
30/06/2025
ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীদের দ্বারা। বিজেতারা গল্প লেখে নিজেদের, হারিয়ে যায় পরাজিত সৈনিক। হয়তো কোনো এককালে বিজয়ী হিসেবে সে-ই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কালের বিবর্তন এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে, যা প্রতিনিয়ত রং বদলায়। একেক সময় একেক গল্প, একেক রূপকথা! ইতিহাস যেন নানান ছন্দে, নানান গল্পে দৃষ্টির সীমানায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয় কিছু অজানা বাণী। ইতিহাসের পাতাতেও হারিয়ে যাওয়া কিছু গল্প বিস্ময়ের জন্ম দেয়। হতবাক করে দেয়! কল্পনা কিংবা বাস্তবকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় এমনভাবে, বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। আবার অবিশ্বাস করাও যায় না! আজ তেমনই এক জাতির কথা হোক! এই বাংলার বুক-ই একসময় তাদের নিঃশ্বাসের প্রতিদান দিত। আর আজ? কালের বিলীনে তারাও বিলীন হয়ে গিয়েছে ইতিহাসের পাতা থেকে।
প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ যেন সুন্দরের পূজারী। সৌন্দর্যের মোহে এমনভাবে হারিয়ে যায়, সব যেন সেখানেই মাথা নত করে। প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক যুগ, এই ধারার পরিবর্তন হয়নি। এই উপমহাদেশ, কিংবা বাংলার মাটিতে একসময় বাস করত কৈবর্ত জাত। মাটির মানুষ, মাটিতে মিশে যায়। তাদের সেই রূপ কোনোকালেই ছিল না। তারপর একদিন এখানে আগমন ঘটে আর্য শ্রেণীর। অন্যদের চেয়ে রূপে গুণে নিজেদেরকে আলাদা প্রমাণ করে তারা।
‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ একটি প্রবাদ আছে। ঠিক সেই কাজটিই যেন করে এই আর্যদের জাত। উদ্বাস্তুর মতো আগমন, তারপর যেন নিজেরাই সর্বেসর্বা বনে যায়। শতশত বছর ধরে যারা এই ভূখণ্ডে নিজেদের তিলে তিলে গড়ে তুলেছে, একটি ভিত্তি স্থাপন করেছে— তারাই হয়ে গেল অবাঞ্ছিত। আর্যদের সৌন্দর্যের কাছে তারা হয়ে পড়ল কদর্য। ভূমিপূত্রদের নামে মায়েরা সন্তানদের ভয় দেখায়। এই অঞ্চলের আদী নিবাস যাদের, তারাই পরিচিত অসুর নামে।
এভাবেই চলে যুগের পর যুগ। সময়ের স্রোতে ভেসে যায় অনেকখানি স্মৃতি। তখন চলমান পাল শাসন। মহীপাল রাজ্য শাসনে ব্যতিব্যস্ত। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী মহীপাল হলেও তার একান্ত উপদেষ্টা ভট্টবামন আবার হিন্দুধর্মাবলম্বী। ধর্মে ধর্মে রেষারেষি প্রাচীনকাল থেকেই চলমান। সেখানে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের একসাথে চলা বিস্ময়ের জন্ম দেয়। যদিও বাহ্যিক দিক আর অভ্যন্তরীণ দৃষ্টি কখনো এক হয় না। তারপরও একদিকে চলে হিন্দুদের মন্দির প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে আচার্য্যদের চেষ্টা চলে বৌদ্ধ মহাবিহার প্রতিষ্ঠার। হয়তো বহুকাল পরে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে সেই মহাবিহার।
যে সময়ের গল্প বলা হচ্ছে, তখন বরেন্দির মাটিতে কৈবর্তের বাস হলেও শাসনের নামে অত্যাচার, নিপীড়নে যেন মাত্রা ছড়িয়েছিল। চলছিল কৈবর্তদের উপর নানান ছলচাতুরি। নিজেদের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে হয়। তারা একবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলে, তা হতে পারে হুমকির কারণ। এভাবেই দিনাতিপাত হয়। ঋণ শোধের নামে বিষ্টি (বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম) দিতে হয়। বট্যপকে একদিন এভাবে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যায় তার সন্তান পপিপকেও। শ্রম দেওয়ার মত বয়স এখনও পপিপের হয়নি। কিন্তু বাবার ঋণের দায়ে মাকে ছেড়ে তাকেও কাজ করতে হয়। শরীর চলে না, কিন্তু অত্যাচার ঠিকই চলে।
যুগে যুগে যতবার অন্যায়, নিপীড়ন শুরু হয়েছিল; ততবার কেউ না কেউ, কোনো না কোনোভাবে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবার হয়। কেউ দিব্যোক হিসেবে সবার মাথা হিসেবে, কেউ বা মল্ল নামের অন্য কোনো চরিত্রে। আগে মল্লর কথা বলা যায়। কৈবর্ত জাতের সুদর্শন এই মানুষটির নজর পড়ে পপিপের উপর। এই শিশুটির উপর ভারী কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়, প্রতিবাদ করে মল্ল। তাকে নিয়ে যায় এখান থেকে সেখানে। শিক্ষিত করার এক ধরনের প্রচেষ্টা চলে। কিন্তু যে জাত কখনো পড়াশোনার ধারেকাছে চলে, সেই জাতির কাছে কীভাবে পৌঁছুবে অক্ষরের বাণী? পপিপের যে কেবল মাকে চাই।
দিব্যোকের দিকে চেয়ে আছে সকল কৈবর্ত। কৈবর্তদের মধ্যে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, জ্ঞানী, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকা এই মানুষটি তাদের নেতা। যার উপর ভরসা করা যায়, বিশ্বাস রাখা যায়। অন্যদিকে ভট্টবামনের গলার কাঁটার মত বিঁধে আছে যেন দিব্যোক। একদিন হয়তো এই কৈবর্তদের বরেন্দি স্বাধীন হবে। কোনো শাসনের আওতায় থাকবে না। দিব্যোক যেন সেই আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে।
কৈবর্তদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামের চলছে। চলছে পপিপের মাকে খুঁজে ফেরা। অন্যদিকে পপিপ যেন নতুন জ্ঞান অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত করছে। সে জ্ঞান কি সে পাবে? যে স্বপ্ন মল্ল দেখেছে, তার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে? এই গল্প হাজার বছর আগের এমন এক সময়ের যে সময়ের বিলীন হয়ে গিয়েছে। ইতিহাস থেকে মুছে গিয়েছে মল্ল, দিব্যোক, ভীম কিংবা পপিপ। কেননা ইতিহাস ধরে রাখতে চাই অক্ষরের জ্ঞান। যে জাতির কোনো লিখিত ভাষা নেই, তাদের ইতিহাস লিখব কে? যাদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা যায়, ইতিহাসে টিকে থাকে তারাই।
জাকির তালুকদারকে এজন্য ধন্যবাদ দিতে হয়— তিনি এমন এক জাতির কথা তুলে ধরেছেন, যাদের নিয়ে কেউ কথা বলে না। যুগ যুগ ধরে সমাজের নিচু জাতের মানুষেরা প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার হয়ে চলেছে। তাদেরকে অসুর, নীচ— যে যেভাবে অপদস্ত করতে পারে করে চলে। এমন মানুষদের কথা বলতে সাহস লাগে। যে সাহস জাকির তালুকদারের ছিল বলেই তিনি এমন এক উপাখ্যান রচনা করেছেন।
জাকির তালুকদারের লেখনশৈলী নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় দুর্দান্ত! তার সাহিত্যের ভাষা বেশ পছন্দ হয়েছে। শব্দের মধ্যে কিছু কাঠিন্য রয়েছে, তবুও পড়তে খুব যে কষ্ট হয় এমন না। আমি সবসময় মনে করি সাহিত্য মানে শব্দের খেলা। এ খেলায় যে যতটা পটু সে ততটাই সফল। জাকির তালুকদার শব্দের এ খেলায় অনন্য। তার শব্দচয়ন, গল্পের পরিচালনা, ভাষার দখল, বাক্য গঠন সবকিছুতে পরিমিত ভাব ছিল। প্রতিটি বাক্য রচনা যেন মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। কিছু সাংস্কৃতিক শ্লোক ছিল, যার অনুবাদও করে দিয়েছেন। এর আগে জাকির তালুকদারের লেখা পড়া হয়নি। প্রথম বইতেই তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছেন।
এই গল্পে আছে বিভিন্ন ধর্মের সংমিশ্রণ। বিশেষ করে কৈবর্তদের ধর্ম এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। একই সাথে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের কথাও লেখক বলেছেন। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ধর্মের আবির্ভাব, মানুষের সংস্পর্শ পেয়ে সেই ধর্ম যেন উল্টো পথে হাঁটা ধরে। ধর্মের নীতিতে কোন ভেদাভেদ থাকে না। তারপরও জাতিগত ভেদাভেদ আসে কীসের ভিত্তিতে? মানবজাতি নিজেদের সুবিধা অর্জনের জন্য ধর্মকে নিজেদের মতো ব্যবহার করে। আর এতেই উচ্চজাত কিংবা নিম্নজাতের সূত্রপাত। নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ধর্ম কিন্তু আমাদের তা বলে না। সমাজের বিজ্ঞ ও ধর্মীয় প্রচারকদের এসব মিথ্যে বয়ান ও নিজেদের উচ্চ আসনে দেখানোর প্রয়াসই ধর্মের মূল উদ্দেশ্য কে ব্যক্ত করে। যার জন্য ভুক্তভোগী হয় ঊর্ণাবতীর মত কেউ কেউ।
কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। কোনো একসময় হয়তো স্বাধীনতা আসে, বিজয়ের পতাকা উড়ে। কিন্তু এই স্বাধীনতা রক্ষা করা খুব কি সহজ? কেননা চারিদিকে শত্রুপক্ষের বিচরণ। পরাজিতরা হাল ছাড়ে না। হয়তো শেষ মারণ আঘাত দিতে প্রস্তুত হয়। যু দ্ধের ময়দানে তারাই বিজয়ী হয় যাদের কোন পিছুটান থাকে না। দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য যারা লড়াই করে তাদের হারানোর সাধ্য কারো থাকে না। কিন্তু সব লড়াই নিয়ম মাফিক হয় না। ছলনার বশবর্তী হয়ে গল্পের স্রোত বয়ে যায় অন্যখানে। ছলচাতুরি করে কাগজে-কলমে বিজয়ী হওয়া যায়, কিন্তু প্রকৃত বিজয়ী হতে হলে সাহসী হতে হয়। কাপুরুষেরা পরাজয় দেখতে পেলে আঘাত হানে পেছন থেকে ফলে তাদের বিজয় শেষে, দেখতে হয় পরাজয়। মানবিকতার পরাজয়!
জাকির তালুকদারের সাহিত্যগুণ নিয়ে বলার কিছু নেই। সাহিত্যগুণ গল্পের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছেন। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, কাব্য রচনা যেকোনো কাহিনিকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। কাব্যের ছন্দে সত্যকে মিথ্যে হিসেবে উপস্থাপন করা যায়, আবার মিথ্যেকে সত্য বানানো চায়। যার কাব্যের জোর যত বড়, কলমের ক্ষমতা যত বেশি; ইতিহাসের ধারণ ক্ষমতা তার তত বেশি। এ কারণেই হয়তো ইতিহাসকে ধারণ করতে বেশি বেশি সাহিত্য রচনা করতে হয়।
উপন্যাসের শেষটা অন্যরকম। এখানে বদলে যায় ভাবনা। যে গতিতে উপন্যাস রচিত, তার ঠিক উল্টো স্রোতে ভেসে যায় সময়। প্রকৃত বিজয়ীরা কখনো কখনো বিজয়ের দেখা পায় না। উপন্যাসের শেষভাগ যেন তারই ইঙ্গিত করে!
পরিশেষে, কিছু দুর্দান্ত গল্পের আলোচনা হয় না। নিভৃতে থেকে যায় বিশাল কোনো উপাখ্যান। জাকির তালুকদারের “পিতৃগণ” ঠিক তেমনই একটি বই। যে বইয়ের কথা ছড়িয়ে পড়া উচিত। আড়ালে থেকে যাওয়া এক জাতির কথা সবার জানা উচিত। একই সাথে প্রকৃত সাহিত্য রস আস্বাদ করতে এমন বইয়ের বিকল্প নেই। কে বলে, বর্তমানে মান সম্পন্ন বই পাওয়া যায় না? স্তব্ধ করে দেওয়া এরূপ উপন্যাসই তৃপ্তি দেয়। আবার এ গল্পের ধারা জন্ম দেয় আক্ষেপ। এমন যে না হলেও পারত!
▪️বই : পিতৃগণ
▪️লেখক : জাকির তালুকদার
▪️প্রকাশনী : রোদেলা প্রকাশনী
▪️পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৩০০
▪️মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
▪️ব্যক্তিগত রেটিং : ৫/৫
✅ রিভিউ এবং ছবিঃ A. Jami