22/11/2025
#শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রধান ১৮টি অধ্যায়ের নামকরণের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, কারণ এই অধ্যায়গুলি বিভিন্ন যোগ বা আধ্যাত্মিক পথের উপর আলোকপাত করে। প্রতিটি অধ্যায়ই অর্জুনকে দেওয়া শ্রীকৃষ্ণের উপদেশের এক-একটি অংশ, যা সম্মিলিতভাবে জীবনের চূড়ান্ত সত্যের দিকে পরিচালিত করে।
এখানে ১৮টি অধ্যায়ের নাম ও তাদের মূল তাৎপর্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
| অধ্যায় সংখ্যা | সংস্কৃত নাম | বাংলা নাম | মূল তাৎপর্য (সংক্ষেপে) |
|---|---|---|---|
| ১ | অর্জুন-বিষাদ যোগ | অর্জুনের বিষাদ যোগ | যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন দেখে অর্জুনের মোহ, শোক ও যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার ইচ্ছা। |
| ২ | সাংখ্য যোগ | সাংখ্য যোগ | শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা আত্মা ও দেহের পার্থক্য, অমর আত্মার জ্ঞান, এবং নিষ্কাম কর্মের প্রাথমিক উপদেশ। গীতার সার এই অধ্যায়ে নিহিত। |
| ৩ | কর্মযোগ | কর্ম যোগ | ফলাফলের আশা না করে স্বধর্ম অনুসারে কর্ম করার অপরিহার্যতা এবং কর্মবন্ধন থেকে মুক্তির উপায়। |
| ৪ | জ্ঞান কর্ম সন্ন্যাস যোগ | জ্ঞান কর্ম সন্ন্যাস যোগ | দিব্য জ্ঞানের উৎস ও পরম্পরা, জ্ঞানের মহিমা এবং নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে জ্ঞানের পথ। |
| ৫ | কর্ম সন্ন্যাস যোগ | কর্ম সন্ন্যাস যোগ | কর্মযোগ ও কর্মসন্ন্যাস (জ্ঞানের পথে কর্মত্যাগ) এর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব, এবং যোগযুক্ত জীবনযাপনের বর্ণনা। |
| ৬ | আত্মসংযম যোগ | আত্মসংযম যোগ | মন ও ইন্দ্রিয় সংযমের মাধ্যমে ধ্যান বা যোগের পদ্ধতি, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের গুরুত্ব। |
| ৭ | জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ | জ্ঞান বিজ্ঞান যোগ | পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের তত্ত্ব জ্ঞান (জ্ঞান) এবং তাঁর লীলা ও মায়ার বিজ্ঞান (বিজ্ঞান)। |
| ৮ | অক্ষরব্রহ্মযোগ | অক্ষর ব্রহ্ম যোগ | ব্রহ্ম, অধ্যাত্ম, কর্ম, অধিদৈব, অধিযজ্ঞ এবং অন্তিমকালে ভগবানকে স্মরণ করে মুক্তি লাভের পথ। |
| ৯ | রাজবিদ্যা রাজগুহ্য যোগ | রাজবিদ্যা রাজগুহ্য যোগ | পরমেশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ ও গোপনীয় জ্ঞান, তাঁর অচিন্ত্য শক্তি এবং ভক্তির মহিমা। |
| ১০ | বিভূতি যোগ | বিভূতি যোগ | শ্রীকৃষ্ণের অসীম ঐশ্বর্য, শক্তি ও সৃষ্টির মধ্যে তাঁর মুখ্য প্রকাশ বা বিভূতিসমূহের বর্ণনা। |
| ১১ | বিশ্বরূপ দর্শন যোগ | বিশ্বরূপ দর্শন যোগ | অর্জুনের অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ প্রকাশ এবং তার মহিমা দর্শন। |
| ১২ | ভক্তিযোগ | ভক্তি যোগ | সাকার (ব্যক্তিগত রূপ) ও নিরাকার (অব্যক্ত) উপাসনার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব এবং ভক্তের লক্ষণ। |
| ১৩ | ক্ষেত্র ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগ যোগ | ক্ষেত্র ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগ যোগ | দেহ (ক্ষেত্র) এবং আত্মার (ক্ষেত্রজ্ঞ) জ্ঞান এবং প্রকৃতি ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য। |
| ১৪ | গুণত্রয় বিভাগ যোগ | গুণত্রয় বিভাগ যোগ | প্রকৃতির তিন গুণ—সত্ত্ব, রজ ও তম—এর স্বরূপ, বন্ধন এবং এই গুণগুলিকে অতিক্রম করার উপায়। |
| ১৫ | পুরুষোত্তম যোগ | পুরুষোত্তম যোগ | জগতের প্রতীকস্বরূপ অশ্বত্থ বৃক্ষের বর্ণনা, ক্ষর (নশ্বর) ও অক্ষর (অবিনশ্বর) পুরুষ এবং পুরুষোত্তম (পরমাত্মা) তত্ত্ব। |
| ১৬ | দৈবাসুর সম্পদ বিভাগ যোগ | দৈবাসুর সম্পদ বিভাগ যোগ | দৈবী (সদ্গুণ) এবং আসুরী (দুর্গুণ) স্বভাবের বর্ণনা এবং তাদের ফল। |
| ১৭ | শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ | শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ | শ্রদ্ধা, আহার, যজ্ঞ, তপস্যা ও দান - এদের সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভেদের আলোচনা। |
| ১৮ | মোক্ষ সন্ন্যাস যোগ | মোক্ষ সন্ন্যাস যোগ | সন্ন্যাস ও ত্যাগের যথার্থ স্বরূপের ব্যাখ্যা এবং গীতার সকল উপদেশের চূড়ান্ত উপসংহার (যেমন: সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ...)। |
🧭 তাৎপর্য
এই ১৮টি অধ্যায়ের নামগুলি নির্দেশ করে যে গীতা কেবল একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, এটি একটি যোগশাস্ত্র। এখানে 'যোগ' শব্দটি বিভিন্ন পথ বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মনকে ঈশ্বর বা পরম সত্যের সাথে যুক্ত করার পদ্ধতিকে বোঝায়। এই পথগুলি হলো—
* কর্মযোগ (অধ্যায় ৩): নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে মুক্তি।
* জ্ঞানযোগ (অধ্যায় ২, ৪, ৫, ৭, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮): তত্ত্ব জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি।
* ভক্তিযোগ (অধ্যায় ৭, ৯, ১০, ১১, ১২): প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে মুক্তি।
গীতার শেষে, মোক্ষ সন্ন্যাস যোগ অধ্যায়ে সমস্ত যোগের সমন্বয় ঘটিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে সকল প্রকার ধর্ম (কর্তব্য বা উপায়) ত্যাগ করে কেবলমাত্র তাঁর শরণাগত হতে উপদেশ দেন, যা এই ১৮টি অধ্যায়ের উপদেশের চূড়ান্ত ফল এবং সারকথা।