12/07/2024
বুঝ হবার আগেই কেবল ষোল বছর বয়সে আব্বা আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। তাও আমার চেয়ে বিশ বছরের বড় একজন পুরুষের সাথে। সত্যি বলতে মানুষ হিসেবে, পুত্র হিসেবে তিনি বেশ ভালো ছিলেন। কেবল খারাপ রূপ প্রকাশ হতো রাতে, অন্ধকারে। প'শুর মতন আচরণ করতেন তিনি। আমার সাথে কেন এত খারাপ ব্যবহার করতেন সে প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে বেরিয়েছি একদম উন্মাদের মতো। শেষে উত্তরও পেয়েছিলাম। তাও আমি মেনে নিয়েছিলাম। মানিয়ে নিয়েছিলাম। কয়েক বছর না ঘুরতেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা লণ্ডভণ্ড করে দেয় সব। আমার সংসার, আমার জীবন। আজ বহুদিন বাদে লিখতে বসেছি। সমুদ্রের তীরে বসে লিখলে হয়তো গ্লানি কিছুটা কমবে কিংবা কমবেনা। জানিনা। ত্রিশ বছর আগের ভাগ্যের পরিহাস কিংবা আমার ভুল আজ মন খুলে লিখবো।
"ছেলেবেলার বিদায়"
বিস্তৃত মাঠ৷ ধান ক্ষেত। মেঘনা নদীর চড়৷ সাদা বক, মাছরাঙা উড়ে বেড়াচ্ছে। কচুরিপানার দল জোট বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেঘনার জলে। বৈশাখের আগমনী এই সময়টা কি যে ভালোলাগে! ঘাটে নৌকা বাঁধা। মাঠের মাঝখানে এক হিজল গাছ। বহু পুরোনো। সেটায় একদল ছেলেপেলে দঁড়ি আর পিঁড়ি দিয়ে দোলনা বানিয়েছে। সেই দোলনায় বসে দোল খাচ্ছি আমি। এলোমেলো বাতাসে আমার চুলগুলো বেসামাল হয়ে যাচ্ছে বারবার। অলস এই দুপুরে তেমন মানুষজন নেই। নৌকাগুলো পরপর সারিবদ্ধ ভাবে বাঁধা। একটা, দুইটা, তিনটা....
"লিলি আপা, ও লিলি আপা।"
পিছু ফিরে দেখি রুমু দৌড়ে আসছে। পাটকাঠির মতো চিকন শরীর আর মিচমিচে কালো গাঁয়ের রঙ। আমার হাতের সাথে নিজের হাত রেখে মাঝেমধ্যে আফসোস করে বলে, "আল্লাহ তোমারে কত সাদা করছে আপা। তুমি তো অনেক সুখী হইবা।"
(সাদা আর সুন্দর হলেই যদি সুখ পাওয়া যেতো তাহলে তো সুন্দরীদের আর আ'ত্মহ'ত্যা করা লাগতোনা৷ সুন্দরীরা তাহলে সুখের ফেরি করে বেড়াতো। গাজীপুরে আমাদের পাশের বাড়ির বিথী আপা ফ্যানের সাথে ঝু'লে আ'ত্মহ'ত্যা করেছিলেন। এত সুন্দর পরীর মতো মেয়েটির মৃ'ত্যুতে অবাক হয়েছিলো সারা মহল্লা। পরে পো'স্ট'ম'র্টেমে বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য। মৃ'ত্যুর আগে বেশ কয়েকবার ধ'র্ষ'ণের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তাও নিজের চাচার কাছে। কত কাহিনী এসব নিয়ে। যদিও ধ'র্ষ'ণের ব্যাপারটা মা গোপন করেছিলেন। জেনেছিলাম অনেক বছর পরে। সবাই ভাবে সুন্দরীদের জীবন খুবই উপভোগ্য আর সহজ হয়৷ আদোও কি তাই? নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের এই দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে হয়। পুরুষের কামুক দৃষ্টি, অশালীন আচরণ, ভোগ করার তৃষ্ণা! এসব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা কি এত সহজ?)
হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে সে বললো,
"চাচায় তোমারে ডাকছে। জলদি আসো।"
আমি উদাসমনে বিস্তৃত নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি,
"বাবাকে গিয়ে বল, পরে আসছি।"
"আমি পারুম না৷ চাচায় বকবো আমারে।"
অনিচ্ছা সত্ত্বেও দোলনা ছেড়ে নামলাম। বাঁ চোখের নিচটা যেন লাফিয়ে উঠলো। মনটা কু ডাকছে। নানু মণি বলেন, "বাম চোখ ফাল মারলে কপালে দুঃখ আসে।" আদোও কি আজ কপালে কোনো দুঃখ আছে আমার? মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুমু কত কিছু বললো। কোন সে সাহেব বাড়ির কাহিনী। আমার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। আমার মা হলেন হাইস্কুলের শিক্ষিকা। তিনি বিজ্ঞান পড়ান৷ বাবা একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। কি যে হলো তার! হুট করেই নে'শা আর জু'য়া'য় আ'স'ক্ত হয়ে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে ব্যবসাটাকেই হারিয়ে ফেলেন বাবা। গাজীপুরে নানা বাসায় থাকি আমরা। নানার পেনশন আর মায়ের টাকায় আমাদের সংসার চলে। দিনদিন পরিবারটা কেমন যেন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অশান্তি আর অশান্তি। দেশের অবস্থা প্রতিকূল। স্বাধীনতার এই তেইশ বছরে এসেও কত রা'জ'নৈ'তি'ক কলহ! নিরপেক্ষ ত'ত্ত্বা'ব'ধা'য়ক স'রকা'রের দাবিতে বিরোধী দলগুলি ক্রমাগত সংসদ বর্জন করছে। এরমধ্যেই গ্রীষ্মের ছুটিতে মায়ের ট্রেনিং পড়েছে সেই সিলেটে! আমার মা একমাত্র সন্তান। নানা ছিলেন ডেপুটি কমিশনার। নানা পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন আমার জন্মের আগে। নানু মণি অসুস্থ মানুষ। চলাফেরা করতে পারেন না। জমজ ছোট দুই ভাইকে নানু মণি আর আমাদের কাজের খালার কাছে রেখে বাবা বললেন, "লিলি, চলো একটু বাড়িতে বেরিয়ে আসি।" মা নাকি অনুমতি দিয়েছেন। আদোও এটা সত্যি কিনা জানিনা। সিলেটে যাওয়ার আগে মা কেবল বলেছিলেন,
"লিলিমণি, ভাইদের সাথে ঝগড়া করো না। পড়াশোনা ভালো করে করো। সাইকেল নিয়ে আবার মহুয়াদের সাথে বেরিয়ে পড়ো না। নানু মণির খেয়াল রেখো।"
তারপর চুমু এঁকে দিয়েছিলেন আমার কপালে।
বৈশাখের আগমনী গ্রামীণ রূপ দেখার লোভে আমি বাবার কথায় রাজি হয়ে গ্রামে চলে এলাম। আজ দুদিন যাবত আছি। দাদি বেশ আদর করছেন। বড় চাচি, যিনি আমাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। তিনিও বেশ সমীহ করছেন। বাবার মাথায় কি যে ঘুরছে আমি জানিনা। আজকাল বাবাকে বড্ড পরপর লাগে। মানুষ কত দ্রুত বদলে যায়! ভাবতে ভাবতেই কখন যে বাড়ি পৌঁছালাম নিজেও জানিনা৷ আটচালা একটা ঘর দক্ষিণ পাশে। উত্তরে বাঁশঝাড়। পূর্ব আর পশ্চিমে দু'চালা দুইটা ঘর। মাঝে বিশাল উঠান। আমাদের কোনো ঘর নেই। দু'চালা ঘর দুটোতে ছোট দুই চাচা থাকেন৷ আটচালা ঘরটা বড় চাচির। দাদি বড় চাচির সাথেই থাকেন। বড় চাচা থাকেন বিদেশে। কেমন একটা হইচই পরিবেশ চারপাশে। উঠানে বেশ কয়েকটা কাঠের চেয়ার রাখা। চেয়ারে মানুষজন বসা। তাদের ঘিরে গোল করে দাঁড়িয়ে আছে আশেপাশের মানুষজন। আমি পশ্চিম দিক দিয়ে বাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথেই বড় চাচি আর মেঝো চাচি দু'চালা ঘর থেকে বের হলেন। কাঠের দরজা দিয়ে আমাকে টেনে ঘরে নিয়ে এলেন। আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম কেবল। কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। একখানা লাল রঙের শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট আর স্বর্ণের কিছু গহনা চৌকির উপরে রাখা। তিব্বত স্নো, পাউডার, আয়না, জুতা আরো হাবিজাবি মেয়েদের সামগ্রীও একটা লাগেজের ভিতর। বড় চাচি দরজা বন্ধ করে বললেন,
"ফ্রক খুইল্লা ব্লাউজ আর পেটিকোট পইরা লও।"
রুমু কোথায় যেন চলে গেছে। ঘরে খালি বড় চাচি আর মেঝো চাচি। আমি অবাক করা সুরে শুধালাম,
"আমি কেন এসব পরবো?"
"সেইটা তোমার আব্বায় জানে। তাড়াতাড়ি পরো। শাড়ি পরাইতে হইবো।"
"আপনি বাবাকে ডাকেন। আমি পরবো না এসব।"
বলেই আমি দৌড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। উন্মাদের মতো চিৎকার করে বললাম,
"বাবা, বাবা! তুমি কোথায়? এরা পাগলের মতো কিসব বলছে দেখো।" উঠানের সবার দৃষ্টি আমার দিকে। বাবাকে দেখলাম চেয়ার ছেড়ে আমার দিকে দৌড়ে আসছেন। আমার মনে হচ্ছে জানে প্রাণ ফিরে পেলাম। বাবা আমার হাত টেনে ধরে ঘরে নিয়ে এলেন আবার।
"লিলি, মা আমার। মাথা ঠান্ডা করে একটু বসো মা।"
আমার মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে দিয়ে চৌকিতে বসালেন বাবা। বড় চাচিকে কি যেন ইশারা করলেন। তিনি আমার হাতে এক গ্লাস পানি এনে দিলেন। আমি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে লাগলেন।
"কাঁদেনা, মা আমার।"
হেঁচকি উঠা গলায় বললাম,
"বড় চাচি কিসব আবোল তাবোল কথা বলছে বাবা। তুমি তো জানো আমার স্বপ্ন। আমার পরিকল্পনা। চলো বাড়ি চলো। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবো না আমি।"
বাবা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই বললেন,
"বিয়েটা যে করতে হবেই মা।"
আমার হাত থেকে স্টিলের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে গেলো। আমি অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। যে মানুষটা একদিন স্বপ্ন দেখতো তার মেয়ে প্রফেসর হবে সে এই কথা বলছে! এই কি সেই জামাল আহমেদ? যে মানুষটা নিজের চাইতেও বেশি আমাকে ভালোবাসতো?
"তুমি কি নে'শা করেছো, বাবা?"
আমার প্রশ্নে বাবা একটু রেগে গেলেন। তারপরও অনেকটা শান্ত কন্ঠে বললেন,
"নায়ীব অনেক ভালো একজন মানুষ। সে এমপি হওয়ার পরে এই এলাকার অনেক উন্নতি করেছে...
"বাবা, দয়া করে তুমি এসব বন্ধ করো। আমি এসব শুনতে চাইনা।"
বাবা অনেকটা উচ্চ কন্ঠেই এবার বললেন,
"তাহলে শুনো, আমি নায়ীবের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছি। এই টাকা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি এখনই ওকে বিয়ে করবে। একটা কথাও যদি বেশি বলো তাহলে তোমার মাকে ছেড়ে দিতে আমি দুবারও ভাববো না৷"
মা, বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। এত কিছুর পরেও তাকে ছেড়ে দেননি। বাবা যদি সত্যি মাকে তা'লা'ক দেয়! আমার ছোট ভাইদের কি হবে? আমি স্তব্ধ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা আমার সাথে এত জঘন্য খেলা খেলতে পারলো! তারপর সব যেন ঘোরের মতো ঘটলো। গায়ে লাল শাড়ি চড়লো, সোনার গহনা চড়লো। মুখ ফুটে কেমন দিক্বিদিক পরাজিত সৈন্যের মতো কবুলও বলে ফেললাম! গাড়িতে চড়ে বসে রইলাম পাথরের মতো। আমার পাশে একজন লোকও বসেছেন। সম্ভবত উনিই আমার স্বামী। নিজের উপর কেমন ঘৃ'ণা জন্মাতে শুরু করলো। আজ আমি একটা পণ্য হয়ে গেলাম? যে পণ্য চাইলেই টাকার বিনিময়ে কেনা যায়। দূরত্ব বেশিক্ষণের না। কেবল দশমিনিট লাগলো এখানে পৌঁছাতে। আমাকে গাড়িতে রেখেই সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকটা বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। মেইন গেট দিয়ে যখন গাড়ি প্রবেশ করছিলো তখন নেম প্লেটে দেখলাম 'সাহেব বাড়ি' লেখা। তারপর একটা পাকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করলো। দুইপাশে সুপারি বাগান। এক প্রকাণ্ড দু'তালা বাড়ির সামনে গাড়িটা থামানো হলো। বাড়িটায় হলুদ রঙ করা, গ্রিলগুলো সবুজ। দুতালায় বিশাল খোলা বারান্দা। দারুণ কারুকার্য করা গ্রিল গুলোতে। চালক এবং স্বামী নামক মানুষটা সেই কখন যে ভিতরে গেলো! আমি শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু সিক্ত চোখে সিঁড়ির পানে তাকিয়ে আছি। কয়েকটা মেয়ে উপর থেকে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে তারা অজানা কোনো কিছু দিয়ে বাঁধা। কেমন চঞ্চলতা তাদের মাঝে। হয়তো সেই বাঁধা না থাকলে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসতো। বহু সময় বাঁধে আকাশ যখন লাল হতে শুরু করলো তখন একটা ব্লাউজ বিহীন পুরানো শাড়ি পরা মেয়ে এগিয়ে এলো। আমি ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে দেখছি সে আমার কাছে আসছে। গাড়ির দরজা খুলে বলল,
"চলেন, নতুন বউ। আপনাকে বড় আম্মা নিতে বলছে।"
আমি প্রাণহীন সত্তার মতো সাহেব বাড়িতে প্রবেশ করলাম মেয়েটার পিছু পিছু৷ বেশ আলিশান বাড়ি। গ্রাম হলেও আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায় এক কোণে চলে এলাম। পথিমধ্যে অনেকেই উঁকি ঝুঁকি দিয়েছে দেখলাম। পুরাতন আমলের এক কাঠের খাটে একজন বৃদ্ধা হেলান দিয়ে বসে আছেন। আমার দাদির বয়সী হবেন হয়তো। পাশে তার তামার পানের বাটি রাখা। তিনি পান চিবুচ্ছেন। এক বার কি তের বছরের মেয়ে ঘর মুছতে ব্যস্ত। আমার সাথে যে মেয়েটা এসেছিলো সে চলে গেলো৷ আমি দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃদ্ধা আমাকে ডাকলেন,
"ঘরে আসো নতুন বউ।"
আমি ঘরে প্রবেশ করলাম।
"বসো, এখানে।"
আমাকে খাটে বসতে নির্দেশ দিলেন। তবে কন্ঠে বেশ কোমলতার ছোঁয়া। আমি বসলাম। পান চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলেন,
"তুমি শহরে পড়াশোনা করতে?"
"জ্বি, দাদুমণি।"
কাজের মেয়েটা আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো।
"এইডা তোমার শাশুড়ী লাগে।"
মেয়েটির কথা শুনে বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম। মেয়েটি আরো কি জানি বলতে নিচ্ছিলো আমার সদ্য হওয়া শাশুড়ী এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিলেন। মেয়েটি মুখ কালো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
"আমার বাজানের একেক সময় একেক মতিগতি। হুট করে গতকাল বললো, 'আম্মা, আমি বিয়ে করবো।' এতদিন বলে কয়েও বিয়েতে মত নিতে পারছিলাম না। এখন হঠাৎ করে ওর মর্জি হলো তাই না করিনি। তোমার বাবা আমাদের পূর্ব পরিচিত। কিন্তু তুমি তো বাজানের অনেক ছোট হবা মনে হচ্ছে। বয়স কতো তোমার?"
"ষোল"
"বিশ বছরের তফাৎ তাহলে। আমার বাজানের রাগ বেশি। ওরে মেনে চলো। যা বলবে, যেভাবে বলবে তাই করবে...
আপনমনে কথা বলে যাচ্ছেন তিনি। এসব কথাবার্তা আমার সত্যি আর ভালোলাগছে না। অনেক ক্ষুধাও লেগেছে। কাকে বলবো এসব কথা। বাড়িতেই বা কি করে এসব জানাবো। মা তো জানেনও না তার আদরের সন্তানের সাথে কি হচ্ছে!
ভাবতে ভাবতেই ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরা মেয়েটা ঘরে এলো। হাতে ভাতের প্লেট। মেয়েটির নাম সম্ভবত সখী। বয়স বিশের উপরে হবে। খাবার সামনে দিতেই কেমন হাভাতের মতো গিলতে লাগলাম আমি। একসময় হেঁচকি উঠে গেলো। শাশুড়ী আমাকে পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন, " আস্তে আস্তে খাও বউ।"
মহিলার কথাবার্তা বিরক্ত লাগলেও কেন যেন মনে হচ্ছে উনার মন ভালো। খেয়ে আমি বসে রইলাম কিছুক্ষণ। উনি অনেক কথাবার্তাই বললেন৷ মাগরিবের নামাজও পড়লেন। আকাশ অন্ধকার হতে শুরু করেছে। বাইরে ঝিঁঝি পোকারা ডেকে চলেছে এক ছন্দে। এর মধ্যেই সখী ঘরে এলো।
"বড় সাহেব আপনাকে ঘরে যাইতে বলছে নতুন বউ।"
ওর কথা আমার মাথার উপর দিয়ে গেলো। শাশুড়ী পরিচয় প্রাপ্ত বৃদ্ধাও বললেন,
"যাও, বউ।"
আমি অচল পায়ে আবার সখীর পিছু নিলাম। শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে। এর আগে আমি কখনো শাড়ি পরিনি। আজই প্রথম। এই ঘরটা আরেক কোণায়। বারান্দা দিয়ে এদিকে আসতে আসতে ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরে কম্পন ধরে গিয়েছে। বিশাল ঘর। সম্ভবত এই বাড়িতে জেনারেটর আছে। তাই লাইট, ফ্যান চলে। গ্রামে এখনো কারেন্ট পৌঁছায় নি। বেশ ছিমছাম, গুছানো একটি ঘর। আকারে বিশাল। সেগুন কাঠের খাট, পড়ার টেবিল, একটা ওয়ারড্রবসহ বেশ কিছু জিনিস দিয়ে ঘরটা সাজানো। একটা পেট মোটা টেলিভিশনও আছে। সবচেয়ে সুন্দর লাগলো বিশাল জানালাটা। জানালা বেয়ে বাগানবিলাস গাছের ডালপালা, ফুল উঁকি দিচ্ছে। কপাট খোলা। জানালার কাছটায় বেতের সোফা আর টেবিল দিয়ে সাজানো। পাশে একটা স্ট্যান্ডে পাখির খাঁচা রাখা। সেখানে সম্ভবত খাঁচার ভিতর কিছু পাখি আটকে রাখা। সখী বললো,
"এখানে বসেন নতুন বউ।"
আমি খাটের উপর বসতেই সখী চলে গেলো। রাত বাড়ছে। আর আমার ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেও জানিনা। শরীরে অস্বাভাবিক কিছু স্প'র্শ পেয়ে ঘুম ভাঙলো আমার। ঘরে লাইট বন্ধ করে রাখা। একটি ল্যাম্প জ্বলছে কেবল। ল্যাম্পের আলোয় এক রাজপুত্রের মতো দেখতে পুরুষ দানবের আকার ধারণ করলেন। আমার মুখ চেপে ধরে তিনি....
আমার মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীতে আমি কেন বেঁচে আছি৷ কেন এই মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তা আমার মৃ'ত্যু দিচ্ছেন না! এই ষোল বছর বয়সে কি আমার অপরাধ ছিলো? কেন এই মৃ'ত্যু য'ন্ত্র'ণা। একবার, দুইবার, তিনবার! রাত গভীর হতে লাগলো। আবছা আলোয় খাঁচায় বন্ধী পাখিদের দেখে একমনে ভাবতে লাগলাম,
এই গভীর রাতেই আমি আমার ছেলেবেলাকে বিদায় জানিয়েছি তবে? এক মুহূর্তে পৃথিবীর কঠিন বাস্তব রূপের সাক্ষাৎ পেয়েছি? সেই ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার আসবে, সুন্দর রাজ্য হবে আমাদের। নেক্সট পাঠ কথা কাব্য তে পাবেন। ছেলে ভুলানো কত গল্প শুনাতেন নানুমণি। আমার বান্ধবীদের সাথে কত সুন্দর মুহূর্ত আছে আমার। আমার মা আমাকে কত স্নেহ করেছেন। আমার ছোট দুই ভাই। আস্তে আস্তে ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো হারিয়ে যেতে লাগলো। আমি আঁকড়ে ধরতে চাইলেও পারলাম না। এত তীব্র যন্ত্রণায় আমার প্রিয় ছেলেবেলাকে বিদায় জানাতে অন্তর পু'ড়'ছিলো। মন পু'ড়ার ক্ষ'ত যেন শরীরের অস'হনী'য় য'ন্ত্র'ণাকেও হার মানায়! বারবার মনে পড়ছে কেবল মায়ের মমতাময়ী মুখটা! ছেলেবেলার এই স্মৃতিটাই কেবল আঁকড়ে ধরতে পেরেছি আমি।
(চলবে)....
#গল্পঃ_সোঁনাই
আনিকা
পর্ব ০১