17/05/2025
ইতালির স্বপ্নে লিবিয়ার দুঃস্বপ্ন, শরীয়তপুরের ২ যুবকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা Nasim On The Rove
১৭ মে, ২০২৫
দিনের পর দিন একটি ছোট্ট ঘরে বন্দী জীবন, অমানবিক নির্যাতন, নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায়—এই করুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন শরীয়তপুরের দুই যুবক। কখনো এক চক্রের হাতে, কখনো অন্য চক্রের কাছে বিক্রি হয়ে অবর্ণনীয় দুঃসহ যন্ত্রণা সয়ে অবশেষে বেঁচে ফেরা—সব কিছু এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও ইউনিয়নের মনুয়া গ্রামের দুলাল ছৈয়ালের ছেলে আলতাফ হোসেন ছৈয়াল (৩০) এবং একই উপজেলার আইজারা গ্রামের আবদুল গনি বলির ছেলে আহসান উল্লাহ বলি (৩০) লিবিয়া থেকে ফিরে এখনো শারীরিকভাবে অসুস্থ ও দুর্বল। দুজনেরই ওজন অনেক কমে গেছে।
গত সোমবার (১২ মে) দুপুরে আহসান উল্লাহ বলির বাড়িতে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। সেখানে পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। কথা বলতে বলতে দুজনই বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। বারবার ফিরে আসছিল লিবিয়ার বিভীষিকাময় স্মৃতি।
আলতাফ হোসেনের বাবা দুলাল ছৈয়াল জানান, স্থানীয় দালাল হারুন লস্করের কথায় আস্থা রেখে তিনি ছেলেকে ইতালি পাঠাতে রাজি হন। দালাল জানিয়েছিলেন, মোটা বেতনের চাকরির সুযোগ রয়েছে ইতালিতে, তবে এ জন্য দরকার হবে বিপুল অর্থ। এরপর ধারদেনা, ঋণ ও জমি বিক্রি করে পর্যায়ক্রমে দালালের হাতে টাকা তুলে দেন। পরিকল্পনা ছিল—দুবাই ও মিসর হয়ে ছেলেকে লিবিয়া পৌঁছে দেওয়া হবে, সেখান থেকে যাবে ইতালি।
কিন্তু সব কিছুই এক ভয়ঙ্কর প্রতারণার গল্পে পরিণত হয়। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আলতাফ ভারতের পথে রওনা হয়ে পরে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছান। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় লিবিয়ায়। প্রথমে চার লাখ টাকা অগ্রিম নেওয়া হয়, পরে লিবিয়া পৌঁছার পর আরও ১২ লাখ টাকা দেওয়া হয় দালাল হারুন লস্করকে।
লিবিয়ায় গিয়ে আলতাফকে রাখা হয় একটি ছোট ঘরে, যেখানে আরও ৩০–৩৫ জন ছিলেন। পরে একাধিক ক্যাম্প ঘুরিয়ে তাঁকে বন্দী রাখা হয় প্রায় দুই মাস। ১৩ নভেম্বর তাকে একটি কাঠের নৌকায় তুলে পাতানো এক ‘গেম’-এর মাধ্যমে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পুলিশের কাছ থেকে উদ্ধার করে একটি গুদামে নিয়ে শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। মারধর, ভয় দেখানো, বাড়িতে ফোন দিয়ে টাকা দাবি—সবই চলতে থাকে একটানা।
এভাবে ধাপে ধাপে তার পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় মোট ৬৫ লাখ টাকা। ২৯ ডিসেম্বর ও ৩১ ডিসেম্বর আবারও একই কায়দায় দুই দফায় সমুদ্রে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় দফায় নৌকায় পানি উঠে গেলে আবারও উদ্ধার করে চক্রটি। তখনও আদায় করা হয় মুক্তিপণের টাকা। সব টাকা লেনদেন হয়েছে দালাল হারুন লস্করের মাধ্যমেই।
অবশেষে আট মাস পর শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি ফেরেন আলতাফ। একই অভিজ্ঞতা ভাগ করেছেন আহসান উল্লাহ বলি। তিনিও জানান, লিবিয়ায় পৌঁছেই তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়, রাখা হয় অন্ধকার কক্ষে। পালানোর চেষ্টা করলে মারধর করা হতো, দেওয়া হতো বৈদ্যুতিক শক, প্লাস দিয়ে নখ উপড়ে ফেলা, বৈদ্যুতিক তার দিয়ে পেটানো এবং দিনের পর দিন অনাহারে রাখা—এই ছিল তার প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতা।
৭ মে তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়ি ফেরেন। তিনি বলেন, ‘‘মানব পাচার চক্র শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও সক্রিয়। মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত প্রবাসীরা এই চক্রের অংশ। ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখে, আদায় করে মুক্তিপণ। আমার পরিবার থেকে ৬৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। অনুরোধ করব, কেউ যেন আর এই দালালদের ফাঁদে পড়ে লিবিয়া না যান।’’
এ ঘটনায় তিনি ছয়গাঁও বাংলা বাজার এলাকার হারুন লস্কর, তাঁর ছেলে পাপ্পু লস্কর ও ইমন লস্করের বিরুদ্ধে ভেদরগঞ্জ থানায় অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগ সম্পর্কে ভেদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ আহমেদ বলেন, শুক্রবার সকালে অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে সঠিকতা মিললে মামলা রুজু করা হবে।
অন্যদিকে দালাল হারুন লস্কর বলেন, “ঢাকা ও ফরিদপুরের কয়েকজনের মাধ্যমে আমার ছেলেদের বিদেশ পাঠিয়েছি। আহসান ও আলতাফের পরিবারের কাছ থেকে আমি কোনো টাকা নিইনি। এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণও নেই।”
ভুক্তভোগী আহসান উল্লাহ বলির মা লুৎফা বেগম বলেন, “আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। ইতালি নেওয়ার কথা বলে আমার ছেলেকে লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে জীবনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখন লাখ লাখ টাকা দেনা। পাওনাদাররা বাড়িতে এলে পালিয়ে থাকতে হয়। পরিবারটাই ভেঙে দিয়েছে ওরা। আমি এর বিচার চাই।”
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম জানান, বিষয়টি তাঁর জানা আছে। দালালের মাধ্যমে দুই তরুণ লিবিয়ায় গিয়েছিলেন এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফিরেছেন। যারা প্রলোভন দেখিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি পাচারকারী চক্র চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।