10/12/2025
✍🏽 আরিফ রহমান
আমার এক বছর এক মাস বয়সী বাচ্চা মেয়ে রাতে ঘুমানোর সময় ওর মায়ের দিকে চটকে থাকে, আমার দিকে বেশি আসে না। কিন্তু ঘুমানোর পর সে পুরো খাটে ঘুরে বেড়াতে থাকে। গত রাতে ঘুরতে ঘুরতে সে আমার পায়ের কাছে আসছে। ওকে সোজা করলাম।
ও কিছুক্ষণ তার ছোট হাত দিয়ে আমার কান টানলো। আবার ঘুমের ভেতরেই মায়ের দিকে চলা শুরু করলো।
আমি চিফ এডভাইজারের পেইজে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের তথ্যের উপর বানানো প্রামাণ্যচিত্রটা দেখতেসিলাম।
সম্ভবত আপনারা সবাই এতক্ষণে দেখে ফেলসেন।
ওখানে মাঝামাঝি জায়গায় ১৫ বছর বয়সী একটা ছেলের গল্প আছে। না, ছেলেটার পরিবার থেকে কোন অভিযোগ করা হয় নাই। কিন্তু সে যেই সেলে ছিলো তার আশেপাশের সেল থাকা ভিকটিমরা একটা বাচ্চা ছেলের কান্নার আওয়াজ পাইতো। একটা ছেলে নাকি সারাদিন কাঁদতো।
ঐ আশেপাশের সেলের ভিকটিমরা গুম কমিশনে এসে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এই ছেলে কথা বলতো। কমিশনের কাছে অনুরোধ করতো ছেলেটার খোঁজ বের করতে।
তারপর বিরাট কাহিনী। কীভাবে তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো ইত্যাদি। সব ঐ প্রামাণ্যচিত্রে আছে, আমি সেসব আরেকবার না বলি।
আমি বলি গতকাল মধ্যরাতে কেন আমার ব্রেকডাউন হইলো।
তো ছেলেটার বাবা বলতেসে যখন ওনারা ছেলেটারে যখন পাইসেন, তার দুই পায়ে আর দুই হাতে কোন নখ ছিলো না। প্রতিটা নখ টেনে টেনে তোলা হইসে।
চিন্তা করেন ১৫ বছরের একটা ছেলে। তাকে প্রতিদিন পেটানো হচ্ছে। হাতের নখ তুলে ফেলা হচ্ছে।
প্রামাণ্যচিত্রের বাকিটা আমি আর দেখতে পারি নাই।
-
কমিশন গুম হওয়া মানুষদের ভেতর প্রেগন্যান্ট, বৃদ্ধ, তরুণ, রিকশাচালক, ধনী সবই পেয়েছে।
একটা সাক্ষ্য আছে ছয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে মায়ের সাথে নিয়ে গেছে, মেয়েটা বলতেসে যে তার মা'কে কালো টুপি পরাইয়া নিয়া যাওয়া হইতো।
যারা গুম ছিলেন অনেকদিন- তারা এখন অনেক কিছুতে ট্রিগার হন। কেউ হাইস গাড়ি দেখলে, কেউ লাক্স সাবানের গন্ধ পেলে, কেউ তাকে নির্যাতনের সময় যে গান বাজানো হতো সেটা শুনলে।
-
আসলে এই লেখা ঐ প্রামাণ্যচিত্রে কি কি আছে সেসবের কাহিনী বলার জন্য লিখতেসি না। সেটা আপনারা দেখেই নিতে পারবেন। বরং নখ তুলে ফেলার কাহিনীটা তো অন্যতম কম নির্মম একটা ঘটনা।
আসলে এটা দেখার সময়কার আমার অভিজ্ঞতার কথা আমি বলতে চাই। যখন ১৫ বছর বয়সী ছেলেটার কাহিনী শুনতেসিলাম তখন আমার শরীরে প্রচন্ড খিঁচুনির মতো দেখা দিলো।
আমি শোয়া থেকে বসে পড়লাম এবং দীর্ঘ সময় কাঁদলাম।
সেদিন আমাদের দ্য পোস্টের অফিসে সহকর্মীদের সাথে আওয়ামী আমলে আমাদের দালাল মিডিয়ায় চাকরি করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিজেদের মেধা আর কর্ম দিয়ে সাহায্য করার অপরাধ কতোটা বড় বা ছোট অপরাধ ছিলো তা নিয়ে আলাপ করতেসিলাম।
আমি প্রায়শই বাংলাদেশের সিনিয়ার সাংবাদিকদের 'মননের আওয়ামী লীগ' নিয়ে ফেসবুকে লেখালিখি করি, আমার বহু সাবেক সিনিয়ার কলিগরা মনঃক্ষুণ্ণ হন।
তো আমাকে এক সহকর্মী বললেন- তুইও তো কাজ করেছিস।
আমি বললাম হ্যা আমি করসি তো। করসি দেখেই তো সাব-এডিটরের উপরের কোন পদে আমাকে কোন প্রতিষ্ঠান যোগ্যই মনে করে নাই।
সবচেয়ে নিম্ন থেকে নিম্নতম পদে থেকেও সিনিয়ারদের কাছে বেয়াদব, শিবির, মৌলবাদী হেন তকমা নাই যেটা আমাকে দেয়া হয় নাই।
এবং এতোকিছুর পরেও তো আমি এখন দোষ স্বীকার করি। আমি একনলেজ করি আমার অপরাধ। আমি মনে করি কোন না কোন লেয়ারে আমার কি বোর্ডে দুইটা লাইন নিউজ লেখা আওয়ামী লীগের দমনের হাতকে আরও শক্তিশালী করসে। আমার এক্টিভিজম মানুষকে রাক্ষস বানানোর রসদ জোগাইসে।
আপনারা কয়জন এই বীক্ষণ করেছেন?
এই তর্ক সেদিন করা গেছে। মনে হয়েছিলো জিতেই গেছি।
কিন্তু গতকাল মধ্যরাতে যখন অশ্রু আমার মুখ থেকে গড়িয়ে পায়জামার উপর এসে পড়েছে- তখন এই তর্ক টেকে নাই।
আমরা প্রগতির নামে, মুক্তবুদ্ধির চর্চার নামে কি করি নাই? হোয়াট নট?
আমার বাচ্চার আঙুল থেকে নখ তুলে নেয়া হইতেসে একটা একটা করে- আর আমরা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জঙ্গি, শিবির এইসব আউড়ে গেছি।
-
পনেরো বছর বয়সী সেই ছেলেটি এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
ছেলেটির দরিদ্র পিতা না তার চিকিৎসা করতে পারছে না মামলা করতে পারছে। দুই বছর পর তার 'পুত' ফিরে আসছে এইটা নিয়েই সে সন্তুষ্ট। আল্লার কাছে কৃতজ্ঞ।
আমি এক সময় বাম রাজনীতি করতাম। কৃষকের কাটারিভোগ ধান কৃষক নিজেই খাইতে পারে না, কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলের বক্তব্য শেয়ার করে আবেগে ভাসতাম।
ঐ অদেখা কন্সেপচুয়াল কৃষকের জন্য আমি আবেগপ্রবণ হতাম, কিন্তু এই দরিদ্র পিতার পনেরো বছরের কিশোর সন্তানের প্রতি আমার আবেগ জন্মাতো না।
আমরা গুমের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, খুনের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, আবার আমরাই কয়েকজন মনের ভেতরে ঠিকই ভাবতাম কিছু শিবিরের পোলাপানের সাথে এমনটা হওয়াই উচিত।
এই যে ধরেন এই লেখাটা পোস্ট করার কিছুক্ষণের মধ্যেই আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগের সমর্থকেরা এসে প্রমাণ করে দেবে ইউনুস সরকারের ঐ রিপোর্ট ভুয়া, ছেলেটা কতো ভয়াবহ জঙ্গি ছিলো ইত্যাদি।
আরে এরা তো আবরারকে শিবির বানিয়েছেই বিশ্বজিৎকেও শিবির বনিয়েছে।
আসলে এই আওয়ামী লীগ-যুবলীগের সদস্যদের, দেশের সাংবাদিক সুশীল সমাজ কিংবা বিদ্যান বুদ্ধিজীবী সমাজের তো কখনো বিচার হবে না।
সেই বিচারের ওয়াক্ত পারও হয়ে গেছে বহু আগে।
-
কিন্তু আমি আমার বিচার চাই।
আমার কয়েকটি নখ উপড়ে ফেলা হোক, আমাকে তিন ফুট বাই সাড়ে চারফুটের অন্ধকার রুমে কিছুদিন রাখা হোক, আমাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে রেখে কিছুদিন পেটানো হোক। একটা প্রতীকী বিচার অন্তত হোক। আমি উইশফুলি চাইতেসি আমার ইন্টেলেকচুয়াল ক্রিমিনাল এক্টিভিটির জন্য আমাকে বিচারের আওতায় আনা হোক।
এই নিষ্ঠুর ক্লেদ থেকে আমি মুক্ত হতে চাই।
ঐ পনেরো বছরের ছেলেটি যদি আমাকে ক্ষমা না করে- তাহলে আমার আল্লাহর কেয়ামত কিংবা আমার নফসের কেয়ামত, আমার বিবেকের বিচার- কেউ আমাকে ক্ষমা করবে না। আমি আমার সন্তানের দিকে কখনো চোখ তুলে তাকাতে পারবো না।