্তু উত্তেজনা বেশি। হঠাৎ আরেকটি দলিল চোখে পড়ল। সেটি ছিল জমিদার রামচরণ রায়ের ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা—
“১৮৯৮ সালের ১৬ই চৈত্র—
আজ রাতে আবার লোক গায়েব। চরণ পাল, গৃহস্থ পরিবারের যুবক। চারদিন ধরে নিখোঁজ। ভৈরব ঠাকুরের মন্দিরের পেছনে একটা ছেলের কাটা হাত পাওয়া গেছে। গ্রামের মানুষ বলছে, আবার ফিরে এসেছে অগ্নিকোষ। যতোই বলি এ কুসংস্কার, তবু মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা বাসা বাঁধছে…”
এই অংশ পড়ে শিউরে উঠলেন মাশরাফি। “তা হলে শত বছর আগেও এই ঘটনা ঘটেছে? এবং তার সাথে একই সংগঠন জড়িত?”
তিনি ডায়েরিটা ব্যাগে রাখলেন। “এখনই এগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে,” বলে বেরিয়ে পড়লেন।
ঘরে ফিরে এসে, রাতের খাবারের পর নিশিকে ডেকে পাঠালেন।
“এই দেখো,” বললেন তিনি, “এই জমিদার ডায়েরির অংশ পড়ো।”
নিশি পড়ে উঠে বলল, “এটা তাহলে একটা চক্র... বহু প্রজন্ম ধরে চলছে।”
“হ্যাঁ। এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল—এই চক্র শুধু গায়েব হওয়া নয়, মানুষ হত্যা করছে। এবং তা একটা ধর্মীয় বা তান্ত্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে।”
মাশরাফি পাশের কাগজে প্রতীকটি আঁকলেন। এরপর তাঁর বিশ্লেষণ শুরু হল—‘চোখ’ প্রতীক, আগুন, পুরনো শ্মশান, অপহরণ, নিখোঁজ মানুষ, রক্তচিহ্ন, কাদা... সব মিলিয়ে এক অন্ধকার দিক স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
পরদিন সকালে তিনি রওনা দিলেন গ্রামের পুরনো মন্দিরের দিকে—ভৈরব ঠাকুরের মন্দির। ডায়েরিতে সেই জায়গার উল্লেখ ছিল।
মন্দিরটি ছিল পরিত্যক্ত। বড় বড় গাছ, মাটিতে ভাঙা প্রতিমা, লতা-পাতায় ঢাকা প্রাচীন ইট। যেন ভেতরে কোনো শক্তি আজও বাস করে।
মন্দিরের পেছনে ঘুরে দেখতে গিয়ে তিনি এক আশ্চর্য আবিষ্কার করলেন—মাটির নিচে যেন একটা কাঠের দরজা! বহুদিন ধরে চাপা পড়ে আছে, তার ওপর আগাছা জন্মেছে।
মাশরাফি সাবধানে আগাছা সরালেন, তারপর কাঠের দরজার হাতল টানলেন। একটু কষ্ট হলেও দরজাটি খুলে গেল। নিচে একটি সিঁড়ি, অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
তিনি মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলেন।
নিচে নেমে একটি গুহার মতো জায়গা দেখতে পেলেন। ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে, এবং অদ্ভুত এক গন্ধে ভরা। দেয়ালে আগুনের চিহ্ন, আর অনেক পুরনো চিত্রলিপি। একটা দেয়ালে লেখা ছিল—
“আগুনই মুক্তি। আগুনই শক্তি। যারা আগুনে বিশ্বাস করে না, তাদের স্থান হবে অন্ধকারে।”
মাশরাফির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
এবার তিনি বুঝলেন—‘অগ্নিকোষ’ একটি তান্ত্রিক গোষ্ঠী, যারা আগুনকে কেন্দ্র করে এক ধরনের অন্ধ বিশ্বাসে মেতে আছে। তারা বিশ্বাস করে, আগুনের মাধ্যমে আত্মা মুক্তি পায়, আর এই মুক্তির জন্য চাই ‘মানব উৎসর্গ’।
ঠিক তখনই, পেছনে কারো পায়ের শব্দ।
তিনি দ্রুত ফিরে তাকালেন।
—“তুমি এখানে কী করছো?”—একটি রুক্ষ কণ্ঠস্বর।
মাশরাফি তাকিয়ে দেখলেন, একজন লম্বা, মুখ ঢাকা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে, হাতে লাঠি।
“তুমি কে?” জিজ্ঞেস করলেন মাশরাফি।
লোকটা কিছু না বলে দৌড়ে পালাতে শুরু করল। মাশরাফি তৎক্ষণাৎ ধাওয়া করলেন, কিন্তু গুহার পথ এত জটিল ছিল যে অল্প কিছু দূর গিয়েই সেই লোক অদৃশ্য হয়ে গেল।
ফিরে এসে তিনি গুহার একটি কোণে একটি পুরনো বাক্স খুঁজে পেলেন। খুলে দেখলেন—ভেতরে রক্তমাখা কাপড়, কয়েকটি পুরনো লকেট, আর একটি ছোট খাতা।
খাতায় লেখা—“রূপা... চরণ... রাহুল...”
“এটা অপহৃতদের তালিকা!” চমকে উঠলেন মাশরাফি।
তিনি জানতেন, এখন আর সময় নেই। ‘অগ্নিকোষ’ আবার সক্রিয়, এবং এবার তাদের থামানো না গেলে এই গ্রাম ধ্বংসের মুখে পড়বে।
মাশরাফি খাতা, লকেট আর রক্তমাখা কাপড় নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন। মুখে এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ—এই গ্রামকে মুক্ত করতে হবে ‘অগ্নিকোষ’-এর ছায়া থেকে। বেলা তখন পড়ন্ত, সূর্য ডুবে যাচ্ছে দিগন্তে, আর সেই সূর্যকে দেখেই যেন শপথ নিলেন—এই আগুনের ভক্তদের, যারা মানুষকে উৎসর্গ করে বাঁচতে চায়, তাদের আগুনেই শেষ করতে হবে।
ঘরে ফিরে আসতেই নিশি জিজ্ঞেস করল, “কী খুঁজে পেলে?”
মাশরাফি চুপ করে খাতাটি এগিয়ে দিল। নিশি পড়ে ফেলল প্রথম পৃষ্ঠা—রূপা, চরণ, রাহুল… আর তার নিচে একটা তারিখ—‘০৯/০৪/২৫’। অর্থাৎ আগামীকাল?
“তাদের উৎসর্গ করার দিন কাল?” নিশি চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল।
“ঠিক তাই,” বললেন মাশরাফি। “তাই আমাদের হাতে সময় খুব কম। আজ রাতেই কিছু করতে হবে।”
ময়নাল কাকাকেও সব জানানো হল। তিনি বললেন, “আগে শোনা যেত, এই চক্র বছরে একবার উৎসব করে, যেটা তারা বলে ‘অগ্নি পূর্ণিমা’। সেই রাতে তারা বলি দেয়। সম্ভবত কাল সেই রাত।”
মাশরাফি এবার গ্রাম চৌকিদার আর কিছু সাহসী যুবককে ডেকে নিলেন। তাদের সঙ্গে পরিকল্পনা তৈরি করলেন।
“তোমরা কেউ টর্চ, বাঁশি আর মোটা লাঠি নিয়ে তৈরি থাকো। আমি সেই গুহা পথে আবার যাব। তোমরা থাকবে বাইরে, সংকেত পেলে ভেতরে ঢুকবে।”
“কিন্তু ওরা যদি অস্ত্র নিয়ে থাকে?”
“আমাদের সাহস থাকতে হবে। কারণ অপহৃতদের জীবন এখন আমাদের হাতে। আর আমিও একা যাব না,” বলেই মাশরাফি নিজের ছোট রিভলভারটি কোমরে গুঁজে নিলেন।
রাত নেমে এল। চাঁদহীন অন্ধকারে হাওয়ার স্রোত যেন কান পাতলেই ভয় জাগায়। গ্রামের সবাই ঘরের ভেতর বন্ধ, কেবল মাশরাফির দল প্রস্তুত।
গভীর রাতে গোপনে গুহার দিকে রওনা দিলেন মাশরাফি ও তাঁর দল। তারা মন্দিরের পেছনে গিয়ে গোপন দরজা খুলল, সিঁড়ি দিয়ে নামল নিচে। মাশরাফির নির্দেশে বাকিরা বাইরে পাহারায় রইল।
ভেতরে নেমেই মাশরাফি শুনলেন—এক ধরনের মন্ত্রপাঠ। গলার স্বরগুলো কাঁপছে, যেন কোনো অদ্ভুত সাধনার মধ্যে ডুবে আছে তারা।
তিনি সাবধানে এগিয়ে গেলেন। একটু দূর গিয়ে দেখলেন এক বিশাল কক্ষ, যার মাঝখানে আগুনের চুল্লি। চারপাশে মুখঢাকা দশ-বারো জন লোক দাঁড়িয়ে, তাদের মাঝখানে একটি ছেলেমেয়েকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা।
মাশরাফির রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল।
তাঁর পেছনে দাঁড়ানো দুই যুবককে ইশারায় ডাকলেন।
“আমি এগিয়ে যাব, ঠিক সময়ে বাকিরা আক্রমণ করবে,” ফিসফিস করে বললেন।
একটা মোক্ষম সময়ে, মাশরাফি দৌড়ে ভিতরে ঢুকে চিৎকার করলেন—
“থামো! পুলিশের নামে বলছি, কেউ নড়বে না!”
হঠাৎ চারদিকে হুলস্থুল পড়ে গেল। কেউ কেউ পালানোর চেষ্টা করল, কেউ আবার আগুনের চারপাশে ঢাল তৈরি করতে চাইল। মাশরাফি একের পর এক গুলি ছুঁড়ে তাদের পিছু হটিয়ে দিল। তখন বাইরে থাকা দলটিও ভেতরে ঢুকে পড়ল।
একটা তুমুল ধস্তাধস্তি শুরু হল।
মাশরাফি সেই ছেলেমেয়েদের দড়ি কেটে দিলেন, তাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রাখলেন। এরপর একে একে মুখোশধারীদের ধরে ফেলল সবাই। কয়েকজন পালিয়ে গেলেও তিন-চারজন ধরা পড়ল।
তাদের মধ্যে একজন মুখোশ খুলতেই চমকে উঠলেন মাশরাফি—এ তো রমেশ সর্দার নিজে!
“তুমি?” চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
রমেশ মাথা নিচু করে বলল, “আমাদের পূর্বপুরুষরা এ কাজ করত। আমিও শুধু ধারাবাহিকতা বজায় রাখছিলাম…”
“তোমাদের এই ‘ধারাবাহিকতা’ মানুষের জীবন নিয়ে খেলে! এবার তোমার শেষ!”
ঘটনাটি শেষ হতে হতে রাত প্রায় শেষ। সকালবেলায় গ্রামবাসীরা জেগে উঠে জানতে পারল, ‘অগ্নিকোষ’ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, অপহৃতরা উদ্ধার হয়েছে।
মাশরাফির চোখে তখন একটা প্রশান্তি। তবে তিনি জানেন, গল্প এখানেই শেষ নয়। ‘অগ্নিকোষ’-এর মূল নেতৃত্ব হয়তো এখনও ধরা পড়েনি।
তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন—
“আগুনের নামে যারা মানুষ হত্যা করে, তাদের নিজস্ব আগুনেই পুড়ে মরতে হবে।”
রাতের উত্তেজনাপূর্ণ অভিযানের পর সকালে গোটা গ্রাম যেন এক নতুন সূর্য দেখল। লোকজন ভয়ে কাঁপছিল যে, হয়তো তাদের আত্মীয়রা আর ফিরে আসবে না, কিন্তু যখন তারা দেখে নিখোঁজরা ফিরে এসেছে, তখন আনন্দে কান্না ছড়িয়ে পড়ে গোটা বটতলায়।
তবে মাশরাফির মনে এখনো অস্থিরতা। তাঁর অভিজ্ঞতা বলছে—এত বড় চক্র শুধু রমেশ সর্দার আর গ্রামের কিছু মানুষের হাতে তৈরি হতে পারে না। এটি নিশ্চয়ই বাইরে থেকে পরিচালিত হয়। সেই মূল হোতা কে?
তিনি চৌধুরী বাড়িতে ফিরে এসে তাঁর সংগ্রহ করা দলিল, পুরনো চিঠিপত্র, আর খাতাটি ফের একবার খুলে বসলেন। নিশিও পাশে বসে।
“এই দেখো,” মাশরাফি একটি চিঠির অংশ দেখাল—
“রামচরণ, পূর্ণিমার রাতে উৎসর্গের আয়োজন করতে ভুলো না। অগ্নিকোষের সন্ন্যাসী আসবেন। তিনি আসলেই শক্তি।—তোমার দাদা, বীরেন্দ্রনাথ।”
নিশি বলল, “এই সন্ন্যাসীটা কে হতে পারে?”
মাশরাফি তখনই পুরনো নথি ঘেঁটে গ্রামের পাশের জঙ্গলে অবস্থিত একটা আশ্রমের নাম পেল—‘অগ্নাশ্রম’। এবং আশ্রমের প্রধানের নাম—তপোধনানন্দ মহারাজ।
“তপোধনানন্দ,” মাশরাফি নিজে নিজে বললেন, “তাঁর নামই তো গ্রামের কেউ নেয় না, যেন কেউ তাঁকে চোখে দেখেনি। হয়তো সবার ভয়ই তাঁকে অদৃশ্য রাজার মতো করেছে।”
পরেরদিন ভোরে, মাশরাফি নিশিকে নিয়ে গেলেন সেই অগ্নাশ্রমে। আশ্রমটি জঙ্গলের মাঝে, কাঁচা পথ ধরে যেতে হয়। পথ ধরে যেতে যেতে তিনি চারদিকে খেয়াল করলেন—গাছে গাছে অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা, আগুনের প্রতীক, চোখের প্রতীক… সব মিলিয়ে শিউরে উঠতে হয়।
অবশেষে তাঁরা পৌঁছালেন আশ্রমে। সামনের ফটকেই দাঁড়িয়ে থাকা এক সন্ন্যাসী তাদের থামাল।
“কোথা থেকে এসেছেন?”
“আমরা সন্ন্যাসীজীর দর্শন চাই। তিনি তপোধনানন্দ মহারাজ তো?”
সন্ন্যাসী অবাক চোখে তাকালেন। “তাঁর সাথে সাধারণ কেউ দেখা করে না।”
“আমি সাধারণ নই,” মাশরাফি তাঁর পরিচয়পত্র বের করলেন। “ডিটেকটিভ মাশরাফি বিন মর্তুজা। আমি সরকারি তদন্তে এসেছি।”
সন্ন্যাসী কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল। তারপর গেট খুলে বলল, “আসুন।”
তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলেন, আশ্রমের পরিবেশ অস্বাভাবিক নিঃশব্দ। যেন কিছু লুকানো আছে, যেন সবুজ পাতার আড়ালে নজরদারির চক্ষু জ্বলছে।
একটি বড় হলঘরে বসেছিলেন তপোধনানন্দ। সাদা পোশাকে, মাথায় লাল পাগড়ি, চোখ দুটি স্থির, তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন মাশরাফির দিকে।
“আপনি কে?”
“আমি সেই লোক, যে আপনার আগুন নেভাতে এসেছে,” মাশরাফি চুপচাপ বললেন।
তপোধনানন্দ হেসে উঠলেন, “তুমি তো সাহসী। জানো, এই আগুনে শত বছর ধরে কত শক্তি জন্মেছে? আমরা মানুষ তৈরি করি আগুনে...”
“আর মানুষও মারো আগুনে,” বলে ফেললেন মাশরাফি।
তপোধনানন্দ কিছু না বলেই উঠে দাঁড়ালেন। “তুমি জানো না, তুমি কাকে চ্যালেঞ্জ করছো। এই অগ্নিকোষ-এ শুধু ধর্ম নয়, শক্তি, রাজনীতি, অর্থ—সব কিছু আছে।”
“আপনার সময় শেষ। রমেশ ধরা পড়েছে। বাকি সবাইও যাবে।”
এইবার তপোধনানন্দ ঠান্ডা গলায় বললেন, “তোমার শহরে কি তেমন কেউ নেই, যার ওপর তুমি নির্ভর করো?”
এই প্রশ্নে মাশরাফির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।
“নিশির দিকে তাকিও না,” সে বলল। “ওর সঙ্গে কিছু হলে, আমি তোমার এই সন্ন্যাসী বেশ ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলব।”
এক মুহূর্তে উত্তেজনা জমে উঠল। সেই মুহূর্তে আশ্রমের পেছন থেকে চিৎকার ভেসে এল—
“দাদা! সাহায্য করো!”
মাশরাফি বুঝে গেল—আবার কেউ অপহৃত হয়েছে।
তিনি নিশিকে বাইরে পাঠালেন, নিজে ছোট লুকানো দরজা দিয়ে পেছনে চলে গেলেন। সেখানে একটি ছোট কুঠুরি, আর তার মধ্যে দুই চোখ বাঁধা কিশোরী—হয়তো রূপার মতই আরেক অপহৃত।
“তোমার নাম কী?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
“সোহিনী… আমায়… ওরা বলি দিতে চেয়েছিল…”
মাশরাফি তখনই মেয়েটিকে নিয়ে আশ্রম থেকে বেরিয়ে এলেন। ততক্ষণে নিশি বাইরে পুলিশ ডেকে এনেছে।
তপোধনানন্দ গ্রেফতার হলেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে গ্রামে এক ধরনের দ্বিধা তৈরি হল—কেউ কেউ বিশ্বাস করত, উনি প্রকৃতপক্ষে সাধু। কিন্তু প্রমাণ, নথি, অপহৃতদের সাক্ষ্য—সব মিলিয়ে তপোধনানন্দ-ই এই শতবর্ষের অগ্নিকোষ চক্রের মূল চালক প্রমাণিত হল।
তপোধনানন্দ গ্রেফতার হওয়ার পর গ্রামবাসীরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে লাগল। কেউ কেউ বলল, “উনি তো আমায় আশীর্বাদ দিয়েছিলেন, ফসল ভাল হয়েছিল।”
আবার অনেকে বলল, “উনি-ই আমার ছেলেকে নিয়ে গেছেন, আমি জানতাম।”
এই সময়ই একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বললেন, “তোমরা কেউ জানো না, তপোধনানন্দ কেউ না… সে মাত্র এক চরিত্র। এই চক্রের নাম 'অগ্নিকোষ' ঠিক আছে, কিন্তু এর মূল পরিকল্পনা আজ থেকে একশো বছর আগে তৈরি হয়েছে।”
মাশরাফি তাকালেন সেই বৃদ্ধের দিকে, “আপনি কে?”
“আমি আশুতোষ। আগেকার দিনগুলোতে চৌধুরী সাহেবের ব্যক্তিগত কেরানি ছিলাম। অনেক কিছু জানি।”
তাঁকে নিয়ে মাশরাফি চৌধুরী বাড়িতে গেলেন। আশুতোষ একটি পুরনো সিন্দুক দেখালেন, যার মধ্যে ছিল ছেঁড়া কিছু পাতার বই, আর একটি নকশা।
মাশরাফি বইটি হাতে নিয়ে পড়তে লাগলেন। তাতে লেখা—
“শুধু আগুন নয়, আমাদের লক্ষ্য চেতনার আগুন। আমরা তৈরি করব এমন এক প্রজন্ম, যারা নিজের আত্মাকে উৎসর্গ করবে শক্তির পূজায়। মানুষের ভয়ই আমাদের শক্তি। আমরা তাদের ভয় দেখাব, তাদের কাছ থেকে বিশ্বাস কিনব, তারপর তাদের মন নিয়ন্ত্রণ করব।”
এই কথাগুলো মাশরাফির কাঁধে শীতল স্রোতের মতো নেমে এলো।
নকশাটি ছিল গ্রামের নিচে খনন করা একটি সুড়ঙ্গপথের। আশুতোষ বললেন, “এই পথ চৌধুরীবাড়ি থেকে শুরু হয়ে অগ্নাশ্রম পর্যন্ত গিয়েছে। তার নিচে লুকানো আছে আসল দলিল, আসল পরিকল্পনা।”
মাশরাফি সিদ্ধান্ত নিলেন—এই সুড়ঙ্গই তার পরবর্তী লক্ষ্য। নিশি, চৌধুরী বাড়ির দুই বিশ্বস্ত মানুষ এবং দুইজন পুলিশ নিয়ে তিনি ঢুকলেন সেই গোপন সুড়ঙ্গে।
সুড়ঙ্গটি অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে এবং অদ্ভুতভাবে শান্ত। মাঝে মাঝে কিছু পুরনো শিকল, ধাতব বাক্স আর রক্তের দাগ দেখা গেল। এই পথ দিয়ে অনেককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে—এই সত্যি যেন দেয়ালে লেখা।
হঠাৎ তাঁরা এক জায়গায় পৌঁছালেন, যেখানে বড় এক চেম্বার। সেই চেম্বারের মাঝে একটি ভাঙা বেদি, আর তার উপর একটি পাথরের বাক্স।
মাশরাফি বাক্সটি খুললেন।
তার মধ্যে একটি পুরনো কাগজ—ব্রহ্মলিপিতে লেখা।
পাশে রাখা একটি ছোট পাথরের ফলকে খোদাই করা—
“আগুন নিভবে, যেদিন সত্য ভয়হীন হবে।”
এই লাইনটি নিশি পড়ে ফেলল।
“তুমি বুঝেছো এর মানে?” নিশি জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ,” মাশরাফি বলল, “এই চক্র ভয় দিয়ে শাসন করত। তাদের পরিকল্পনা ছিল—ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মন নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু সত্য—ভয়হীন সত্য—এই আগুনকে নিভিয়ে দিতে পারে।”
এই চেম্বারে আরও কিছু দলিল পাওয়া গেল, যেগুলো পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হল। পুরো অগ্নিকোষ চক্রকে আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। তপোধনানন্দের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, অপহরণ, এবং ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের হল।
বটতলা গ্রাম আবার ফিরে পেল তার শান্তি। শিশুরা খেলতে শুরু করল মাঠে, মানুষজন রাতেও নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করতে লাগল।
শেষ রাতে মাশরাফি একা বসে ছিলেন চৌধুরী বাড়ির বারান্দায়। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে।
নিশি এসে চুপ করে পাশে বসে বলল, “তুমি চলে যাবে কাল?”
“হ্যাঁ,” মাশরাফি বলল। “কিন্তু আমি আবার ফিরব। কারণ এই গ্রামে রহস্য আছে, অন্ধকার আছে, আবার অনেক আলোও আছে।”
নিশি হেসে বলল, “আচ্ছা, তুমি কি সব রহস্য একদিনে বুঝে ফেলো?”
“সব না,” মাশরাফি তাকিয়ে বলল, “কিছু রহস্য আমাদের অপেক্ষা করে… কিছু উত্তর একদিন আসবেই।”
আকাশে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটছে।
(চলবে...)