
03/08/2025
ভয়াল ২ আগস্ট
২০২৪ (রোজ শুক্রবার)
প্রতি সপ্তাহে যে শুক্রবার আমাদের জীবনে আসে এটা সেই রকম কোন শুক্রবার ছিলো না।
আমাদের শুক্রবার গুলো কেমন হয়? এই ধরেন কিছুটা আলসেমী দিয়ে শুরু পূরা সপ্তাহটা প্রচন্ড পরিশ্রমের পর এই দিনে আমরা অনেকেই একটু সময় করে ঘুম থেকে উঠি। প্রচন্ড আলসেমী আর আরাম আয়েশে সকালে নাস্তা করি এর পর অনেক সময় নিয়ে গোসল করি এবং সন্ত্বান কে সাথে নিয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাই।
আর এদিকে বাসায় রান্না হতে সামর্থের সর্বোচ্চ মজাদার খাবার। নামাজ পড়ে পরিবারের সকলে মিলে এক সাথে খাওয়া শেষে একটা ভাত ঘুম। বিকালে একটু ঘুরতে যাওয়া। কেউ কেউ রাতে বাহিরে খেয়ে বাসায় ফিরে।
কিন্তু গত ৩২দিন ধরে আমাদের দেশে ছাত্র জনতার আন্দোলনে তখন চরম শিখরে। ঘরের বাচ্চা ছেলে মেয়ে তখন বাবা মা কে টেনে সেই আন্দোলনে রাস্তায় নামাচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ২রা আগস্টরের শুক্রবার আমাদের মধ্যে চলে আসে যে আগস্ট কে আমরা ৩৩ই জুলাই বলতে ভালোবাসি।
২০২৪ সালের ২ আগস্ট (শুক্রবার) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৩ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল এবং ৪ আগস্ট থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এর আগের দিন ১ আগস্ট আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, নুসরাত তাবাসসুম ও আবু বকর মজুমদার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হেফাজত থেকে মুক্তি পান।
মুক্তির পাওয়ার পর তারা এক যৌথ বিবৃতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন এবং আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার দাবি করেন।
এমন একটা ভয়াল পরিস্তিতি আর শংকার মধ্যে বাংলাদেশে শুক্রবার আসে।
আমার বাসা ঢাকার উত্তরার সেক্টর ১১তে। চারদিকের থমথমে পরিবেশে মধ্যে আমরা সকাল থেকে টিভির সামনে এবং রাস্তায় নজর দিচ্ছিলাম। আমাদের সেক্টরের আশেপাশে সধারন ছাত্র এবং বিচ্ছিন্ন ভাবে ছাত্রলীগ যুবলীগ ও অনান্য সরকারি দলের অংগসংগঠনের কর্মিদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করছিলাম। জানা যাচ্ছিলো জুম্মার নামাজের পর আন্দোলনের দাবীর পক্ষে একটা বিশাল মিছিল উত্তরায় হবে। এর মধ্যে পুলিশ আর্মী বিজিবির নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক উপস্তিতি দেখা যাচ্ছে।
এর মধ্যেই জুম্মার নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে উত্তরার মাইলস্টোন কলেজের ক্যাম্পাস এলাকায় থেকে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে জমজম টাওয়ারের দিকে অগ্রসর হতে গেলে নিরাপত্তা বাহিনী এবং সসস্ত্র ছাত্রলীগ এর বাধার সামনে পরে। কিন্তু ব্যাপরোয়া মিছিল কে নিয়ন্ত্রন করতে অপারগ নিরাপত্তা বাহিনী এবং সসস্ত্র ছাত্রলীগ নির্বিচারে গুলি করতে থাকে।
ছাত্র জনতা গুলির বাধার কারনে কিছুটা ছত্রভংগ হয়ে আশে পাশের বাসা বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহন করে।
আমি তখন এই আন্দোলনের আমাদের সেক্টর ১১ মসজিদের সামনে অবস্থান করছিলাম। ছত্র ভংগ অবস্থায় আমি বাসা থেকে ফোন পাই যে আমার বাসার দিকেও গুলাগুলি শুরু হয়েছে আতংকে এবং পরিবারের নিরাপত্তার জন্য আমি বাসায় ফিরার চেষ্টা করি। কিন্তু বাসায় যাওয়ার কোন নিরাপদ রাস্তা পাচ্ছিলাম না। আমার বাসায় যাওয়ার একমাত্র রাস্তার মোরে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের কিছু কর্মি ছাত্র এবং জনতার দিকে নগ্ন গুলি করছিলো। আমি ও আমার বন্ধু প্রতিম ব্লিন ভাই আর তার পরিবারের সাথে তার অফিসে আশ্রয় নেই। যেখান থেকে আমার বাসার চার রাস্তার মোর দেখা যায়। প্রায় ঘন্টা দেড়েক রাস্তায় কোন ছাত্র জনতা কে না দেখে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের কর্মিরা চলে যায়। আমরা সুযোগ পেয়ে বাসায় যাই।
বাসায় যেয়ে দেখি অবস্থার প্রেক্ষিতে আশে পাশে অনেক বাসার গেট বন্ধ থাকায় নিরস্ত্র ছাত্র ছাত্রীদের প্রায় ২০/২৫ জন আমার বাসায় এবং পাশের আরেক বাসায় সমসংখক ছাত্র ছাত্রী আশ্রয় নিয়েছে।
এদের মধ্যে দুইজন আবার আহত। একজন গুলি বিদ্ধ। পাশেই বাংলাদেশ মেডিকেল থাকা সত্তেও সেখানে যাওয়ার কোন উপায় ছিলো না। কারন যাওয়ার রাস্তা ছাত্রলীগের দখলে। এবং কিঞ্চিত আতংকিত আহত ছেলেটিও হাসপাতালে যেতে চাচ্ছিল না।
আমাদের জানার মধ্যে আমাদের পাশের বিল্ডিং এ একজন মেয়ে যে কি না সদ্য মেডিকেল থেকে পাশ করে বের হয়েছে তার সরনাপন্ন হলাম এবং সে তার নিকট থাকা প্রাথমিক চিকিৎসার সরন্মজমাদি অই দুইজনের চিকিৎসা করেছেন। এবং পরিস্থিতি অনুকুলে আসার পর অদের আমরা দুরবর্তি নিরাপদ একটা হসপিটালে পাঠিয়েছিলাম এখানকার লোকাল সমন্বয়কের সহয়তায়।
ছাত্রদের আমরা শুরুতেই বিভিন্ন ভাবে তাদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিয়ে ছাত্রীদের আমাদের চার পাচ জনের বাসায় রেখে দিয়েছিলাম।
আমার বাসায় রেখেছিলাম ৫জন ছাত্রীকে। রাত প্রায় ১০টার দিকে ওদের অভিবাবক কে ডেকে বাসায় এনে নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে নিরাপদ ভাবে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে দুজন মহিলা হোস্টেলে থাকত। তাদের কে তাদের ভার্সিটির স্যার কে ডেকে নিরাপদে হোস্টেলে পাঠিয়ে রাত ১২ দিকে নিশ্চিত হই, সকলে নিরাপদে তাদের বাসায় গিয়েছে।
এই সময় আল্লাহর রহমতের বৃষ্টিই এই কাজ নিরাপদে করতে আমাদের সাহায্য করেছে।
এখন অনেকেই এই আন্দোলনের ক্রেডিট ম্যান্ডেট নিতে ব্যাস্ত কিন্তু আমার দেখা এই আন্দোলনে কারো একক কোন অংশিদ্বারিত্ব থাকতে পারে না। এই আন্দোলন দলমত নির্বিশেষে সকলের।
আমি আন্দোলনে অংশগ্রহন এর সময় কাওকেই কোন দলের প্রতিনিধিত্ব করতে দেখি নাই।
তাই এই বিপ্লব আমার কাছে বাংলাদেশের বঞ্চিত নিপেরিত মানুষের জুলুমবাজের বিরুদ্ধের, এই বিপ্লব ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধের বিপ্লব।
আমারা চাই এক নতুন বাংলাদেশ যে বাংলাদেশ থাকবে সম্প্রিতির ভালোবাসার বাংলাদেশ। যেখানে কেউ নিজের চরকায় তেল না দিয়ে দেশের চরকায় তেল দিবে।
আমি বি এন পি না, আমি আওয়ামীলীগ না , আমি জামাত না, আমি এন সি পি না,
আমি বাংলাদেশী, এটাই হোক আমাদের সকলের ১ম পরিচয়।
এস এম ইমরুল কায়েস
উত্তরা, ঢাকা