24/10/2024
বিদায় লগ্ন!
এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তজুমদ্দিন উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির কার্যনির্বাহী কমিটিতে ২০২০ সালের ১৫ জুন তৎকালীণ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব আল নোমান'কে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। দায়িত্ব বুজে পাওয়ার পর এই প্রতিষ্ঠানকে পূর্বের ঐতিহ্যবাহী রূপে ফিরিয়ে আনা ছিলো এক প্রকার চ্যালেঞ্জিং বিষয়।
কারণ, দীর্ঘদিনের অযত্নে অবহেলায় থাকা ছোট্ট একটি ভবন যার দেয়ালে ফাটল ধরেছে, প্লাস্টার গুলো খসে পড়ছে উপরে থাকা টিনের চালের ফুটো দিয়ে সূর্যের আলো এবং বৃষ্টির পানি একসাথে রুমে ডুকছে। স্টেজের উপরে উইপোকারা মাটির স্তুপ প্রায় হাঁটুসমান করে রেখেছে, চারদিকে নোংরা গন্ধ, ওয়াশরুম যেনো আরেক জাহান্নামের অংশ। এই ভবনেই চলতো শিল্পকলা একাডেমির সকল কার্যক্রম।
আমি নিজে উপস্থিত থেকে আমার সাথে বন্ধু মনির, নৃত্য প্রশিক্ষক মুক্তা চক্রবর্তী সহ আমাদের প্রশিক্ষণার্থীদের সহযোগিতায় একাডেমি পরিষ্কার করি। আমার নিজ অর্থায়নে খসে পড়া দেয়ালে পেপার লাগানো, ইলেকট্রনিক্সের কাজ করানো, লাইট, ক্যাবল সহ বেশ কিছু উপকরণ কিনে মোটামোটি একটা প্রশিক্ষণের পরিবেশ গড়ে তুলি।
প্রশিক্ষণার্থী ছিলো অল্পসংখ্যক, কারণ এই এলাকাটি মেঘনার তীরবর্তী হওয়ায় মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ভাল ছিলোনা। স্থানীয় উপজেলা পর্যায়ে যারা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও জনপ্রতিনিধি ছিলো তারা কেউ সাংস্কৃতিকমনা বা উচ্চ শিক্ষিত ছিলোনা। যার কারণে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য কারো কোনো ভাবনা কখনোই ছিলোনা। যার প্রভাব পড়েছিলো শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক খাতে।
এখানকার অধিকাংশ অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নৃত্য বা সংগীতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতোনা। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক অভিভাবক তাদের সন্তানদের আমাদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর কিছুদিন পর দেখা যেতো যখন তাদের সন্তানরা ভাল পারফর্মেন্স করছে জেলা উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে। তখন বিশেষ করে নারী শিল্পীদের খুব কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। বিয়ের পর নারী শিল্পীদের এই প্রতিভা চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতো। যার কারণে কোন শিল্পী তৈরী করা হলেও বেশিদিন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে যুক্ত রাখা সম্ভব হতোনা।
এমতাবস্থায় আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলে উনার সহযোগিতায় মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে আহ্বান জানাই ও তাদেরকে ভর্তি করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি।
একটা সময় আমাদের প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের পদচারণায়। মুখরিত হতে থাকে। সপ্তাহে ০২দিন নিয়মিত ভাবে আমাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলতে থাকে। নারীদের বিশেষ নিরাপত্তায় থানা থেকে ফোর্স এনে শিল্পকলার প্রশিক্ষণ চলাকালীণ সময়ে আশেপাশে ও উপজেলা চত্বরে বহিরাগত আড্ডা বন্ধ করি। বহিরাগতরা অধিকাংশ ছিলো অপরাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠা কিশোরগ্যাং। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে আমাকে নানা প্রতিকুলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে।
বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো রাতের বেলা শুরু হতো, তাই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হতে অনেক রাত হয়ে যেতো। দুর দুরান্ত থেকে আসা শিল্পীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে থানা পুলিশের গাড়ি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের গাড়ি ব্যবহার করে শিল্পী ও তাদের অভিভাবকদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে এরপর আমি বাড়ি ফিরতাম।
আমি দায়িত্বগ্রহণের পূর্ববর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা ঠিক মতো সম্মাণী পেতোনা। কেউ কেউ পেলেও সেটা ছিলো খুবই সামাণ্য। প্রশিক্ষণ মহড়া চলাকালীণ নাস্তার ব্যবস্থাও তেমন ছিলোনা। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর এই রীতির পরিবর্তন আনতে কাজ করি। পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রণকারী শিল্পীদের সবাইকে উপযুক্ত সম্মাণী, সার্টিফিকেট ও গিফট এর ব্যবস্থা করি। প্রশিক্ষণ মহড়া চলাকালীণ ভাল মানের নাস্তার ব্যবস্থা করি। নাস্তার কিছু অংশের খরচ উপজেলা প্রশাসন থেকে বহন করা হলেও বেশিরভাগ সময় আমার ব্যক্তিগত খরচে সবার নাস্তার ব্যবস্থা করতাম।
জাতীয় অনুষ্ঠানে বরাদ্দ সংকটের উছিলা দিয়ে উপজেলা পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গরা ছোট্ট পরিসরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে চাইতো। সেটারও পরিবর্তন এনেছি। তাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সদ্য সাবেক মাননীয় সংসদ সদস্য মহোদয়ের কাছ থেকে অর্থ সহযোগিতা এনে স্থানীয় শিল্পীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বনামধন্য শিল্পীদের নিয়ে বড় পরিসরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম।
শিল্পকলা একাডেমির ভবনে উপজেলা প্রশাসন স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে একটি কুচক্রি মহল শিল্পকলা একাডেমির ভবন দখলে পায়তারা করেছিলো। এদের কারণে আমাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনায় সমস্যা পোহাতে হতো। আমি তৎকালীণ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলে উপজেলা প্রশাসন স্কুলকে অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এবং শিল্পকলা একাডেমি ভবনকে সম্পূর্ণ ভাবে আমাদের কার্যক্রমে অব্যাহত রাখি।
বৃষ্টির দিনে টিনের ফুটো দিয়ে পানি ডুকে আমাদের বিভিন্ন মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। সেই সাথে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। যার সমাধাণের জন্য বহুদিন ঘুরেছি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে। সংগীত ও নৃত্য প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ ছিলোনা। ধার দেনা করে অন্য জায়গা থেকে যন্ত্রাংশ এনে কার্যক্রম চালানো হতো। এসব বিষয়ের প্রতিকার চেয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া, পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করা ও বিভিন্ন মিটিং এ এসব তুলে ধরতে গিয়ে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। বেয়াদব উপাধি পেয়েছি। তবুও আমি কখনো হাল ছাড়িনি। অবশেষে ২০২২ সালে তৎকালীণ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোশারেফ হোসেন দুলাল ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মরিয়ম বেগম এর সহযোগিতায় উপজেলা পরিষদের ফান্ড থেকে কিছু টাকা বরাদ্দ নিতে সক্ষম হই।
আমার দাবি ছিলো উপজেলার পুরাতন একতলা বিশিষ্ট অডিটোরিয়াম এর বিল্ডিংটি মেরামত করে শিল্পকলা একাডেমির জন্য যাতে দেওয়া হয়। আমার দাবিটি মিটিং এ পাস করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
বরাদ্দের টাকায় নতুন সাউন্ড বক্স, ঢোল, তবলা, গিটার, বাঁশি সহ আরো বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কেনার পাশাপাশি পুরাতন অডিটোরিয়ামের দরজা, জানালা, ফ্লোর পরিবর্তন করে রং এর কাজ করানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেই কাজ তজুমদ্দিনের জাহাঙ্গীর ঠিকাদার নামে এক ব্যক্তির লাইসেন্সে টেন্ডার করিয়ে, কাজ শুরু করেন তৎকালীণ এলজিইডি এর কর্মকর্তা। তিনি কাজে কিছু অনিয়ম করেন। যার প্রতিবাদ করতে গিয়েও অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। অবশেষে যতটুকু সম্ভব তার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিয়েছিলাম।
নতুন ভবন প্রস্তুত, কিন্তু এরই মাঝে কর্মকর্তাদের অনেকের নজড় পড়েছে শিল্পকলার নতুন ভবনের দিকে। অনেকে শিল্পকলার নতুন ভবনকে অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহার করার জন্য গোপনীয় ভাবে ষড়যন্ত্র করে চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয় তাদের কারো কথায় কান না দিয়ে নতুন ভবনটি আমাদেরকে বুজিয়ে দেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব শুভ দেবনাথ ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জনাব সেলিম মিয়ার সহযোগিতায় নতুন ভবনের সাজ সজ্জার জন্য আমরা আরো কিছু জিনিষপত্র কেনাকাটা করি। নতুন ভবনটি তজুমদ্দিনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে আরো উন্নতির শিখরে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
দীর্ঘ ০৪ বছরের আমি শুধুমাত্র একটি কাজে ব্যর্থ হয়েছি। ২০২০ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর শিল্পকলা একাডেমির বেহাল দশার কিছু ভিডিও চিত্র ধারণ করে তৎকালীণ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে সমস্যা সম্পর্কে অবগত করি। উনারা বিষয়টি আমলে নিয়ে তজুমদ্দিনে একটি আধুনিক শিল্পকলা একাডেমি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই অনুযায়ী জমি চেয়ে চিঠি উপজেলায় চিঠি প্রেরণ করেন। জমির পরিমাণ ছিলো সর্মনিম্ম ৬০ শতাংশ ও সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ। এই পরিমাণ খাস জমি উপজেলা চত্বর এরিয়া বা আশেপাশে না থাকায় ভবন তৈরীর কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। জমি ম্যানেজের জন্য আমি তৎকালীণ উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও উপজেলা পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সবার ধারে ধারে একাধিকবার গিয়েও কোনো সমাধান পাইনি।
সফলতা ও ব্যর্থতা সকল কিছু মিলিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে সুন্দর একটি পরিবার পেয়েছি। যেখানে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা আমাকে সন্তান/ ছোট ভাইয়ের মত ভাল জানতো। প্রশিক্ষণার্থীরা আমাকে বড় ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা করতো। সকলের কাছ থেকে আমি এত এত ভালবাসা ও সম্মাণ পেয়েছি যা কখনোই ভুলবোনা। এই মানুষগুলো আমার হৃদয়ে সারাজীবন থাকবে। বিশেষ করে আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে নৃত্য প্রশিক্ষক মুক্তা চক্রবর্তী, সংগীত প্রশিক্ষক উৎপল দে, তজুমদ্দিন হোসনেয়ারা চৌধুরী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হেলাল উদ্দিন সুমন কাকা মামুন সহ আরো অনেকেই। একটি বিষয় না বললেই নয় এই প্রতিষ্ঠানে যার হাত ধরে আমার সর্ব প্রথম আসা হয়েছে আমার বন্ধু মনিরুল ইসলাম সেও আমাকে সবসময় সহযোগিতা করে আমার পাশে ছিলো। শুরুর দিকে আমাকে উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিয়ে কাজ করতে সহযোগিতা করেছেন আমাদের তৎকালীণ নৃত্য শিল্পী ইফাজ আর রাফির আম্মু, আমার শ্রদ্ধেয় সেই আন্টির প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।
অবশেষে ২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আমার দায়িত্বের সমাপ্তি ঘটলো। তজুমদ্দিন শিল্পকলা একাডেমির পুরাতন কার্যনির্বাহী কমিটি বিলুপ্তের মাধ্যমে আমাদের বিদায় জানানো হলো। দীর্ঘ এই ০৪ বছরের পথ চলায় আমার সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ রইলো। যারা আমাকে দীর্ঘ এই পথ চলায় সহযোগিতা করেছেন পাশে ছিলেন সবার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
সাদির হোসেন রাহিম
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি
তজুমদ্দিন - ভোলা।