09/15/2025
Do you find any similarities :
ইংল্যান্ড ও আমার অভিজ্ঞতা:
লন্ডনে আসার পর গত তিন বছরে এই প্রশ্নের উত্তর এখন আমার কাছে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। এক কথায় যদি বলি, ইংল্যান্ডে আমার ধারণা মতে ৭০ - ৮০% মুসলিমের শরীরে হারাম রক্ত। ইনকামে হারামের গন্ধ।
এই বছরের পহেলা রমজান থেকে চার মাস তাবলীগে ছিলাম। সেই সুবাদে ইংল্যান্ডের অনেক শহরেই ঘুরে বেড়িয়েছি। এর মধ্যে প্রায় তিন মাস ছিলাম একটি বিদেশী জামাতের অনুবাদক হিসেবে। কখনো আরবী থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ, কখনো উর্দু থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হতো। বিভিন্ন মসজিদে জুমার নামাজ পড়ানোর জন্য এবং ধর্মীয় আলোচনার জন্য আমাকে বড়দের থেকে আদেশ করা হতো।
একদিন বাংলাদেশী একটি মসজিদে জুমার বয়ানের আগ মুহূর্তে সেই মসজিদের ইমাম সাহেব আমাকে কানে কানে বলে দিলেন, মাওলানা! মদের বিষয় ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন। শুধু মদের বিষয়টি নিয়ে কোন কথা বলবেন না। ইমাম সাহেবের মুখ থেকে এই কথা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম।
পরে জানতে পারলাম, সেই মসজিদ কমিটির সভাপতি থেকে শুরু করে মোটামুটি সবাই তাদের রেস্টুরেন্টে মদ বিক্রি করেন। এবং এটাই তাদের প্রধান ইনকাম। অথচ আবার দেখা যায়, তাদের ছেলেরা মাদ্রাসায় পড়ছে। আপনারাই বলুন! যেই সন্তানের রক্তে বাবার ইনকামের হারাম মিশে আছে, সেই সন্তানের হৃদয়ে কুরআন কতটুকুই বা প্রভাব বিস্তার করতে পারে?
আমার তখন মনে পড়ে গেল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই হাদিসের কথা, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, এমন একটা সময় আসবে যখন বান্দা কোরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু কুরআন তার কন্ঠনালী অতিক্রম করবে না।
আজ ইংল্যান্ডে ঘরে ঘরে কোরআনের হাফেজ মিলে কিন্তু তারা ইসলামিক বিধান থেকে যোজন যোজন দূরে। দাওরায়ে হাদিস পড়ুয়া আলেমা পাওয়া যায় মোটামুটি সবার ঘরেই। কিন্তু এসব আলেমা বোনদের থেকে আমার গ্রামের মূর্খ দাদী নানীরা আরো ভালো পর্দা করে।
আমার একটা ইচ্ছে ছিল, বাংলাদেশী মুসলিম ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট বা এই ধরনের চ্যারিটি-মূলক কাজ করার। এটা আমার একটা স্বপ্ন বলা চলে। অভিজ্ঞতার জন্য এশিয়ান রুরাল ফাউন্ডেশন এর অধীনে বেশ কিছুদিন কাজ করেছি। উম্মাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এবং অন্যান্য কিছু চ্যারিটির সাথে ওঠা-বসা হয়েছে।
একদিন কোন এক চ্যারিটির হেড অফিসে গেলাম, সেখানে এক বোন আমাকে স্বাগত জানালেন। স্মার্টনেস আর আধুনিকতায় তার কোন কমতি ছিল না। আমি ভেবেছিলাম হয়তো তিনি নাম মাত্র মুসলমান। কথা বলার এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেই বোনটি আমাকে জানালেন, তিনি দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে আলেমা উপাধি গ্রহণ করেছেন। আমার চোখ তখন কপালে উঠে গেল। এ আমি কি শুনছি? এই যদি হয় একজন আলেমা বোনের পোশাকের অবস্থা। ইংল্যান্ডে আমাদের ভবিষ্যৎ কি হতে যাচ্ছে?
তার থেকেও বেশি অবাক আমি সেদিন হয়েছিলাম, যেদিন হাসপাতালে 19 বছর বয়সী এক মুসলিম যুবককে শূকরের গোস্ত খাইতে দেখলাম। ছেলেটির নাম ছিল মোহাম্মদ। আগ্রহের বসে তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম তিনি ইরানের ছেলে। ইংল্যান্ডেই তার জন্ম। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে শুকরের গোশত খাচ্ছো, এটা কি তোমার আব্বু-আম্মু জানে? ছেলেটি জানালো, তার মা-বাবার সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই।সরকারি আশ্রয়ে সরকারি ভাতা গ্রহণ করে বেনেফিটে আছে। নিজের মতো করে চলে।
ইংল্যান্ডের আইন হলো, সন্তান 18 বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত মা-বাবা যদি কখনো সন্তানকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলে কিংবা ধমক দেয়, সোশ্যাল সার্ভিস জানতে পারলে কিংবা সন্তান যদি স্কুলে গিয়ে তার শিক্ষকদের জানিয়ে দেয়, তাহলে কোন সাক্ষী প্রমান ছাড়াই সেই মা-বাবাকে জেলে থাকতে হবে এবং সোশ্যাল সার্ভিস এসে এই সন্তানকে এমন কোথাও নিয়ে যাবে যে, এই মা-বাবা সন্তানকে আর খুঁজে পাবে না। আর সন্তানের বয়স যখন ১৮ হয়ে যাবে, তখন সে চাইলেই মা-বাবাকে ছেড়ে আলাদা সরকারি বাসায় চলে যেতে পারবে। এই কারণে অভিভাবকগণ সব সময় আতঙ্কে থাকেন।
পাকিস্তানি এক পরিবারের ঘটনা তুলে ধরছি। এক ভদ্রলোকের দ্বিতীয় সন্তান দুনিয়াতে আসলো। প্রথম সন্তান তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। বয়স আনুমানিক পাঁচ কিংবা ছয়। বাবা তার প্রথম সন্তানকে বুঝালো, আমি আল্লাহর কাছে তোমার জন্য একটা ছোট ভাই চেয়েছিলাম, আল্লাহ তায়ালা ডাবের ভিতরে করে তোমার জন্য এই ছোট্ট ভাইটি উপহার দিয়েছেন।
পরের দিন ছেলেটি স্কুলে গিয়ে তার সহপাঠীকে খুশির সংবাদ দিল, আমার আব্বু ডাবের ভিতরে আমার জন্য একটা বেবি পেয়েছেন, এটা বড় হলে আমাকে ভাই ডাকবে। ঘটনাক্রমে এই সংবাদটি স্কুল শিক্ষিকার কানে পৌঁছে গেল। তখন স্কুল শিক্ষিকা ক্লাসের সবাইকে ডিজিটাল ওয়াল স্ক্রিনে দেখালেন, কিভাবে মায়ের পেটে সন্তানের জন্ম হয় এবং কিভাবে দুনিয়াতে আসে। এবং আরো বলে দিলেন, তোমার আব্বু যা বলেছেন 'সন্তান ডাবের ভিতর থেকে পেয়েছেন' এটা মিথ্যা কথা।
বাসায় ফিরে পাকিস্তানি পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটি যখন বাবাকে জানালো, তার শিক্ষিকা তাকে সবকিছু শিখিয়েছেন, মায়ের পেটে কিভাবে সন্তান তৈরি হয়? কিভাবে সন্তান দুনিয়াতে আসে? সন্তানের মুখের কথাগুলো শুনে বাবা লজ্জায় নত হয়ে গেলেন। এবং পরদিনই তিনি পাকিস্তানের টিকেট কেটে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইংল্যান্ড ছেড়ে পাকিস্তান চলে গেলেন।
আরেকটি গোপন ঘটনা শেয়ার করছি, ম্যানচেস্টারের এক ভদ্র মহিলা (যিনি সম্পর্কে আমার খালা হন) তার নিজের আপন ভাতিজার জন্য বাংলাদেশ থেকে তার আপন বোনজি তানি ( ছদ্মনাম) আপুর সাথে বিবাহ পাকাপুক্ত করলেন।
অথচ এই ভদ্র মহিলা জানতেন না যে, ভদ্র চেহারার আড়ালে তার ভাতিজা একজন ড্রাগ ডিলার ( যা ইসলামিক আইনে এবং ইংল্যান্ডের আইনে অবৈধ)। তিনি তো ভাতিজার সাদামাখা চেহারা দেখে ভালো মনে করেই নিজের কলিজার বোনজির সাথে তার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এতে করে যদি বোনজি লন্ডনে আসতে পারে।
কিন্তু সেই ভদ্র মহিলার বড় ছেলে মুটামুটি একজন ভালো আলেম বলা চলে। তিনি জানতেন তার চাচাতো ভাই ড্রাগ ডিলিং এর সাথে জড়িত। তখন তিনি গোপনে আপন চাচাতো ভাইকে ব্ল্যাকমেইল করলেন এই বলে যে, তুমি যদি আমার খালাতো বোনকে বিয়ে করতে চাও, তাহলে তোমার গোপন অবৈধ ব্যবসার কথা আমি পরিবারের সবাইকে জানিয়ে দিব। যদি বাঁচতে চাও, তাহলে আমার মাকে বলে দাও যে, মেয়ে পছন্দ হয়নি। তুমি এই বিয়ে ক্যানসেল করে দাও। পড়ে তাই হল। আজ পর্যন্ত কেউ জানে না, এই বিয়েটি কেন ক্যান্সেল হয়েছিল। বড় ভাই মাওলানা সাহেব নিজেই আমাকে এই ঘটনাটি শুনিয়েছেন।
এখন হয়তো আপনারা কিছুটা অনুমান করতে পারছেন, ইংল্যান্ডের ছেলেগুলো উপরের দিক থেকে যতটা সহজ-সরল মনে হয়, ভিতরের দিক থেকে তারা ততটাই শিয়ানা। পাক্কা খেলোয়ার।
আরো অবাক হয়েছিলাম সেই ভাইকে দেখে, যার বাবা অনেক বড় একজন আলেম এবং ইংল্যান্ডে একটি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, অথচ তিনি মদকে খান না বরং মদ তাকে খায়।
এই ইংল্যান্ডে সবকিছুই হলো আই ওয়াশ। যেখানে ধর্মের পোশাক পরে ধর্মের আড়ালে অধর্ম চলে। তারপর দু-একবার ওমরা করে তারা মনে করে পবিত্র হয়ে গিয়েছে।
সুদ হারাম। কোন সন্দেহ নেই। মসজিদের এক আলেম সুদের মাধ্যমে ঘর কিনেছেন। জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দিলেন, থাকার জন্য একটি ঘর সুদের মাধ্যমে কিনা জায়েজ। নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক। অথচ ইংল্যান্ডের এবং সারা বিশ্বের বড় বড় মুফতিদের ফতোয়া হল সুদ সব সময়ই হারাম।
কিন্তু আমার কাছে মদের ব্যবসায়ীর চাইতেও ভয়ানক মনে হয় সে সকল ভন্ড কিছু মোল্লাদের, যারা ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে শরিয়া কাউন্সিল নাম দিয়ে ধর্মের নামে অধর্ম করে বেড়ায়। আমি বলি এরা শয়তানের কাউন্সিল। যদিও এরা লিবাসে আলেম, এদের শরীরে তো এদের বাপ-দাদাদের হারাম ইনকামের রক্ত মিশে আছে। এসব ভন্ড মোল্লারা সমাজে ফেতনা তো ছড়াবেই। এতে যদি এদের পকেট ভারি হয়!
এমনকি কত বড় দুঃসাহস, ভন্ড ফেতনাবাজ মোল্লারা স্বামীর অনুপস্থিতে কিংবা স্বামীকে না জানিয়ে, স্বামীর থেকে অনুমতি না নিয়ে মনগড়া তালাকের সার্টিফিকেট বানিয়ে ব্যবসা করে। অথচ ইসলামে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র স্বামীর।
এই বিষয়ে বুখারী শরীফের ইংরেজি অনুবাদক ব্রাডফোর্ডের মুফতি সাইফুল ইসলাম হাফিজাহুল্লাহ, বার্মিংহামের দারুল ইলম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি তাওছির হাফিজাহুল্লাহ, ম্যানচেস্টারের প্রখ্যাত দায়ী মিশরীয় আলেম শায়েখ আওয়াদাল্লাহ হাফিজাহুল্লাহ সহ আরো অনেক বড় বড় আলেমদের সাথে আমার কথা হয়েছে।
সবাই এই ব্যাপারে একমত, এসব মনগড়া শরিয়া কাউন্সিল
থেকে যেসব মহিলারা মনগড়া তালাকের সার্টিফিকেট বানিয়ে প্রথম স্বামীকে ছেড়ে দ্বিতীয় পুরুষের কাছে যায়, আল্লাহর বিধান অনুসারে এসব মহিলারা আজীবন যিনায় লিপ্ত থাকে। এদের থেকে কোন সন্তান হলে সেই সন্তান জারজ সন্তান হিসেবে বিবেচিত হবে।
বিনীতভাবে আমি সেসব শ্রদ্ধাভাজন মাথার মুকুট ইলমের বিদ্যাপীঠ মুফতি সাহেবদের যখন জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কেন এসব ভন্ড শরিয়া কাউন্সিলের বিরুদ্ধে কথা বলছেন না?
উত্তর ছিল খুবই স্বাভাবিক। এটা ইংল্যান্ড। এখানে যার যা ইচ্ছা সে তা করতে পারে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
এই দেশে বিবাহ ছাড়াই যদি কোন ছেলে মেয়ে একসাথে থাকে, মা-বাবার কোন অধিকার নেই এই ছেলে মেয়েকে ধমক দেয়ার। সেখানে আমরা কিভাবে এসব শরিয়া কাউন্সিল নামের শয়তানের কাউন্সিল দমন করব?
আমার এখন বারবার শুধু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই হাদিসটির কথাই মনে পড়ছে, এমন একটা সময় আসবে যখন মানুষ কোরআন পাঠ করবে কিন্তু এই কুরআন তাদের কন্ঠনালী অতিক্রম করবে না।
ইংল্যান্ডে প্রতিবছর হাজারো মুসলিম নারী প্রথম স্বামী থেকে ইসলামীক বিধান মুতাবেক সত্যিকার অর্থে তালাক না নিয়েই সাময়িক সুখ ও বিলাসিতার আশায় দ্বিতীয় পুরুষের সাথে সংসারের নামে আজীবন যিনায় লিপ্ত হচ্ছে।
উসুল হল- কেউ যদি কোন হারাম কাজ করে তাহলে সে গোনাহগার হবে। কিন্তু কেউ যদি এই হারামকে হালাল বলে দাবী করে, তখন সে কাফের হয়ে যাবে। ঈমান চলে যাবে।
সেই হিসেবে যেসব মহিলারা প্রথম স্বামীর থেকে তালাক না নিয়ে দ্বিতীয় পুরুষের সাথে সংসার করছে, সে যদি বিশ্বাস করে যে এটা হারাম তাহলে তো কেবল গুনাহগার হবে। আর যদি এই হারামকে হালাল বলে দাবি করে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।
এসব বিষয় যখন আমার সামনে আসলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসটির কথা মনে পড়ে গেল, একটা সময় আসবে যখন ঈমান নিয়ে বান্দা ঘুমাবে কিন্তু সকাল বেলা ঈমানহারা হয়ে ঘুম থেকে উঠবে। সকালে ঈমান আনবে তো বিকালে ঈমানহারা হয়ে যাবে।
এখন আমার কাছে এই মাসআলাটি পরিষ্কার যে, কেবল দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে মুসলিম দেশ থেকে অমুসলিম দেশে সফর করাকে আহলে হক ওলামায়ে কেরাম নাজায়েজ ফতোয়া কেন দিয়ে থাকেন।
শেষ যমানার ফেতনার যুগে আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে ঈমানের উপর অটল ও অবিচল থাকার তৌফিক দান করুন। আমাদের সকল দুঃখ-কষ্টকে সুখে রূপান্তরিত করে দিন। ভবিষ্যতের সকল বালা-মুসিবত দূর করে দিন। আমীন।।
- শোয়াইব আহমাদ