
28/06/2025
বাংলায় মার্ক্সচর্চার ভিন্ন জমিন
১৮৬৯ থেকে ২০২৫, কার্ল মার্ক্সের পুঁজি বইটির ১৫০ বছর পেরিয়েছে। এই বই নিয়ে আলোচনা আর সেটিকে ভিত্তি করে লেখালেখি এখনো সমান মাপে চলছে। তবে এটা বেদনার যে বাংলায় এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চর্চা ও আলোচনার পারম্পর্য ও ধারাবাহিকতা একেবারে নেই বললেই চলে।
মার্ক্স–সংক্রান্ত আলোচনার সূত্রপাত বাংলায় যা হয়েছে, তার মধ্যে মার্ক্সের নিজের লেখা বই ও তাঁর লেখালেখি প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়েছে খুব কম। এর কারণ হচ্ছে, এটাকে একটা মতাদর্শ হিসেবেই গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে বাস্তবতার চেয়ে আবেগটাই প্রবলভাবে কাজ করেছে। কিন্তু মার্ক্সের কাছে, আমরা যে সমাজে বাস করি, সেই বাস করা বাস্তব সমাজই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন মার্ক্স তাঁর পুঁজির প্রথম খণ্ডের জার্মান সংস্করণের দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমি বইটি লিখছি তাঁদের জন্য, যাঁদের নিজেদের মতো করে ভাবার সাহস আছে।’
মার্ক্স আমাদের ভাবনার একটা ভিত্তি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বদলে আমরা মার্ক্সের লেখাকে একটা আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। ফলে মার্ক্সের চিন্তার চর্চা এখানে খুব গভীরভাবে হয়নি। তাঁর যেসব মৌলিক গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়েছে, তার খুব কম অংশ আমরা নিজেরা করেছি। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে সেগুলো বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছিল। মার্ক্সের পুঁজি গ্রন্থটিও সেই প্রক্রিয়ার বাইরে নয়।
অন্যদিকে আমরা দেখি যে রুশ ভাষা, চীনা ভাষা ও পশ্চিমা ভাষাগুলোয় মার্ক্সকে নিয়ে লেখালেখি ও চর্চা ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে। মার্ক্সকে নিয়ে চিন্তার চর্চা এসব ভাষায় প্রবলভাবে বিরাজমান।
দুই.
মার্ক্সের পুঁজিকে অর্থনীতির বই হিসেবে দেখাটা সমস্যাজনক। কেননা, মার্ক্স পুঁজি লিখতে গিয়ে, অর্থনীতি নামে যে শাস্ত্র দাঁড়িয়ে ছিল, তার বিরোধিতা করেন। কার্ল মার্ক্সের পুঁজি: একটি পাঠ পর্যালোচনা (প্রথম খণ্ড) বইয়ের ভূমিকায় লেখক আনু মুহাম্মদ মার্ক্সকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘বুর্জোয়া অর্থনীতির বিজ্ঞান হিসেবে অর্থনীতি তার শেষ সীমায় উপস্থিত হয়েছে’। এই বক্তব্যকে আমরা প্রবলভাবে উপলব্ধি করি, যখন দেখি অর্থনীতি নামের শাস্ত্রে মানুষের উপস্থিতি নেই।
এই শাস্ত্র লাভ, ক্ষতি, চাহিদা, জোগানের মতো বিমূর্ত সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও এসব বিষয়ের স্রষ্টা মানুষ সেখানে একেবারেই অনুপস্থিত। মার্ক্স মূলত মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন অর্থনীতিকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। ফলে মার্ক্সের চিন্তাকে আমরা যখন তথাকথিত ‘অর্থনীতি’র বিষয় হিসেবে পাঠ করতে যাই, তখনই সমস্যাটা তৈরি হয়। কেননা, মার্ক্স কোনো অর্থনীতির বই লেখেননি।
এটাকে স্বীকার করা ছাড়া পুঁজি পাঠ করতে যাওয়াটা পুরোটাই একটা পণ্ডশ্রম। এই জায়গাতেই আনু মুহাম্মদ তাঁর বইতে পুঁজি পাঠের যে পর্যালোচনা দাঁড় করিয়েছেন, সেটা আমাদের এখানে মার্ক্সচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কেননা, মার্ক্সের মৌলিক রচনার সরাসরি পাঠ আমাদের এখানে শুরু হয়েছে কালের বিচারে খুব সম্প্রতি। যত দিন পর্যন্ত ‘মার্ক্সবাদ’ নামের বিষয়টি এখানে প্রবল প্রতাপে উপস্থিত ছিল, তত দিন পর্যন্ত এটার প্রয়োজনীয়তা কেউ উপলব্ধি করতে পারেননি। কিন্তু উপলব্ধিটা যে শুরু হয়েছে, তারই একটা দৃষ্টান্ত এই বই।
আমাদের এখানে এখন ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ—সব ধরনের পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের বাস্তব জীবন। মার্ক্স বলেছিলেন, জার্মানরা সব সময় স্কুলছাত্রের মতোই থেকে গেছে। আমাদের এখানকার অর্থনীতি ও রাজনীতিচর্চার দিকে তাকালে আমরাও একই বাস্তবতা দেখতে পাব।
এই পটভূমিতে আমরা যদি মনে করি যে বাস্তব মানুষ ও তার সমস্যাকে রাজনীতি ও ‘অর্থনীতি’র কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে, তাহলে যে বিশাল একটা প্রয়াস দরকার, সেই প্রয়াসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আনু মুহাম্মদের কার্ল মার্ক্সের পুঁজি: একটি পাঠ পর্যালোচনা (প্রথম খণ্ড) বইটিকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি। বইটি মার্ক্সের চিন্তার জমিন সম্পর্কে পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে আশা করি।
কার্ল মার্ক্সের পুঁজি: একটি পাঠ পর্যালোচনা (প্রথম খণ্ড)
আনু মুহাম্মদ প্রথমা প্রকাশন, এপ্রিল ২০২৫ পৃষ্ঠা: ২১৬, দাম: ৫৫০ টাকা