
17/06/2025
প্রথমে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করুন। কোনমতে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করুন। ন্যূনতম প্ল্যানিং ছাড়াই বাচ্চা পয়দা করুন। এরপর শুরু করুন আসল গেম …
যেহেতু আপনার বেশি টাকা নেই, তাই আপনার সন্তানকে একটি বাল-ছাল স্কুলে ভর্তি করান। সবচেয়ে ভালো হয় সরকারি স্কুল কিংবা হালকা-পাতলা নাম আছে – এমন কোনো স্কুলে ভর্তি করালে। কারণ আপনি যেই সমাজে থাকেন, সেখানে তথাকথিত সরকারি স্কুল কিংবা কিঞ্চিৎ নামী স্কুল একটা স্ট্যাটাসের বিষয় হলেও সেখানে পড়াশোনার নামে হয় না বাল্ডাও। সেখানে শিক্ষকেরা একটা প্রাচীন, ধ্বজভঙ্গ সিলেবাস ধরে পড়ায়; যার মূল উদ্দেশ্য দু’টো। এক, এই শিক্ষকরা যাতে সহজে বেতন নিয়ে বাসায় গিয়ে প্রাইভেট বাণিজ্য করতে পারে। আর দুই, সরকার যেন ভবিষ্যত প্রজন্ম হিসেবে থটলেস, ব্রেইনলেস, কনফিডেন্সলেস গ্রুপ অব স্লেইভস পায়। যাদের পলিটিক্যালি, রিলিজিয়াসলি, ন্যাশনালি ম্যানিপুলেট করা সুপার ইজি। অবশ্যই এমন স্কুলে ভর্তি করবেন, যেন আপনার সন্তান স্কুলের নাম শুনলেই কাঁদে। স্কুলের যে এমন হওয়া উচিত, যে বাচ্চারা সেখানে আগ্রহ নিয়ে যেতে চাইবে – এসব জানার আপনার প্রয়োজনই নেই। উল্টো শিক্ষকেরা ধরে মারধোর, গালি-গালাজ করলে সন্তানকে বলবেন, ঠিকই তো আছে!
এবার শিশুর যে মানসিক বিকাশ দরকার, সেটা সম্পূর্ণ ভুলে যান। ঢাকায় এমনিতেই খেলার জায়গা নেই, তাই সন্তানকে খেলাধুলা করানোর প্রশ্নই আসে না। এছাড়াও যে সকল অ্যাকটিভিটি এ বয়সে ব্রেইনের ক্যাপাসিটি বাড়ায়, স্মার্ট বানায়, সেসব নিয়েও কোন চিন্তাই করবেন না। বাচ্চাদের মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট, আঁকা-আঁকি, বই পড়া, টুক-টাক লেখালিখি তথা যেকোনো প্রকারের ক্রিয়েটিভিটির চর্চা শেখানোকে চোদনামি ভাবুন। তাকে বাসায় একটা ফোন দিয়ে আটকে রাখুন। সোশ্যালাইজিং স্কিল তাতে পুটুম্রা খাক, সেসব মোটেও আপনার মাথা ব্যথা হওয়ার কথা না।
এরপর একটু বড় হলেই তাকে বোঝান যে সে যদি এ+ না পায়, সমাজে আপনাদের মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না। তাকে চরম প্রেশারে রাখুন। সবচেয়ে ভালো হয় আপনার পরিমন্ডলে থাকা বাচ্চাদের সাথে তাকে প্রায়ই কম্পেয়ার করলে। তাকে বলুন, যে অমুকেও ভাত খায়। তুইও খাস। ও পারে, তুই পারিস না ক্যান? তার সামনে কয়েকটা লক্ষ্য বেঁধে দিন। বলুন যে পৃথিবীর একমাত্র পেশা হচ্ছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার আর নাহলে বিসিএস ক্যাডার। এগুলো না হতে পারলে জীবনের কোন অর্থ নেই …
তাকে চরম স্ট্রাগল করে মেট্রিক, ইন্টার পাশ করতে দিন। তারপর শুরু করুন গেমের দ্বিতীয় অধ্যায়। তাকে বোঝান, যে পাবলিকে চান্স না পেলে তোমার জীবন শেষ। আপনার সমস্ত চেষ্টার পরও যে যদি ভুলেও কোন হবি বা স্কিল ডেভলপ করে, সেসবকে অপ্রয়োজনীয় বোঝাতে আপনার সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে সেটাকে ধ্বংস করার এটাই প্রকৃত সময়। তাকে ডিপ্রেশন, এনজাইটি, সোশ্যাল অকওয়ার্ডনেস ডেভলপ করতে সাহায্য করুন। তাকে বলুন যে তার পড়াশোনা ও খাওয়ানোর পেছনে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, তাকে “এই পর্যায়ে” নিয়ে আসতে আপনার কি পরিমাণ বাল ছিঁড়তে হয়েছে …
তারপর সে যদি পাবলিকে চান্স পায়, তো ভালো। আর বাই এনি চান্স না পেলে যদি তাকে ন্যাশনাল কিংবা প্রাইভেটে ভর্তি করাতে হয়, তাহলে তাকে প্রতিনিয়ত সে যে কতোবড় অথর্ব, সেটা মনে করিয়ে দিতে ভুলবেন না। ভার্সিটিতে উঠে সে যখন দেখবে তার আশে-পাশের পোলাপান সোশ্যাল স্কিলে অনেক স্মার্ট, ভালো ইংরেজি বলতে পারে, ট্রেন্ডিং স্কিল আছে, ক্রিয়েটিভ স্কিল আছে, মোদ্দাকথা যে যখন লেফ্ট আউট ফিল করবে, তখন তাকে বলুন, মানুষের পোলাপান কতো কিছু পারে, আর তুই?
তাকে বোঝান যে, যেহেতু আপনি গরিব, আপনি জীবনে একটা বালের চাকরি ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি, তাই তাকে ইনস্যুরেন্স পলিসি হিসেবে পয়দা করেছেন। আপনি, আপনার পরিবার, আপনার খানদান যে অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করেছেন, তা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ যে আপনার সন্তান; এ জিনিসটা তার মাথায় ঢুকিয়ে তাকে প্রেশার দিয়ে পাগল বানিয়ে দিন। ডিপ্রেসড হলে, মাথায় সুইসাইডাল থট আসলে তাকে বলুন যে মোবাইল না টিপলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
এভাবে সে কোনমতে ভার্সিটিটা পাশ করা মাত্র শুরু করুন গেমের তৃতীয় অধ্যায়। চাকরি না পাওয়া অবধি সে যে পরিবারের একটা বোঝা, সেটা প্রতিদিন মনে করিয়ে দিন। মানুষের ছেলে-মেয়ে কত এগিয়ে গিয়েছে, কার বেতন কত, কে কত ভালো পজিশনে আছে – এটাকেই বাসার প্রধান আলোচনায় নিয়ে আসুন। তাকে বলুন এন সংখ্যক মাইল হেঁটে, এক্স সংখ্যক কিলোমিটার নদী সাঁতরে আপনারা পড়াশোনা করে “এই পর্যায়ে” এসেছেন। সে “সবকিছু” পেয়েও কেন পারছে না?
এরপর শুরু করুন গেমের ফাইনাল স্টেজ।
তাকে বোঝান যে আপনাদের বয়স বাড়ছে। আর বেশিদিন পৃথিবীতে থাকবেন না। সন্তানের বৌ/জামাই দেখতে চান। দাদা-দাদী, নানা-নানী ডাক শুনতে চান। এদিকে তাকে সমাজের বোঝা হিসেবে বড় করায় তাকে যে কেউ পাত্তাই দেয় না, সেটা নিয়ে আপনার ভাবার কোন দরকার নেই। তাকে জোরপূর্বক পাত্র-পাত্রী দেখানো শুরু করুন। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ বিষয়টা সিস্টেমেটিক। কে কি পাচ্ছে, সেটা অনেকাংশেই মূখ্য। আপনার সন্তানের যে কিছুই দেওয়ার নেই – এই তথ্যটা তখনই তার মাথায় সেট করে দেওয়ার আদর্শ সময়। প্রতিটা চাকরির পরীক্ষা/ইন্টারভিউয়ের আগে তাকে প্রেশারে রাখুন, রেজাল্ট শুনে মুখ কালো করে এমনভাবে “কি সন্তান জন্ম দিয়েছি” বলুন, যেন সে ভাবে বাচ্চা পয়দা করার পরিকল্পনাটা আপনাদের ছিলো না, বরং সে-ই উপর থেকে আপনাদের সিগন্যাল দিয়েছিলো পয়দা হওয়া জন্য।
এভাবে ধীরে ধীরে আপনার সন্তানের জীবনটা তছনছ করে দিন।
দেখবেন, প্রচন্ড লালো ভাগবে।
🤡🤡🤡