31/08/2025                                                                            
                                    
                                                                            
                                            টাংগাইলের শহরের মদের ঘরের মোড়💥
শহরের বুকে প্রতিটি রাস্তার মোড়েরই একটা নিজস্ব গল্প থাকে। কিছু গল্প সময়ের সাথে ফিকে হয়ে যায়, আর কিছু নামফলকের মতো রয়ে যায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম। টাঙ্গাইল শহরের মেইন রোড আর আমঘাট সড়কের সংযোগস্থলের মোড়টিও তেমনই এক জীবন্ত ইতিহাস। আজকের দিনে যারা এই মোড় দিয়ে যান, তাদের অনেকেই হয়তো জানেন না, কেন রিকশা বা অটোচালকেরা অবলীলায় এটিকে "মদের ঘরের মোড়" বলে ডেকে ওঠেন। সেখানে আজ কোনো মদের দোকান নেই, নেই কোনো পানশালার চিহ্ন। তবু নামটি রয়ে গেছে।
এই নামের পেছনে লুকিয়ে আছে প্রায় এক শতাব্দীর পুরনো এক অধ্যায়। সময়টা বিশ শতকের ত্রিশের দশক। দেশভাগের আঁচ তখনও লাগেনি, ব্রিটিশ শাসন চলছে পুরোদমে। ঠিক তখনই মেইন রোড থেকে আমঘাটের দিকে সামান্য পশ্চিমে বসন্ত পাল গড়ে তুলেছিলেন তাঁর দেশি মদের দোকান। সেই দোকানই এই মোড়টিকে তার চিরস্থায়ী পরিচয় দিয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর বসন্ত পালের সেই ঠেক বন্ধ হয়ে যায়। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, দোকানের চিহ্নটুকুও আজ আর নেই। কিন্তু রয়ে গেছে নামটি, যেন একগুঁয়ে কোনো স্মৃতির মতো মানুষের মুখে মুখে বেঁচে আছে।
কিন্তু কারা আসত বসন্ত পালের সেই দোকানে? সেই ইতিহাস জানতে হলে ফিরে তাকাতে হবে আরও গভীরে। দোকানের বেশিরভাগ খদ্দের ছিলেন শহরের মেথরপট্টির দলিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা—মেথর, ডোম, ঝাড়ুদার। শহরের ধুলোবালি, আবর্জনা, নর্দমার ক্লেদ—সবকিছু যাদের শ্রমে ও ঘামে পরিচ্ছন্ন থাকত, দিনের শেষে তারাই এসে বসত এখানে। তাদের জন্যই দোকানের পাশে ছিল টিনের চালার নিচে বাঁশের বেড়ার এক আলাদা ঘর। সমাজের চোখে অস্পৃশ্য এই মানুষগুলোর ক্লান্তি ভোলার মুহূর্তগুলো কাটত সেই ঘেরাটোপেই।
এই মানুষগুলোর শিকড় কিন্তু এই বাংলার মাটিতে প্রোথিত ছিল না। ১৮৮৭ সালে টাঙ্গাইল মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠার পর শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে হিন্দি, উড়িয়া, তেলেগু ভাষাভাষী দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের এখানে নিয়ে আসে। জঙ্গল সাফ করা, পয়ঃনিষ্কাশন কিংবা ল্যাট্রিনের ময়লা পরিষ্কারের মতো কঠিন ও অপরিচ্ছন্ন কাজগুলো করার জন্যই ছিল তাদের আগমন।
আজ সেই মদের দোকান নেই, বসন্ত পালও বিস্মৃত। কিন্তু "মদের ঘরের মোড়" নামটি আজও এক অদৃশ্য স্মারকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এটি শুধু একটি দোকানের স্মৃতি নয়, এটি সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে ধারণ করে আছে, যাদের ঘাম আর শ্রমে এই শহর তিলোত্তমা হয়েছে, অথচ যাদের জীবনের ক্লান্তি মোচনের ঠিকানাটুকুও ছিল সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এক কোণায়। এই একটি নামই যেন সেই forgotten মানুষদের গল্প বলে যায়।