23/09/2025
কিছু কিছু বই আছে যেগুলো আপনি একবার পড়ে ফেলার পরে খুব সহজেই ভুলে যেতে পারবেন। আবার এমন কিছু বই আছে যেগুলো শেষ হওয়ার পরও আপনার বুকের ভেতরের জায়গাটা সুন্দরভাবে দখল করে নিবে, থেকে যাবে প্রতিদিনের চিন্তায়, আচরণে আর অনুভূতিতে। এলিফ শাফাকের The Forty Rules of Love আমার কাছে ঠিক সেই ধরনের একটা বই। আমার কাছে এটা কোনো সাধারণ উপন্যাস নয়। বলতে পারেন এটা আমার আত্মার এক অনন্ত মহাযাত্রা, যেখানে প্রেম কেবল মানুষে মানুষে নয়, বরং খোদা আর মানুষের সংযোগের সেতু হয়ে ওঠে।
শাফাকের অসাধারণ সাহিত্যকৌশল হলো, তিনি একসাথে দুটি গল্পকে এগিয়ে নিয়েছেন। একদিকে আছেন এলা রুবেনস্টাইন, আমেরিকার এক মধ্যবয়সী নারী। বাইরে থেকে তার জীবন সুন্দর স্বামী, সন্তান, সংসার সবই যেন আছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি গভীরভাবে শূন্য। তার দিন কাটে প্রতিদিনকার রুটিনে, নির্জীব যান্ত্রিকতায়। আর ঠিক এই নিস্তরঙ্গ জীবনে আলো জ্বালে এক বই 'Sweet Blasphemy'। বইটির লেখক আজিজ যখন তার জীবনে প্রবেশ করে, তখন এলার দুনিয়া যেন আস্তে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করে। অন্যদিকে আছে ১৩শ শতকের আনাতোলিয়া, যেখানে রুমি নামের বিখ্যাত আলেম ও কবি হঠাৎই সাক্ষাৎ পান রহস্যময় দরবেশ শামস অব তাবরিজ-এর সঙ্গে। রুমির ভেতরের আলোকিত আত্মা জেগে ওঠে, আর শামসের চল্লিশ নিয়ম হয়ে ওঠে তাদের সম্পর্কের মূল ভিত্তি। এই দুই গল্প, আধুনিক আমেরিকা আর প্রাচীন তুরস্ককে একইসাথে এগিয়ে নিয়ে যায়, আর শেষ পর্যন্ত এসে মিলেমিশে যায় এক হয়ে বয়ে চলা নির্জীব কোনো এক ভালোবাসার সার্বজনীন সত্যে।
শামস অব তাবরিজের চল্লিশ নিয়ম আসলে কোনো শুষ্ক ধর্মীয় বিধান নয়, বরং মানবিক সত্য। এগুলো প্রেম, মানবতা আর আধ্যাত্মিকভাবে নিজেকে মুক্ত করার শিক্ষা। যার কয়েকটি আমার জীবনে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে, “প্রতিটি মানুষই ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি।” অন্যের দিকে তাকালে তার ভেতরেও আমি ঈশ্বরকে দেখতে শিখেছি। এতে অহংকার ভেঙেছে, ঘৃণা কমেছে। “প্রেম মানে শৃঙ্খল নয়, মুক্তি।” ভালোবাসা কাউকে বন্দি করে না, বরং মুক্ত করে দেয়। এটা আমাকে সম্পর্কগুলো নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। আর “প্রতিটি আঘাত আসলে ঈশ্বরের বার্তা।” এই সত্য আমার জীবনের কঠিন সময়গুলো বুঝতে সাহায্য করেছে। ব্যথার মধ্যেও অর্থ আছে। এই নিয়মগুলো পড়তে পড়তে আমি বুঝেছি- প্রেম মানে শুধু আবেগ নয়, প্রেম মানে আত্মার জাগরণ।
রুমি-শামসের গল্প কেবল শিক্ষক-শিষ্যের সম্পর্ক নয়। এটা এক গভীর আধ্যাত্মিক বন্ধুত্ব, যেখানে অহংকার গলে যায়, জ্ঞানের শিকল ভেঙে যায়। শামসের আগমনে রুমি হয়ে ওঠেন কবি, মরমি এবং একজন প্রেমিক। তাদের সম্পর্ক সমাজের চোখে হয়তো গ্রহণযোগ্য ছিলো না, কিন্তু এই সম্পর্কই রুমিকে বিশ্বসাহিত্যের মহাকবি বানিয়েছে। এই বন্ধুত্ব আমাকে শিখিয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসা মানে কাউকে হারিয়ে ফেলা নয়, বরং তাকে ভেতর থেকে বদলে দেওয়া।
এলার যাত্রা আমার কাছে খুব ব্যক্তিগত লেগেছে। তার নিঃশব্দ হতাশা, তার ভেতরের প্রশ্নগুলো যেন আমার নিজেরই কথা। আজিজের প্রতি তার আকর্ষণ শুধু এক পুরুষের প্রতি প্রেম নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক জাগরণ। সে শিখে যায়, জীবনকে কেবল নিয়মে আটকে রাখা যায় না। প্রেমের ঝুঁকি নিতে হয়, ভেতরের ভয় ভাঙাতে হয়।
এলিফ শাফাকের লেখনী অসাধারণ। তিনি কাব্যিক অথচ সহজ ভাষায় লিখেছেন। প্রতিটি অধ্যায় ছোট ছোট হলেও গভীর অর্থ বহন করে। কখনো মনে হয়েছে তিনি গল্প বলছেন, আবার কখনো মনে হয়েছে তিনি আমার ভেতরের গোপন ডায়েরি লিখছেন। আধুনিক আর প্রাচীন, পশ্চিম আর পূর্ব, এই দুই ভুবনকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলা তার সবচেয়ে বড় সাফল্য। আর শাহেদ জামানের অত্যন্ত সাবলীল অনুবাদ বইটাকে করে তুলেছে ঝরঝরে পাঠ উপযোগী।
আমি যখন প্রথম বইটা পড়ি, তখন জীবনে এক রকম অস্থিরতা ছিলো। মনে হতো, সব আছে, কিন্তু কিছুই নেই। তখনই শামসের নিয়মগুলো আমাকে নাড়া দেয়। আমি বুঝি, ভালোবাসা মানে শুধু কারও প্রতি আকর্ষণ নয়, বরং প্রতিটি মানুষে, প্রতিটি মুহূর্তে খোদাকে খুঁজে পাওয়া। এই বই আমাকে বদলে দিয়েছে ভেতর থেকে। আজও যখন ভেঙে পড়ি, তখন এই বই হাতে নিই। কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়লেই মনে হয় মিটমিট করে নিভু নিভু আলো যেন আবার তীব্রভাবে জ্বলে উঠেছে।
তবে বলতে হবে, হয়তো বইটা সবার জন্য সহজ নাও হতে পারে। যারা সরল প্রেমকাহিনি চান, তাদের কাছে হয়তো নিয়মগুলো দর্শনময় আর ভারী মনে হবে। কিন্তু যারা ভেতরের প্রশ্ন খুঁজতে ব্যাকুল হয়ে আছেন, তাদের জন্য এটা এক অফুরন্ত ভান্ডার।
আমার কাছে The Forty Rules of Love কেবল একটি উপন্যাস নয়। এটা আমার আত্মার নদী। যখন আমি এতে ডুব দিই, আমি ধুয়ে যাই, হালকা হই, আবার নতুন আলোয় ভরে উঠি। এই বই আমাকে শিখিয়েছে, ভালোবাসাই খোদার পথে পৌঁছানোর একমাত্র সেতু। তাই আমার কাছে এই বই কেবল সাহিত্য নয়। এটা আমার জীবনের দিশারি, হৃদয়ের প্রার্থনা, আর আত্মার চিরমুক্তি।
বইঃ দ্য ফরটি রুলস অফ লাভ
লেখকঃ এলিফ শাফাক
অনুবাদঃ শাহেদ জামান
মুদ্রিত মূল্যঃ ৫৮০ টাকা
রিভিউ এবং ছবিঃ Asaduzzaman Ishan