
08/09/2025
রাত একটা।
বাড়ির নীচে ঘুটঘুটে অন্ধকার। স্ট্রিট লাইটের ক্যাপিটালিস্ট সাদা আলোয় জায়গাটাকে অভাবনীয় ডিপ্রেসিং লাগছে। আমি সিগারেটে আগুন দিলাম। নীরবতায় ছন্দ তুললো তামাক পোড়ার কটকট শব্দ। ঠিক এ সময়, একদম হুট করে আমার মনে পড়ে গেলো তার কথা। বহু বছর আগে, আশ্বিনের আসি আসি বাণী যখন ইউক্যালিপটাসের কানে ফিসফিস করছিলো; ঠিক সে সময় আমার দেখা হয়েছিলো তার সাথে। দ্য গ্রেট পোয়েট অব বৃহত্তর মগবাজার। সবাই তাকে চিনতো তাউড়া আসলাম নামে। যার আসল, কিংবা ভালো নাম ছিলো আশেকে রাসূল রাব্বানা মতিউর বিন আসলাম।
তার সাথে আমার পরিচয় অপরিচিত এক সেলুনে। ছাত্ররা তখন স্বৈরাচার এরশাদের গদিতে লাথি দেওয়ার জন্য উত্তাল। চেষ্টা করছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। জাতীয় পার্টি গঠন করে তিনি ক্ষমতার বৈধতা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর আমরা একের পর এক মিছিল করে তার চান্দি গরম করে দিচ্ছি। দেওয়ালে পোস্টার, কিংবা স্লোগান লিখতে গিয়ে পুলিশের ধাওয়া, মার কিংবা জেলে যাওয়া তখন প্রতিদিনের স্বাভাবিক ঘটনা। আরামবাগের এক দেওয়ালে চিকা মারার সময় আমি এবং আমরা ক’জন ধাওয়া খেলাম একদিন। একটা পর্যায়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে আশ্রয় নিলাম অর্ধেক শাটার নামানো এক সেলুনে। তড়িঘড়ি করে নাপিতের চেয়ারে বসে ইশারায় বললাম, দাড়ি কামিয়ে দেন। ঝামেলা আছে। ব্যাটা একবারেই বুঝে গেলো, আমি বেঁচে গেলাম। এমনিতেই মেজাজ খারাপ। তার উপর পাশের চেয়ারে বসে থাকা আরেক তরুণ বললো, লাভ নাই বৎস। ওকে নামায় লাভ নাই। বদলে যায় রাজারা, থেকে যায় তার ছায়া।
জিজ্ঞেস করলাম, কি বলতে চান?
উনি বললেন, গণতন্ত্র তৈরি করা হয়েছে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচার তৈরি করার জন্য। যে-ই ক্ষমতা যাবে, সে-ই ক্রমশ “মনস্টার” হয়ে উঠবে।
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে প্রশ্ন করলাম, ছাত্র ইউনিয়ন?
উনি উত্তর দিলেন না। শুধু মুচকি হাসলেন।
আমার পিত্তি জ্বলে গেলো। দেখে মনেহচ্ছে আমার বয়সী। অথচ আমাকে বললো, বৎস!
আমি আর কোন কথা বললাম না। দাড়ি কামানো শেষে বিদায় নিলাম। নিয়তি তার সাথে আমার আবার দেখা করিয়ে দিলো আনিসুল হকের বাড়িতে। তখন সেখানে শুক্রবার করে কবিতা পাঠের আসর বসে। তিনি পেছনের সারি থেকে আমার পিঠে খোঁচা দিয়ে বললেন, কেমন চলছে আন্দোলন?
আমি বললাম, অমায়িক।
সেদিন প্রথম ঠিকঠাক কথা হলো আসলাম ভাইয়ের সাথে। আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র। ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট। কাজ করেন দৈনিক ইত্তেফাকে। আমাকে বললেন, কবিতা-টবিতা লিখো নাকি?
বললাম, জি।
বললেন, পড়তে দিও।
আমি তেমন কিছু না ভেবেই ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে এর ঠিক আগের রাতে নাযিল হওয়া দু’টা কবিতা ধরিয়ে দিলাম।
এক সপ্তাহ পর সাহিত্য পাতায় নিজের কবিতা দেখে আউলে গেলাম। বহু কষ্টে তাকে খুঁজে পেলাম প্রেস ক্লাবের সামনে এক ভাতের হোটেলে। উনি আমাকে বললেন, তুমি তো দুর্দান্ত লেখো মিয়া!
কবি হিসেবে সেটাই ছিলো আমার জীবনের প্রথম প্রশংসাসূচক বাক্য।
এরপর আসলাম ভাইয়ের সাথে ঘটিষ্ঠতা হলো। কঠোর বামপন্থীর ভাবধারায় বিশ্বাসী তিনি। বলতেন, ক্যাপিটালিজম টিকে আছে পাতি বুর্জোয়াদের উপর। এদের হটাতে পারলেই একদিন বিপ্লব আসবে। সাম্যের বাংলাদেশ কায়েম হবে। তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আজিমভ, পো, মিলান কুন্দেরার সাথে। বৃষ্টি আসলেই তিনি টেলিফোন করে বাসায় দাওয়াত দিতেন। মারাত্মক রান্না করতেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চমার্গীয় কবি। কিন্তু নিজের লেখা কোথাও ছাপাতেন তো না-ই। পড়তেও দিতেন না। নিউজপ্রিন্ট কাগজে পেন্সিল দিয়ে লিখতেন। প্রতি রবিবার নিয়ম করে সব পুড়িয়ে ফেলতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, কবিতাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা স্বয়ং ঈশ্বরেরও নাই। আমি কোন শাউয়ার বাল?
খুব সাবধানে একবার তার লেখার টেবিল থেকে একটা কবিতা চুরি করেছিলাম। তখন আমি দৈনিক বাংলায় কাজ করি। ইচ্ছে ছিলো ছাপিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দিবো। কবিতার ছাপানোর পরদিন আমি তার সাথে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারলাম, চারদিন ধরে তিনি নিখোঁজ। মাসখানেক আগে একটা রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই হুমকি ধামকি দেওয়া হচ্ছিলো। রাত এগারোটার দিকে কয়েকজন লোক তাকে ডেকে নিয়ে যায় বাসা থেকে। এরপর থেকে আর কোন হদিস নাই।
আসলাম ভাইয়ের কবিতা ছাপানো পত্রিকার সেই কপিটা আমার আমার লাইব্রেরিতে এখনও আছে। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে লেখাটা পড়তে। কিন্তু ইচ্ছে করে না। কারণ কবিতাকে পৃথিবীতে আনা যায় না। তাকে আসতে হয়। কবিতাকে অনুভব করা যায়। স্পর্শ করা যায় না। এবং আসলাম ভাইয়ের ভাষ্যমতে, এই স্পর্ধা স্বয়ং ঈশ্বরেরও নাই।
কারণ তিনি নিজেই কবিতা।
স্বৈরাচারের পতন হওয়ার পর আমি আসলাম ভাইকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম।
----
শোকাহত, শুকিয়ে যাওয়া খটখটে চোখের মতো নির্বাক শীতার্ত এ পথে
শিমুলের কাঁটার মতো বিঁধে থাকে পড়ন্ত যৌবনা গোল্ডলিফ সিগারেট
অর্ধেক শাটার নামানো কসাইঘরের হলদে টিমটিমে আলোকে সঙ্গ দিতে।
শত-শত কালজয়ী কলমের সাক্ষী ব্যর্থ অনামিকা ও মধ্যমা –
নিজেদের শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়ায় আসমান থেকে ভেসে আসা
কর্কটের গন্ধ; ঘণ্টাখানেকের জন্য।
তাহাজ্জুদের এ লগ্নে, ঘর্মাক্ত অন্ধকার ও ক্লান্তি-যাপনে জর্জরিত
অসংখ্য ভিখারি হাত তোলে, মওলার উচ্ছিষ্টের আশায় বুক বাঁধে।
হিমালয় থেকে ভেসে আসছে বাতাস
বরফগলা কাঁচবন্দি কোমলপাণীয়কে দু’হাতে চেপে ধরে
ঠান্ডা হতে চাওয়া শরীর পৌষকে ভয় পেয়ে কম্বল খুঁজবে আর ক’দিন বাদেই।
সেখানে মাথা লুকিয়ে অনুভব করা অন্ধকারের সাথে
মাটির অন্তিম আঁধারের তফাৎ জানানোর জন্য
এ জাহানে এখন আর কেউ বেঁচে নেই।
- মার্কস, একজন ব্যার্থ কবি, স্বাধীন বাংলার আখেরী বিবাগীদের একজন হয়তো.....!!!