26/03/2025
গল্প : ১২
নাম : রক্তে লেখা স্বাধীনতা
রাত যেন আজ অভিশপ্ত। অন্ধকারটা আরও ঘন হয়ে এসেছে, ঢাকার বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ। পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ির সাথে মিশে আছে পোড়া মানুষের মাংসের গন্ধ। মাঝে মাঝে বিকট শব্দে ধাক্কা খাচ্ছে বুক, মনে হচ্ছে পুরো শহরটা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে চলেছে।
আজ ২৫ মার্চ, ১৯৭১।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রক্তের বন্যা বইছে। পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে ছাত্রদের ওপর। কেউ কেউ বাঁচার জন্য হাত তুলেছে, কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, কিন্তু করুণার লেশমাত্র নেই হানাদারদের চোখে!
জগন্নাথ হলের ভেতরঃ-
রফিক দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শ্বাস বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করছে। তার সামনে হলের উঠোনে সারি সারি ছাত্র দাঁড় করানো, সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানি সেনারা—ঠান্ডা চোখে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙালিদের দিকে তাকিয়ে।
“ফায়ার!”
এক মুহূর্তের জন্য রাত স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর ভেসে এল বিকট শব্দ, আর্তনাদ, বুলেটবিদ্ধ শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ার শব্দ!
রফিকের গা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। সে জানে, এবার ওদের পালা!
সে থেমে থাকল না। পেছনের জানালার গ্রিল ভেঙে নিচে ঝাঁপ দিল, তারপর এক দৌড়ে পেছনের গলির দিকে ছুটতে লাগল। পেছনে তখনও শোনা যাচ্ছে চিৎকার, গুলি, আগুনে পুড়তে থাকা মানুষের হাহাকার!
ধানমন্ডির দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল সে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই শুনল এক হৃদয়বিদারক সংবাদ—
“শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি সেনারা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে!”
রফিক থমকে গেল। মুহূর্তেই সব কিছু যেন অন্ধকার হয়ে এল। এখন কী হবে? কে নেতৃত্ব দেবে? মুক্তি কি আর আসবে না?
কিন্তু সে বুঝল, এখন থামলে চলবে না। যুদ্ধ ছাড়া পথ নেই!
২৬ মার্চের ভোরঃ-
চট্টগ্রাম পৌঁছাতে পৌঁছাতে রফিকের শরীর ক্লান্ত, কিন্তু চোখে অদ্ভুত এক আগুন। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ঘোষণা আসছে—
“শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি!”
কথাগুলো শোনার সাথে সাথে তার সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল! কিন্তু এর পরই খবর এল, পাকিস্তানি বাহিনী রেডিও বন্ধ করে দিয়েছে।
আর তখনই এক বজ্রনাদ—
“আমি মেজর জিয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি—বাংলাদেশ আজ স্বাধীন! সকলকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানাই।”
এই কথা শোনার পর আর কারও মনে সংশয় রইল না। সবাই জানল, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে!
রফিকও আর দেরি করল না। তার হাতে অস্ত্র তুলে নিল।
প্রথম যুদ্ধ: বন্দরে আগুনঃ-
রফিকের দল চট্টগ্রাম বন্দরে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিল। রাতের আঁধারে তারা এগিয়ে গেল, হাতে শুধু কিছু গ্রেনেড আর রাইফেল।
পাকিস্তানি পাহারাদাররা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রফিক ঝাঁপিয়ে পড়ল!
প্রথম গুলিটা লাগল এক পাকসেনার গলায়—সে চিৎকার করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রফিক সাথে সাথে গ্রেনেড ছুড়ে মারল বন্দরের এক পাশে, যেখানে পাকসেনারা জাহাজ পাহারা দিচ্ছিল। মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল!
কিন্তু পাল্টা আক্রমণ আসতে দেরি হলো না! গুলির শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল! এক পাকসেনা রফিকের দিকে বন্দুক তাক করল—
ঠাস!
সেকেন্ডের মধ্যে রফিক উল্টোদিক থেকে গুলি চালিয়ে দিল, পাকসেনা লুটিয়ে পড়ল!
শেষ লড়াই, শহীদের কাতারে রফিক-
রফিকের দল একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা, তারপর সোজা সীমান্তের দিকে।
একদিন তারা খবর পেল, এক পাকিস্তানি ক্যাম্প ধ্বংস করতে হবে। এটাই তাদের সবচেয়ে বড় অপারেশন!
রাত গভীর হলে রফিক দল নিয়ে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ঠিক তখনই শত্রুরা টের পেয়ে গুলি চালাতে শুরু করল!
বুলেট উড়ে এসে লাগল রফিকের কাঁধে। ব্যথায় তার পুরো শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু সে থামল না।
এক হাতে গুলি চালাচ্ছে, অন্য হাতে শেষ গ্রেনেডটা তুলে নিল।
ক্যাম্পের মধ্যে থাকা পাকিস্তানি অফিসারদের দিকে তাকিয়ে সে এক দৌড়ে ছুটে গেল, তারপর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে দিল গ্রেনেডটা!
বিস্ফোরণ!
আকাশ কেঁপে উঠল, পাকসেনারা একের পর এক লুটিয়ে পড়ল! কিন্তু রফিক আর উঠে দাঁড়াতে পারল না।
তার চোখের সামনে ধীরে ধীরে সব অন্ধকার হয়ে আসছে -
শেষ মুহূর্তে সে শুনতে পেল দূর থেকে সাথীদের চিৎকার— “জয় বাংলা!”
১৬ ডিসেম্বর: বিজয়ের অশ্রুঃ-
নয় মাস পর, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
রফিকের মা রেডিওর সামনে বসে আছেন, চোখ ভেজা।
“পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে! বাংলাদেশ আজ স্বাধীন!”তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল আনন্দ আর বেদনার অশ্রু। তার রফিক আর ফিরবে না, কিন্তু সে জানে—তার ছেলের রক্ত বৃথা যায়নি। বাংলাদেশ আজ সত্যিই স্বাধীন!
রক্তে লেখা ইতিহাসঃ-
এই গল্প শুধু রফিকের নয়, এই গল্প লাখো শহীদের।
এই গল্প এক লাল-সবুজের, যে পতাকা এসেছে ত্যাগের বিনিময়ে। এই গল্প রক্তে লেখা স্বাধীনতার!