27/04/2025
শিমলা চুক্তি বাতিল: কাশ্মীরের জন্য নতুন সম্ভাবনা, বাংলাদেশের জন্য ইতিহাসের কঠিন শিক্ষা
পাকিস্তান সম্প্রতি ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক শিমলা চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে নানা মহলে জল্পনা-কল্পনা চললেও, সময় এসেছে আবেগ নয়—বরং বাস্তবতা ও ইতিহাসের নিরিখে বিষয়টির গভীরে তাকানোর।
শিমলা চুক্তি: একটি ঐতিহাসিক পটভূমি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে। পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হয়।
এমন এক সময়ে, ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তির মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে একধরনের সমঝোতায় পৌঁছায়। বন্দি পাকিস্তানি সৈন্যদের মুক্তি দিয়ে ভারত বিনিময়ে কাশ্মীর ইস্যুতে একটি কৌশলগত সুবিধা আদায় করে নেয়—পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা না করার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করে।
পরিণতিতে, বাংলাদেশের বিজয়কে ব্যবহার করে ভারত কাশ্মীর দখলের ভিত্তি আরও মজবুত করে তোলে।
বাংলাদেশ: অনুপস্থিত কণ্ঠস্বর
এই চুক্তিতে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি ছিল না, কোনো স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় মূল্য বাংলাদেশই দিয়েছে—লাখো প্রাণ বিসর্জন, নারী-শিশুদের ওপর পাশবিক নির্যাতন এবং অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ।
তার পরও, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের দাবির বদলে ভারত রাজনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে “সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ” চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো—বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলন হয়ে ওঠে বড় শক্তির কূটনৈতিক দরকষাকষির হাতিয়ার।
চুক্তি বাতিলের বাস্তব অভিঘাত
শিমলা চুক্তি বাতিলের মাধ্যমে পাকিস্তান এখন কাশ্মীর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুনভাবে উত্থাপনের সুযোগ পেয়েছে। কাশ্মীরের জনগণের জন্য এটি এক ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা।
তবে কেউ কেউ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অযথা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, যেন পাকিস্তান আবার কোনো দাবি তুলতে পারে। বাস্তবে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর এর কোনো প্রত্যক্ষ হুমকি নেই। পাকিস্তানের কৌশল মূলত ভারতের উপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরিতে নিবদ্ধ, বাংলাদেশের সাথে কোনো সামরিক বা রাজনৈতিক সংঘাতে নয়।
ইতিহাস থেকে নেওয়ার শিক্ষা
শিমলা চুক্তি আজ স্মরণ করিয়ে দেয়—কিভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মোড়লে পরিণত হওয়া শক্তিরা ছোট জাতির আত্মত্যাগকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যার চেতনা ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ন্যায়বিচারের প্রতীক, সেই চেতনার প্রথম বাণিজ্যিকীকরণ ঘটে ভারতের হাত ধরে। কাশ্মীরের জনগণের দুঃখগাথার সূচনাও হয় তখন থেকেই।
এ বাস্তবতা আমাদের শিক্ষা দেয়: ভবিষ্যতে যেন বাংলাদেশের আত্মত্যাগ ও স্বপ্ন কোনো আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হয়ে না ওঠে, তার জন্য আমাদের সচেতন থাকা জরুরি।
শেষ কথা
শিমলা চুক্তির বিলুপ্তি বাংলাদেশের জন্য হুমকি নয়, বরং ইতিহাসের কঠিন অথচ গুরুত্বপূর্ণ এক পাঠ। আত্মমর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষায়, কূটনীতির কাঁটাতারে হারিয়ে না গিয়ে, ইতিহাসের এ শিক্ষাকে সামনে রাখা এখন সময়ের দাবি।