15/12/2024
আজ ৩০শে জানুয়ারী ১৯৯৪। ঢাকায় প্রথমবারের মতো সরাসরি জনগণের ভোটে মেয়র নির্বাচন চলছে। সকাল আটটা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকাল চারটা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ করা হবে। গত রাতেই জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, আজ ৩০শে জানুয়ারী সকাল ছ'টায় ২৯ মিন্টু রোডে তার বাসায় হাজির হওয়ার জন্য। নির্দেশ মোতাবেক নেত্রীর বাসায় সকাল পৌনে ছ'টায় হাজির হয়েছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা ঘুম থেকে উঠলেন, একসঙ্গে নাস্তা করলেন। তারপর সকাল পৌনে সাতটায় তার (শেখ হাসিনার) লাল রঙের নিশান পেট্রোল জীপ গাড়িতে করে আমাদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রথমে গেলেন শেরে বাংলা নগরের রাজধানী হাই স্কুলে। তারপর গেলেন ধানমণ্ডি বয়েজ হাই স্কুলে, এরপর গেলেন ধানমণ্ডি বত্রিশে তার (শেখ হাসিনার) পিতার বাড়ি বঙ্গবন্ধু ভবনে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চা খেয়ে নিজের ভোটার স্লিপ নিয়ে চলে এলেন সিটি কলেজে ভোট দিতে।
সিটি কলেজে ভোট দেওয়া শেষ করে আরো কিছু ভোটকেন্দ্র ঘুরে বেলা এগারোটা নাগাদ ফিরে এলেন ২৯ মিন্টু রোডে তার সরকারী বাসভবনে। জননেত্রী শেখ হাসিনা মিন্টু রোডের বাসভবনে ফিরে আসার দশ-পনের মিনিটের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক (বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য) নওগাঁর আব্দুল জলিল। সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে আব্দুল জলিল বললেন, নেত্রী আমাদের অবস্থা ভাল না। আমরা নির্বাচনে জিততে পারব না। আমাদের লোককে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিচ্ছে। আপনাকে তো আগেই বলেছি আওয়ামী লীগ হলো হরতাল আর আন্দোলনের দল, নির্বাচনের দল না। আপনি খামাকা নির্বাচনে যান।
আব্দুল জলিলের কথা শেষ না হতেই এসে হাজির হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে এলজিআরডি মন্ত্রী) জিল্লুর রহমান। জিল্লুর রহমানের পেছনে পেছনে এলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য (বর্তমানে পানি সম্পদ মন্ত্রী) আব্দুর রাজ্জাকসহ অন্যান্য নেত্রীবৃন্দ।
একমাত্র আব্দুর রাজ্জাক ছাড়া সকল নেত্রীবৃন্দেরই এক কথা, মেয়র নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হচ্ছে। আমাদের কর্মীদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিচ্ছে। নির্বাচন বাতিলের দাবী করা হোক, আন্দোলন করা হোক ইত্যাদি। প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বললেন, নির্বাচনে কারচুপি হচ্ছে, আমাদের কর্মীদের বের করে দেওয়া হচ্ছে, এটা কি আপনারা কেউ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেছেন?
নেতারা কেউ কোন উত্তর দিলেন না, কোন কথাও কেউ বললেন না, সবাই চুপ।
জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, এটা আবার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখতে হয় নাকি? ওরা তো ভোট কারচুপি করবেই। এখন না করলে একটু পরে করবে। কাজেই আমাদের নির্বাচন বাতিলের দাবী করতে হবে এবং এই ইস্যু নিয়ে বিএনপি সরকার পতন আন্দোলন করতে হবে। খালেদা জিয়া সরকারের পতন ঘটাতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে টেবিল টেলিফোন সেট (যে সেট দিয়ে উপস্থিত সকলে শুনতে পারে) দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ফোন করলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে না পেয়ে, অন্য একজন নির্বাচন কশিনারকে নির্বাচন বাতিল করার কথা বললে, নির্বাচন কমিশনার বিস্ময়ের সাথে বললেন, ম্যাডাম, নির্বাচন বাতিল করা তো দূরের কথা, কোন ভোটকেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত করার মতো কোন ইনফরমেশন এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসেনি।
জবাবে জননেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, আমার কাছে ইনফরমেশন আচে নির্বাচন কারচুপি হচ্ছে। আমি বলছি-নির্বাচন বাতিল করেন।
নির্বাচন কমিশনার বললেন, ম্যাডাম আপনি কাইন্ডলি বলেন, কোন-কেন্দ্রে কারচুপি হচ্ছে আমরা অবশ্যই তার ব্যবস্থা নেব।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চীফ ইলেকশন কমিশনারকে বলবেন আমাকে ফোন করতে এ কথা বলে ফোন রেখে দিলেন। এরপর প্রায় প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় নির্বাচন কমিশনে নির্বাচন বাতিল করার দাবী জানিয়ে ফোন করা শুরু হলো। বিকেল চারটা নাগাদ একবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচন বাতিলের দাবীর জবাবে বললেন, ম্যাডাম আমি ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। সামান্য গোলযোগের কারণে আমি কয়েকটি ভোটকেন্দ্রের ভোট স্থগিতও করেছি।
শেখ হাসিনা পুনরায় নির্বাচন বাতিলের দাবী করলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ম্যাডাম আমি নির্বাচন কমিশনে বসে নেই। আমি সরাসরি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, যে কোন প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে আমি মোটেই পিছপা হবো না।
হ্যাঁ, আপনি নির্বাচন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিন। আমি পরে আবার ফোন করবো বলেই জননেত্রী শেখ হাসিনা ফোন রেখে দিলেন। এরপর প্রায় পনের বার ফোন করেও নির্বাচন কমিশনারকে পাওয়া গেলো না। কিন্তু রাত দশটার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে পাওয়া গেল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ফোন ধরতেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা উচ্চস্বরে বললেন, কি হলো, নির্বাচন বাতিলের ঘোষণা দিলেন না?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বললেন, ম্যাডাম আমাদের কাছে যে ফলাফল এসেছে তাতে মেয়র পদে মাছ মার্কায় মোহাম্মদ হানিফ বিপুল ভোটে এগিয়ে রয়েছে। এখন আমরা কি নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করবো?
শেখ হাসিনা বললেন, জ্বী জ্বী কি বললেন? হ্যাঁ ম্যাডাম, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী মেয়র পদে মাছ মার্কায় মোহাম্মদ হানিফ বিপুল ভোটে এগিয়ে রয়েছে এবং মোহাম্মদ হানিফের মেয়র হওয়া প্রায় নিশ্চিত। আমরা কি এই নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করবো?
তাই নাকি, তাই নাকি, না না বাতিল করবেন কেন? আপনি খেয়াল রাখবেন যাতে এই ফলাফল উল্টে না যায়। আমি পরে আবার আপনার সাথে যোগাযোগ করব।
এরপর জননেত্রী শেখ হাসিনা টেবিল টেলিফোন সেট বন্ধ করে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, শুনলেন তো হানিফ নাকি মেয়র হয়ে যাচ্ছে। এখন তো আমাদের নির্বাচন বাতিলের দাবী করা ঠিক হবে না; কি বলেন?
জিল্লুর রহমান বললেন, দেখেন এটা আবার কোন চাল। আব্দুর রাজ্জাক বললেন, নেত্রী নির্বাচন কমিশনে আমার একজন ঘনিষ্ঠ লোক আছে, আমি তার কাছে যেয়ে সঠিক খবর নিয়ে আসি।
সভানেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, তাই যান। আপনারা সকলেই যান, যার যেখানে লোক আছে সেখান থেকেই সঠিক খবরটা সংগ্রহ করেন।
রাত তখন বারোটা, সবাই চলে গেল। একমাত্র আব্দুর রাজ্জাক ছাড়া আর কোন নেতাই রাতে আর ফিরে এলেন না। রাত দেড়টার দিকে আব্দুর রাজ্জাক মিন্টু রোডে এসে বললেন, সভানেত্রী হানিফ তো মেয়র হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন দেশী-বিদেশী সমস্ত নিউজ মিডিয়াতে হানিফের মেয়র হওয়ার ফলাফল পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন হানিফ বেসরকারীভাবে ঢাকার মেয়র। সভানেত্রীকে সংবাদটা দিতে হয়। আপনি বসেন বলে উপরে গেলাম। সভানেত্রী শেখ হাসিনা ডিশ এন্টিনায় হিন্দি ফিল্ম দেখছিলেন, তাকে আব্দুর রাজ্জাকের আসার সংবাদ এবং হানিফের বেসরকারী ভাবে মেয়র হওয়ার সংবাদ দিলে তিনি বলেন, হানিফের কপাল ভাল। আব্দুর রাজ্জাক দেখা করতে চায় জানালে শেখ হাসিনা বলেন, দূর ছবিটা জমে উঠেছে এই সময় দেখাটেখা হবে না। তুমি বলে দাও আমি (শেখ হাসিনা) ঘুমিয়ে পড়েছি।
তথাস্ত নেত্রী, বলে নিচে এসে আব্দুর রাজ্জাককে বলা হলো আপনি চলে যান, নেত্রী ঘুমিয়ে পড়েছেন। আজ আর উঠবেন না।
আব্দুর রাজ্জাক চলে গেলে এরপর ফোন এলো প্রেসিডিয়াম সদস্য (বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী) আব্দুস সামাদ আজাদ-এর, সভানেত্রীকে সামাদ আজাদের ফোনের কথা বলা হলে, তিনি ঐ একই কথা বলেন, দূর সিনেমাটা জমে উঠেছে। বলে দাও ঘুমিয়ে গেছি। এরপর থেকে যে-ই ফোন করুক বলে দেবে ঘুমিয়ে গেছি।
এরপর থেকে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যে রুমে বসে ডিশ এন্টিনায় হিন্দী ফিল্ম দেখছেন সেই রুম থেকেই হ্যান্ডসেট দিয়ে যে-ই ফোন করেছে তাকেই বলে দেওয়া হচ্ছে নেত্রী ঘুমাচ্ছেন। এই নিয়ে আবার জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং উপস্থিত হিন্দি ফিল্ম দর্শকদের মাঝে হাসির রোল পড়ে গেল।
#আমার_ফাঁসি_চাই #রাজনীতি #মিছিল #চালক #স্বপ্ন #শেখহাসিনা #পলক #ওবাইদুল_কাদের #বিশ্ববিদ্যালয় #খালেদাজিয়া #হাসি #বেসরকারী #১৬ডিসেম্বর #দর্শক #মন্ত্রী #মেয়র #ঘুম