13/11/2025
আপনিই তো আপনার পুরুষকে খুন করেছেন!
চলুন আজ একটা খেলা খেলি। খেলাটার নাম 'পুরুষের শব ব্যবচ্ছেদ'। ছুরি-কাঁচি আপনার হাতে; দেখুন তো, হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখা পচন ধরা ক্ষতগুলো দেখতে পান কি না। পারবেন না! কারণ সমাজ আপনাকে শিখিয়েছে, পুরুষ মানেই পাথর, পুরুষ মানেই শক্ত পাহাড়। কিন্তু আজ সেই পাহাড়ের ভেতরের লাভা উদগীরণের সময় এসেছে।
পুরুষের প্রথম খুনটা হয় তার শৈশবে, তার নিজেরই বাড়িতে। যখন ছোট্ট ছেলেটা হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে কাঁদে, তখন তার মা এসে বলে, "ছি! ছেলেরা কাঁদে না, লোকে হাসবে।" ব্যস! সেই প্রথম তার আবেগকে গলা টিপে হত্যা করা হলো। তাকে শিখিয়ে দেওয়া হলো, ব্যথা হলেও দাঁত কামড়ে সহ্য করতে হবে, কষ্ট হলেও হাসিমুখে থাকতে হবে। সেই থেকে শুরু হয় তার জীবন্ত লাশ হয়ে ওঠার ট্রেনিং।
একটু বড় হওয়ার পর যখন সে ভালোবাসতে শেখে, তখন তার প্রেমিকা এসে কানে কানে বলে, "একটা ভালো চাকরি জোগাড় করো, নইলে বাবা মেনে নেবে না।" ভালোবাসা নয়, তার যোগ্যতা মাপা হয় তার ব্যাংক ব্যালেন্স দিয়ে। তার ভালোবাসার দাম নির্ধারিত হয় তার উপার্জনের অঙ্কে। হন্যে হয়ে চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে যখন সে ফেরে, তখন দেখে তার প্রেমিকা অন্য কারো ঘরের লক্ষ্মী। আর পুরুষটা? তাকে আবারও সেই পাথর হতে হয়, চোখের জল লুকিয়ে ফেলতে হয়। কারণ, পুরুষের ভাঙা হৃদয়ের কোনো বাজারদর নেই।
আপনারা নারীরা তো খুব ভাগ্যবান! স্বামীর সাথে সামান্য ঝগড়া হলেই বাপের বাড়ি যাওয়ার হুমকি দেন, চলেও যান। কিন্তু পুরুষের জন্য কোনো "বাপের বাড়ি" নেই। স্ত্রীর সাথে তুমুল ঝগড়ার পর, অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে সে যখন ঘর থেকে বের হয়, তার যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। পার্কের বেঞ্চ, ফাঁকা রাস্তা বা বন্ধুদের আড্ডাই তার সাময়িক আশ্রয়। সে একবেলা না খেয়ে অভিমান করে, কিন্তু তার অভিমান ভাঙানোর জন্য কেউ ছুটে আসে না। কারণ সে পুরুষ, তার অভিমান থাকতে নেই!
কখনো ভেবে দেখেছেন, পুরুষকে কি আদৌ কেউ ভালোবাসে? না! পুরুষকে ভালোবাসা হয় না, পুরুষকে ব্যবহার করা হয়। সে হলো এক চাহিদার মেশিন। বাবা-মায়ের চাহিদার মেশিন, ভাই-বোনের চাহিদার মেশিন, স্ত্রী-প্রেমিকার চাহিদার মেশিন, আর সবশেষে সন্তানের চাহিদার মেশিন।
টাকা আয় করতে না পারলে বাবা-মা বলে, "কুলাঙ্গার"। স্ত্রীর শখ পূরণ করতে না পারলে স্ত্রী বলে, "অপদার্থ"। সন্তানের দামী আবদার মেটাতে না পারলে সন্তানরাও মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চাহিদা মেটাতে পারলে সে 'রাজা', আর না পারলে সে সমাজের সবচেয়ে ঘৃণ্য 'ফকির'। ভালোবাসা? ওটা পুরুষের জন্য এক নিষিদ্ধ শব্দ।
দেশে নারী নির্যাতনের আইন আছে, সংগঠন আছে, মোমবাতি মিছিল আছে। কিন্তু পুরুষ নির্যাতনের কথা বললে লোকে হাসে। কারণ নারী নির্যাতন হয় দেহে, যা চোখে দেখা যায়। আর পুরুষ নির্যাতন হয় মনে, তার আত্মায়, যা অদৃশ্য। এই মানসিক নির্যাতনের ক্ষত শরীরী ক্ষতের চেয়েও হাজার গুণ বেশি যন্ত্রণাদায়ক। এই নির্যাতন তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খায়, তাকে জীবন্ত লাশে পরিণত করে। কিন্তু তার জন্য কোনো আইন নেই, কোনো সহানুভূতি নেই।
যে পুরুষ ঘর বানানোর জন্য নিজের ঘর ছেড়ে বছরের পর বছর বাইরে পড়ে থাকে, মৃত্যুর আগে যার হয়তো নিজের ঘরে ফেরা হয় না, তার আত্মত্যাগের কোনো স্বীকৃতি নেই। সে পরিবারের জন্য এক নির্বাক সৈনিক, যে শুধু যুদ্ধ করে যায়, কিন্তু তার কষ্টের কথা শোনার মতো কেউ থাকে না।
এই সমাজ পুরুষের কাঁধে পুরো সংসারের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বলে, "তোমাকে শক্তিশালী হতে হবে।" আবার সেই পুরুষই যখন একটু আবেগ প্রকাশ করে, তখন সেই সমাজই তাকে "দুর্বল" বলে উপহাস করে। এই ভণ্ডামি আর কতদিন?
আপনি কি একজন খুনী?
একটু ভেবে দেখুন তো! আপনার বাবা, ভাই, স্বামী বা প্রেমিকের হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলোর জন্য আপনি নিজে কতটা দায়ী? আপনার চাহিদার বোঝা চাপিয়ে, তার আবেগকে উপেক্ষা করে, আপনি কি তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন না?
আপনার ঘরের পুরুষটি পরেরবার যখন হাসবে, একবার তার চোখের দিকে তাকাবেন কি? পারবেন তো সেই হাসির আড়ালের মৃত আত্মাটাকে দেখতে? নাকি দেখেও না দেখার ভান করে নিজের চাহিদার তালিকাটা তার দিকে এগিয়ে দেবেন?
সিদ্ধান্ত আপনার। কারণ প্রতিটি পুরুষ আজ এক জীবন্ত লাশ, আর তার শব ব্যবচ্ছেদ করলে দেখা যাবে, তার খুনি আর কেউ নয়, তার সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোই।
, , , ,