03/11/2025
সকাল তখন দশটা। সূর্য ঝাঁ-ঝাঁ করে মাথার ওপরে তাপ ছড়াচ্ছে। রিক্সাভ্যান চালক রীতা প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে, তার কপালে মুক্তোর মতো ঘাম জমছে। শহরের প্রধান সড়কের এই অংশটা সবসময়ই ব্যস্ত থাকে। রীতার ভ্যানটা একবার থামে, একবার চলে।
তার বুকের কাছে একটা সাদা কাপড়ে মোড়া পুঁটলি, সেটাই তার সব। পুঁটলির ভেতরে তার দু'মাসের সন্তান, রতন। রীতা শাড়ি-আঁচল দিয়ে রতনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, যাতে ঝাঁকুনিতে সে ঘুমিয়ে থাকে। রিক্সার প্যাডেল যত ঘোরে, রতনের ছোট শরীরটা তার হৃদস্পন্দনের তালে তালে দোলে।
আজ সকালে ঘরে এক মুঠো চালও ছিল না। রীতার স্বামী গত বছর টাইফয়েডে চলে গেছেন। তার পর থেকে এই রিক্সাভ্যানটাই তার জীবন, আর রতন তার বেঁচে থাকার কারণ। প্রথম প্রথম লোকে কথা বলতো— "কোলে বাচ্চা নিয়ে রিক্সা টানে! লজ্জা করে না?" রীতা কান দেয়নি। সে জানে, এই প্যাডেল না চালালে, তার সন্তান অভুক্ত থাকবে।
একটা চড়া রোদের দুপুরে একজন যাত্রী নেমে গেলেন। রীতা পথের ধারের একটা বড় গাছের নিচে রিক্সা থামালো। আঁচল সরিয়ে দেখল, রতন ঘামে ভিজে নেয়ে গেছে, কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার ছোট মুখে দুধের হালকা গন্ধ। এই মুহূর্তে রীতার পৃথিবীর সব কষ্ট যেন এই শান্তির মধ্যে একটুক্ষণের জন্য থমকে গেছে।
সে জল পান করল, তারপর আলতো করে রতনের কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল, "শক্ত হ মাণিক, তোর জন্যেই তো মা এত দৌড়োচ্ছে।"
ঠিক তখনই একটা লোক এসে চেঁচিয়ে উঠল, "এই রিক্সা! যাবে নাকি? তাড়াতাড়ি চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
রীতা আবার প্যাডেলে পা রাখল। তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু হৃদয়ে এক অদম্য শক্তি। এই শহর জানে না, একজন মায়ের বুক শুধু ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে তৈরি হয় না, এটা ইস্পাতের মতো ধৈর্য আর ত্যাগেরও একটা আধার। রতন তার বুকের ওপর ঘুমিয়ে আছে, আর রীতা সেই ঘুমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শহরের ব্যস্ত রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। তার জীবনটা দুই মিনিটের গল্প নয়, এটা প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের এক নীরব সংগ্রাম।