
11/08/2025
ছোটবেলায় একবার আমাদের বাসায় এক ভাই বেড়াতে এলেন। আমাদের কাছের সম্পর্কের কেউ না। আম্মার এলাকার মানুষ। আমি তখন স্রেফ ক্লাস থ্রিতে পড়ি।
সেই সময়ে ঢাকাতে মহল্লা ভিত্তিক মাস্তানি, রংবাজি, গুণ্ডামির হেভি চল। বিভিন্ন মহল্লায় মহল্লায় অমুক ভাই আর তমুক ভাইদের রাজত্ব। তাঁরা হেভি ভাবে চলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে মহল্লার গলির মুখে লাউড স্পিকার বসিয়ে, উচ্চ ভলিউমে গান বাজান। এই গান স্রেফ গান না। এর ভিতর নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়ার একটা ব্যাপার আছে। আধিপত্য বজায় রাখার বিষয়।
তবে গুন্ডা মস্তানদের আবার বিভিন্ন পর্যায় আছে। বাঘের উপর টাগ থাকার মতো। সিনিয়ার মাস্তান ভাইদের আমরা খুব সমীহ করি। তাদের সাথে আমার মতো আধা আঙুল কিংবা তার ফ্রেন্ড সার্কেল, দেখা হবার চান্স অতি অল্প। এই গ্রুপের ভাইদের অনেকের লম্বা চুল। কেউ মাথায় ঝুঁটি বাঁধেন, কারো থাকে কোঁকড়া, কারো আউলা। বড় চুলের সাথে হোন্ডা সি ডি আই হান্ড্রেড নিয়ে ভোঁ ভোঁ। লেদাল কম্বিনেশন।
এরপর একটা মাঝামাঝি গ্রুপ। এই গ্রুপের ভাইদের দেখতাম খালি বিভিন্ন জায়গায় প্রেম করার অপারেশনে ব্যস্ত। রাস্তার পাশে থেকে সিটি বাজানো, নিজের এলাকার কোন মেয়েকে অন্য এলাকার কোন গুন্ডা ত্যাক্ত করলে দল বেঁধে গিয়ে মারপিট করা, এলাকায় বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন করা, এই জাতীয় রাজ্যের হাবিজাবি কাজ করতো এরা। আর ছিলো এই মিডিয়াম গুন্ডা বাহিনীর চ্যালা -শিশু ফাপরবাজ দল। এরা বড় ভাই গুণ্ডাদের রেফারেন্সে বিভিন্ন ঝামেলা করতো। যেমন শবে বরাতের রাতে তারা বাত্তি কিংবা মরিচা ফাটানো এবং তা দিয়ে রাস্তা ঘাটে পাবলিককে বিরক্ত করা, বিভিন্ন সময়ে খেলার মাঝে আবোল তাবোল ডিসিসান দিয়ে আবার বড় ভাইদের রেফারেন্সে ফাঁপর দেয়া, অন্যের গাছের পেয়ারা বড়ই পারার নেতৃত্ব দেয়া ইত্যাদি। এই শেষের পার্টির সাথে প্রায়ই গ্যাঞ্জাম, মারামারি লেগে থাকতো। আম্মার কাছে বিচার আসা ছিলো কমন। দুনিয়ার দুষ্টু ছেলের দল।
যে সময়ে আম্মার সেই ময়মনসিংহ এলাকার ছেলে বাসায় এলো, তখন আমরা কমলাপুর জসিম উদ্দিন রোডে থাকি। এর আগের কিছু দিন ধরে খেলার মাঠে আমার অবস্থান খুব খারাপ। একটা ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে মারামারি হওয়াতে, ফাঁপর পার্টির হাতে আমি এবং আমার টিমের লোকজন হেনস্তা হয়েছি। হালকা চড় থাপ্পর ইনক্লুডেড। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাক ফুটে আছি। এর ভিতরে আম্মার এলাকার সেই তরুনের আগমন। আমি তাকে ভাই বলেই সম্বোধন করি।
তার কোন বিশেষত্ব নাই। শান্ত শিষ্ট চেহারা। কথা খুব কম বলেন। কিন্তু কাহিনী অন্য জায়গায়। তার কিছু একটা বড় মাপের অসুখের পর থেকে, কবিরাজের পরামর্শে মাথার চুল কাটা বারণ। সে কারণে চুল বড় হয়ে কোমরের একটু উপর পর্যন্ত। ভাই সে জন্য হাতে একটা ব্যাক আপ চুলের ব্যান্ড রাখেন আর একটা ব্যান্ড থাকে মাথার চুলে। ভাইকে দেখায় সেই রকম। তিনি সম্ভবত ডাক্তার দেখাতে এসেছেন এবং কিছুদিন ঢাকা থাকবেন।
প্রথম যেদিন সাজু ভাই বাসা থেকে বের হয়েছে, আমি সাথে গেলাম রিক্সা ঠিক করে দিতে। তিনি নিজেই পারবেন, তবুও গেস্ট এর জন্যে একটু করা আর কি! সাজু ভাই রিক্সাওয়ালা মামাকে ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই সে ১০ টাকার ভাড়া আট টাকা চাইলো। আমি তো অবাক। এই রিক্সাওয়ালাকে আমি ভালো ভাবেই চিনি। আম্মা প্রায় স্কুলে যান। সে তো এতো লিবারেল না। সাজু ভাই কাজ শেষ করে বাসায় ফিরলেন। তখন আমি বাইরে খেলছিলাম। লক্ষ্য করলাম, আমাদের ভাড়া বাসার নীচের দারোয়ান মামা সাজু ভাইকে কঠিন জোরে একটা সেলাম দিলেন। অথচ এই দারোয়ান মামার নামে সবার অভিযোগ। তার আদব লেহাজের অভাব। আমার খটকা লাগলো।
রাতে দারোয়ান মামার পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করতেই সে জিজ্ঞেস করে,"তোমার এই ভাইয়ের নাম কি?"
আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম,"ক্যান?"
দারোয়ান মামা: মানে আর কি, উনাকে দেখে খুব সম্মান আসলো মনে। খুব অমায়িক ব্যবহার। ঐ আমাগো এলাকার সানাউল ভাইয়ের মতো।
সাথে সাথে আমি ধরে ফেললাম। সানাউল ভাই হচ্ছেন ঐ সময়ে আমাদের দুইতিন মহল্লার ভিতরে সবচেয়ে নামকরা সিনিয়ার গুন্ডা। তার মানে, সাজু ভাইয়ের বেশভূষা দেখে দারোয়ান মামা এই ধারণা করেছে। আমি তো মনে মনে বেজায় খুশি। আমিও দারোয়ান মামাকে বললাম,"ঠিক বলছেন। সাজু ভাইয়ের তো ময়মনসিংহ এলাকায় সানাউল ভাইয়ের চেয়েও নামডাক।"
দারোয়ান মামার মুখে বিজয়ীর হাসি।
"আমি ঠিক জানতাম। তা ভাইজান থাকবে কতদিন?"
আমি গম্ভীর মুখে বললাম,“ঠিক নাই। একটা বিশেষ কাজে আসছেন। কাজের শেষ হওয়ার উপর নির্ভর করতেছে।”
আমি তো সত্যিই বলেছি। উনার চিকিৎসা শেষে চলে যাবে। কিন্তু দারোয়ান মামা বুঝলো না জানি না কি কাজ। তার মুখ শুকনা। আমি বাসায় চলে এলাম। আম্মা ডিম আনতে দোকানে পাঠিয়েছিলেন। আমি জানি দারোয়ান মামা, কাল দুপুরের ভিতরে এই নিউজ চাউর করে দিবে।
পরদিন বিকালে খেলার আয়োজন হয়েছে, আমাদের বাসার পিছনের গলিতে। ক্রিকেট খেলি। আমাদের টিমের সবাই আমাকে যাওয়া মাত্র ঘিরে ধরলো। "শুন শুন, তোদের বাসায় নাকি সানাউল ভাইয়ের চেয়েও বড় এক ভাই আসছে। অনেক লম্বা চুল। ভয়ংকর চেহারা!"
আমি কিছু বলি না। কেবল মুচকি মুচকি হাসি। ওদের কৌতূহল, ভয় আরও বাড়ে।
পরদিন সকালে আমি সাজু ভাইকে নিয়ে অযথাই গলিতে ঘোরাফেরা করি, ড্রাই রান দিই। আশেপাশে সবাই আড়চোখে তাকায় আর ফিসফিস করে কথা বলে।
সেদিন বিকালে আমাদের সেই রাইভাল পার্টি- ফাঁপর গ্রুপের সাথে ক্রিকেট খেলা। আমরা সবাই অন্য লেভেলের কনফিডেন্ট। আমি সাজু ভাইকে ইচ্ছা করেই খেলা দেখতে নিয়ে এসেছি।
সাজু ভাইকে দেখার পর থেকেই অন্য দলের পোলাপানের মুখ শুকনা। আর আমার দলের খেলোয়াড় পাজিগুলো গায়ে পরে কথা কাটাকাটি করছে। এক পর্যায়ে রান চুরি করা নিয়ে তুমুল ঝগড়া। ফলে মারামারি। আমার দলের পিচ্চিরা ঐ দলের সবগুলোকে রীতিমতো দৌড়ানী দিলো।
আমাদের আর পায় কে! আমি তো বন্ধুদের কাছে ভার্চুয়াল হিরো। আসল হিরো তো সাজু ভাই। তবে সাজু ভাই এই ব্যাকগ্রাউন্ড ঘটনার কিছুই ধরতে পারলেন না।
সাজু ভাই আরও দুই সপ্তাহ বাসায় ছিলেন। আমি সেই দুই সপ্তাহ হেভি পার্টে চলাফেরা করেছি। মাঝে মাঝেই সাজু ভাই সহ আজাইরা ঘুরাফেরা করতাম।
সাজু ভাই যেদিন চলে যাবেন, আমি রীতিমতো আপসেট। এক পর্যায়ে কেঁদে ফেললাম। সাজু ভাই ভাবলেন, মমতায় কাঁদছি। আম্মা তো অবাক। এমন কি মহব্বত হলো! আমি তো কাঁদছি ভয়ে। সাজু ভাই চলে গেলে পিটুনি না খাই।
যাহোক। সাজু ভাই যাবার পর কয়েকদিন খেলতে বের হই নাই। কিছুদিন পর যখন আবার বের হলাম, দেখলাম সবকিছুই আমাদের ফেভারে আছে। আমি আবারো সেই কনফিডেন্স নিয়ে ঘুরি, ক্রিকেট খেলি, পিচ্চি ফাঁপর দেয়া গ্রুপকে কাউন্টার ফাঁপর দিয়ে চলি। আমার বন্ধুদের কাছে তো আমি খুব সম্মান পাই। আর সুযোগ পেলেই ইনিয়ে বিনিয়ে সাজু ভাইকে নিয়ে ম্যালা কাল্পনিক গল্প ফাঁদি। সবার চোখে আমার প্রতি সমীহ আরও বেড়ে যায়।
মনে মনে সাজু ভাইকে ধন্যবাদ দিই, আমার ভার্চুয়াল হিরো। আর দোয়া করি,"হে আল্লাহ্, কবিরাজ আংকেল যেন কোনদিন সাজু ভাইকে তার এতো সুন্দর চুল কাটার ক্লিয়ারেন্স না দেয়। প্লিজ আল্লাহ্।"
(সাজু ভাইয়ের কাল্পনিক ফাঁপরে আমি আরও লম্বা সময়ে এলাকায় পার্টে চলেছি) 😎
#মানবজমিন
#বান্দরের_বাচ্চা_চার_কোনাইচ্চা