11/14/2025
আজ ১৩ই নভেম্বর ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা CNN-News 18 এ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ব্যাক্তিগত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে । নিচে সাক্ষাৎকারের অক্ষরিক অনুবাদ দেয়া হলোঃ
ঢাকা ছাড়ার পর এই প্রথম এত বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকার পতনের পেছনের ঘটনাপ্রবাহ ও ড. মুহাম্মদ ইউনুসের উত্থান সম্পর্কে কঠোর ভাষায় মন্তব্য করেছেন।
CNN-News18–এর মনোজ গুপ্তাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেন, এটি ছিল একটি “সংস্কারের মুখোশে সাজানো পরিকল্পিত অভ্যুত্থান,” যেখানে উগ্র গোষ্ঠীগুলোর সংশ্লিষ্টতা ছিল এবং বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান চরমপন্থীদের প্রভাবের বিষয়ে তিনি সতর্ক করেন। তিনি নিজের প্রশাসনের পক্ষে অবস্থান নেন, পশ্চিমা হস্তক্ষেপ অস্বীকার করেন এবং ভারতকে ধৈর্য ও আশ্রয়ের জন্য ধন্যবাদ জানান।
এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে হাসিনা সেনাবাহিনীর সংকট, বিদেশি চাপ এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতি নিজের অঙ্গীকার নিয়ে কথা বলেছেন।
প্রশ্ন ১ :
কী ধরনের গোয়েন্দা তথ্য বা হুমকির ইঙ্গিত আপনাকে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করেছিল? এটি কি প্রকৃত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ছিল, নাকি আপনার নিরাপত্তা বলয়ের নীরব সম্মতিতে সাজানো একটি “বাধ্যতামূলক প্রস্থান”?
শেখ হাসিনা:
আগস্টের শুরুতে একসময় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি উগ্রপন্থী উস্কানি দাতাদের নেতৃত্বে এক প্রকার সুপরিকল্পিত দাঙ্গায় পরিণত হয়েছিল। এটি আর সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন ছিল না। অবশ্য, ষড়যন্ত্রের পুরো চিত্র অনেক পরে পরিষ্কার হয়।
যখন ইউনুস গত গ্রীষ্মের সহিংসতার সমস্ত অপরাধীদের ক্ষমা করে দিলেন এবং আমরা যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলাম তা বাতিল করলেন, তখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে আমার সরকারকে পতন ঘটানোর পরিকল্পনা আগেই সাজানো ছিল।
সেই সময় দেশত্যাগ ছিল বেঁচে থাকার প্রশ্ন। আমি দেশ ছাড়তে চাইনি, কিন্তু আমাকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছিল—বাংলাদেশে থাকলে শুধু আমার জীবনই নয়, আমার চারপাশের লোকজনের জীবনও ঝুঁকিতে পড়বে।
প্রশ্ন ২:
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ-জামান কতটা ভূমিকা রেখেছিলেন আপনার প্রস্থান প্রক্রিয়ায়? তিনি কি স্বাধীনভাবে কাজ করছিলেন, নাকি মার্কিন কূটনৈতিক চাপে, নাকি রক্তপাত এড়াতে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াসে কাজ করে ছিলেন?
শেখ হাসিনা:
সেনাবাহিনী তখন অসম্ভব এক পরিস্থিতির মুখোমুখি ছিল—একদিকে সাংবিধানিক সরকার রক্ষা, অন্যদিকে অতি সহিংস জনতার বিরুদ্ধে প্রাণহানি ঠেকানো।আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল আইনশৃঙ্খলার সম্পূর্ণ ভাঙন রোধ করা এবং আমার পরিবার, কর্মী ও ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বাহ্যিক কোনো চাপ ছিল কিনা বা কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল—তা আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি না।
প্রশ্ন ৩:
আপনি কি তখন জানতেন যে, আপনার প্রস্থানের পর একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’-এর ছদ্মবেশে প্রশাসন বসানোর পরিকল্পনা ছিল?
শেখ হাসিনা:
না, তখন আমি কোনো সমন্বিত পরিকল্পনার বিষয়ে অবগত ছিলাম না। আমি শুধু আমার দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। ৫ই আগস্টের ঘটনার পর বুঝতে পারি যে এটি ছিল একটি পরিকল্পিত অভ্যুত্থান। যেভাবে ইউনুস দ্রুত ক্ষমতা দখল করলেন, অপরাধীদের অবিলম্বে দায়মুক্তি দিলেন এবং আমাদের বিচারিক তদন্ত বাতিল করলেন—সবই ইঙ্গিত দেয় এটি আগে থেকেই সাজানো পরিকল্পনা ছিল। মনে হয়, ইউনুস বা যাঁরা তাঁকে বসিয়েছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
প্রশ্ন ৪:
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আপনি কীভাবে দেখেন? তারা কি শুধু রাজনৈতিক সংস্কারের বার্তা দিচ্ছিল, নাকি সত্যিই আপনাকে সরাতে সামরিক-বুদ্ধিজীবী জোটকে সহায়তা করছিল?
শেখ হাসিনা:
আমাদের সব সময়ই ধারাবাহিক মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। আমরা কখনো বিশ্বাস করিনি যে মার্কিন সরকার বা অন্য কোনো বিদেশি শক্তি সরাসরি জড়িত ছিল। যদিও ইউনুস একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে পশ্চিমা মহলে প্রভাবশালী ছিলেন, অনেকে তাঁর অর্থনৈতিক তত্ত্বকে ভুলবশত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভেবে নিয়েছিলেন।এখন সেই বিভ্রম কাটছে এবং তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন ইউনুস আসলে একজন অনির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি বিভিন্ন উগ্রপন্থীদের মন্ত্রী করেছেন, বাংলাদেশের সংবিধান ভেঙেছেন এবং সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের সময় নীরব থেকেছেন। আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক রাখি; তিনিও প্রকাশ্যে বলেছেন যে তিনি ইউনুসকে পছন্দ করেন না।
প্রশ্ন ৫:
চীন কি আপনার শেষ দিনগুলোতে কোনো পরামর্শ দিয়েছিল বা নীরব সমর্থন জানিয়েছিল?
শেখ হাসিনা:
বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক সব সময়ই বাণিজ্য ও নিরাপত্তার ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করেছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও কূটনৈতিক আস্থা বজায় রাখতে হলে আমাদের প্রতিবেশীদের আমাদের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। বর্তমানে অনির্বাচিত ইউনুস সরকারের কারণে এই আস্থা বিপদের মুখে পড়েছে, কারণ তারা বেপরোয়া পররাষ্ট্র ও বাণিজ্যনীতি অনুসরণ করছে। আমি আশা করি, জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল বৈধ সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আবারও একটি নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অংশীদার হিসেবে ফিরে আসবে।
প্রশ্ন ৬:
ভারতীয় সংস্থাগুলো ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আপনাকে দেশত্যাগের পর কীভাবে দেখছে—একজন কৌশলগত অংশীদার হিসেবে, নাকি নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দায় হিসেবে?
শেখ হাসিনা:
ভারত আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু, এবং আমি ভারতীয় জনগণের আতিথেয়তা ও ধৈর্যের জন্য গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে ভারতের স্বার্থ একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যেই নিহিত। ইউনুসের ভারতের সঙ্গে সমস্যা আমার কারণে নয়—এটি তাঁর উগ্রপন্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা, সংখ্যালঘু সুরক্ষায় ব্যর্থতা এবং তাঁর সরকারের ভারতী বিরোধী বক্তব্যর ফল। এগুলো একজন অনভিজ্ঞ নেতার কাজ, যিনি আমাদের অংশীদারিত্বের মূল্য বোঝেন না। আমি ভারতের ধৈর্যের প্রশংসা করি—তারা অপেক্ষা করছে এমন একজন নেতার জন্য যিনি আমাদের দেশকে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দিতে পারবেন।
প্রশ্ন ৭:
আপনি কি আবার রাজনীতিতে ফিরবেন, নাকি প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রভাব বজায় রাখার চিন্তা করছেন?
শেখ হাসিনা:
আমি আমার জীবন বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য উৎসর্গ করেছি। আমাদের ১৫ বছরের শাসনকালে আমরা বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছি, বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছি এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ শুধু আমার বা আমার পরিবারের দল নয়; এটি বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত একটি আন্দোলন। যদি আমরা সত্যিই গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ চাই, তাহলে সংবিধানসম্মত শাসনে ফিরে যেতে হবে—মুক্ত, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে।
প্রশ্ন ৮:
আপনার মতে, ড. মুহাম্মদ ইউনুস কি পশ্চিমা সমর্থিত একটি “নাগরিক মুখ” মাত্র, নাকি আরও বিস্তৃত এক বিরোধী-আওয়ামী জোটের প্রতীক?
শেখ হাসিনা:
এটি কোনো গোপন বিষয় নয় যে, ইউনুস ক্যালিফোর্নিয়ার বুদ্ধিজীবী মহলে জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর অর্থনৈতিক কাজের কারণে।কিন্তু তিনি কোনো গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতীক নন এবং তাঁর জনসমর্থনও খুব সীমিত। তিনি একজন অনির্বাচিত ব্যক্তি, যিনি এখন এমন একটি দলকে নির্বাচনে নিষিদ্ধ করতে চাইছেন যা জনগণের কোটি কোটি ভোটে ৯ বার নির্বাচিত হয়েছে। যদি পশ্চিমারা মনে করে ইউনুস গণতান্ত্রিক মুখ, তারা ভুল করছে—আসলে তিনি উগ্রপন্থী প্রশাসনের ‘সামনের মুখোশ’, যারা প্রতিশোধমূলক ও সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে।
প্রশ্ন ৯:
আপনি ভারতের কাছ থেকে কী ধরনের সহায়তা আশা করছেন—রাজনৈতিক আশ্রয়, কূটনৈতিক সমর্থন, নাকি আওয়ামী ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্ক পুনর্গঠনে সাহায্য?
শেখ হাসিনা:
ভারত ইতিমধ্যেই আমাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে, পাশাপাশি সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগকে দেশে নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন নেই—আমাদের প্রতি লাখো সাধারণ মানুষের সমর্থন এখনও অটুট।বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধন বহু পুরোনো ও গভীর। আমরা শুধু চাই, ভারত বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকুক এবং ইউনুস প্রশাসনের শত্রুতামূলক অবস্থানকে উপেক্ষা করুক।
প্রশ্ন ১০:
আপনার মতে, ভারত ও আঞ্চলিক মিত্ররা কীভাবে বাংলাদেশকে একটি পাকিস্তান ধাঁচের “হাইব্রিড” বা ইসলামপন্থী সামরিক শাসন ব্যবস্থায় পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে?
শেখ হাসিনা:
আমি আগেই বলেছি, আমার আশঙ্কা ইউনুস মূলত হিযব-উত-তাহরিরের মতো উগ্র গোষ্ঠীর পরিচালিত এক প্রতীকী মুখমাত্র। আমি ভারতের বন্ধুদের অনুরোধ করছি—তারা যেন ইউনুসকে উৎসাহিত করেন মুক্ত, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য, যাতে দেশের কোটি কোটি মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার একমাত্র উপায় হলো জনগণের সম্মতিতে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা। এটাই আমাদের দেশকে ভবিষ্যতের অস্থিরতা ও শাসনব্যবস্থার অবক্ষয় থেকে রক্ষা করার সর্বোত্তম পথ।