03/09/2025
স্বামীজী বলিলেন, যদি আর একটি বিবেকানন্দ থাকত, তবে বুঝতে পারতো বিবেকানন্দ কি করে গেল?
ভারতাত্মার বাণীমূর্তি
স্বামী বিবেকানন্দ..
জগতের ইতিহাসে দেখা যায় যখনই যুগপ্রয়োজন সাধনের নিমিত্ত শ্রীভগবান্ নরদেহ ধারণ করিয়া ধরাধামে অবতীর্ণ হন, তখনই সঙ্গে লইয়া আসেন তাঁহার অন্তরঙ্গ পার্যদের। প্রত্যেক যুগেরই এক একটি বিশিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁহাদের আবির্ভাব। বর্তমান যুগে পাশ্চাত্যমোহে আচ্ছন্ন জগতে ভারতের শাশ্বত সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের জন্যই শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব। তাঁহার শ্রেষ্ঠতম সহচর শ্রীবিবেকানন্দের আবির্ভাবও সেই উদ্দেশ্যকে সার্থকতার পথে পরিচালিত করিতে। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ যেন একই মন্ত্রের সূত্র ও ভাষ্য। শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানদৃষ্টিতে বিবেকানন্দের স্বরূপ ধরা পড়ে। ধ্যাননেত্রে তিনি নিরীক্ষক্ষণ করিলেন, অনুভূতির চরমতম শিখরে এক জ্যোতির্ময়রাজ্য-যেখানে দেবদেবীদের মূর্তি পর্যন্ত নাই। সেই জ্যোতির্ধনমণ্ডলে পুঞ্জীভূত জ্যোতির আকারে সাতজন ঋষি সমাধিমগ্ন।
হঠাৎ সেই জ্যোতিরই এক অংশ ঘনীভূত হইয়া একটি শিশুর মূর্তি পরিগ্রহ করে। সেই দিব্যশিশু পরম প্রেমভরে সমাধিস্থ এক ঋষির কণ্ঠ বেষ্টনপূর্বক তাঁহাকে সপ্রেম আহবান জানায়, "আমি যাইতেছি, তোমাকেও আমার সহিত যাইতে হইবে।” যোগীবরের ধ্যানভঙ্গ হয়। সস্মিত দৃষ্টিতে তিনি দেবশিশুর আমন্ত্রণ অনুমোদন করিলেন। সেই যোগীর শরীর হইতে এক দিব্যজ্যোতির রশ্মি ধরণীতে নামিয়া আসে। নরেন্দ্রনাথকে দেখিবামাত্রই শ্রীরামকৃষ্ণদেব সেই ধ্যানদৃষ্ট ঋষিমূর্তি বলিয়া স্মরণ করিলেন।
১৮৬৩ খৃষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি, (১২৬৯ বঙ্গাব্দের ২৯শে পৌষ) কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী তিথি, পৌষ সংক্রান্তির দিন সিমুলিয়ার ধনী এটর্নি শ্রীবিশ্বনাথ দত্ত মহাশয়ের বাড়িতে আনন্দের হাট বসিয়া যায়। বীরেশ্বর শিবের প্রসাদে আজ তাঁহারা একটি পুত্র সন্তান লাভ করিয়াছেন। সন্তানের নামকরণ হয় নরেন্দ্রনাথ, ডাক নাম হয় বীরেশ্বর বা 'বিলে'।
সুদর্শন শিশু নরেন্দ্রনাথ মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীকে অস্থির করিয়া তোলে নানাপ্রকার চঞ্চলতায়। কিন্তু তাহার সব চপলতা শান্ত হয় শিবনাম শ্রবণে। পাড়ার বালকদের সর্বপ্রকার খেলাধূলার নেতা বিলে। গান-বাজনা, লেখাপড়া, সর্ব বিষয়েই সকলের পুরোভাগে থাকে। সকলেই যেখানে ভয় পাইয়া পিছাইয়া যায় নরেন্দ্রনাথ সেখানে আগাইয়া আসেন। মেট্রোপলিটন্ বিদ্যালয় হইতে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করিয়া প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন, পরে জেনারেল এসেমব্রিজ কলেজ হইতে বি. এ. পাশ করিলেন কৃতিত্বের সহিত। এইকালে পাশ্চাত্ত্য দর্শন ও সাহিত্যের সহিত পরিচিত হওয়ায় হিন্দুধর্মের সংস্কারগুলি তাঁহার নিকট বড়ই পীড়াদায়ক বলিয়া মনে হয় এবং তিনি ব্রাহ্মহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু তাঁহার জিজ্ঞাসু মন সেখানেও সমাধান খুঁজিয়া পায় নাই। ঠিক এই সময় ১৮৮১ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে প্রতিবেশী সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ীতে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য আহৃত হইয়া দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে প্রথম দর্শন করিলেন। সেই প্রথম দর্শনের দিনেই শ্রীরামকৃষ্ণদেব দক্ষিণেশ্বরে যাইবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথকে।
দ্বিতীয় দর্শন, ১৮৮১ খৃষ্টাব্দের পৌষ মাসে দক্ষিণেশ্বরে। পরমপ্রেমে শ্রীরামকৃষ্ণদেব এইদিন নরেন্দ্রনাথকে আপনার চিহ্নিত সন্তান বলিয়া স্মরণ করাইয়া দেন। যুগপ্রয়োজন সাধনের নিমিত্তই তাঁহার আবির্ভাব-এই বার্তা তিনি করজোড়ে নরেন্দ্রনাথকে নিবেদন করিলেন। বিস্মিত নরেন্দ্রনাথ কৌতুক বোধ করিলেন, কিন্তু কী এক অনাস্বাদিতপূর্ব আকর্ষণ বোধ করিলেন তিনি সেই কালী মন্দিরের দিকে; স্থির থাকিতে পারিলেন না গৃহে, বার বার ছুটিয়া আসেন দক্ষিণেশ্বরে। আত্মসমর্পণ করিলেন সেই ভাববিমোহিত সাধকের চরণতলে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার আপনভাবে নরেন্দ্রনাথকে গড়িয়া তুলিতে থাকেন-ধ্যানে, জ্ঞানে ও তপস্যায়।
রোগে শয্যাশায়ী শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুর উদ্যানবাটীতে; নরেন্দ্রাদি বালকভক্তগণ সেবায় তৎপর। নরেন্দ্রনাথকে কাছে ডাকিয়া পরম স্নেহভরে তাঁহারই হস্তে বালকভক্তদের সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হন। তাঁহারই নিকট প্রকট করিলেন নিজের রামকৃষ্ণ স্বরূপ। নরেন্দ্র যে পদ্মমধ্যে সহস্রদল। তাঁহার মধ্যে যে জ্ঞানসূর্য দেদীপ্যমান! নরেন্দ্র কি যে-সে! তাই তো তাঁহারই মধ্যে আপন শক্তি সঞ্চারিত করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ পরম তৃপ্তির সহিত মহাসমাধির শান্তিতে নিমগ্ন হইলেন।
সাংসারিক অভাব অনটনের জন্য গৃহের ব্যবস্থাদি করিয়া, নরেন্দ্রনাথ আসিয়া মিলিত হইলেন তাঁহার ত্যাগী গুরুভ্রাতৃবৃন্দের সহিত বরাহনগর মঠে। এখন হইতে শুরু হইল কঠিন তপস্যার জীবন-লক্ষ্য হইল আত্ম-সাক্ষাৎকার বা ভগবদ্দর্শন। আঁটপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগের আদর্শে সন্ন্যাসের সংকল্প গ্রহণ করিয়া, ১৮৮৭খৃষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বরাহনগর মঠে সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেন, নাম হইল স্বামী বিবিদিষানন্দ। পরে প্রব্রজ্যাকালে নাম লইলেন-স্বামী বিবেকানন্দ।
১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে পরিব্রাজকরূপে বহির্গত হইয়া কাশী, অযোধ্যাদি দর্শন করিয়া, ক্রমে সমগ্র উত্তরাখণ্ড
পরিভ্রমণান্তে মঠে ফিরিয়া আসিলেন। ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে শেষবারের মতো প্রব্রজ্যায় বাহির হইলেন। সমগ্র উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করিয়া স্বামীজী পশ্চিম ভারত হইয়া দাক্ষিণাত্যে নামিয়া আসিলেন। এই প্রব্রজ্যাকালে সম্পূর্ণ নিঃসম্বল অবস্থায় তিনি পরিপূর্ণ ঈশ্বরে নির্ভর করিয়া কখনও ধনীর প্রাসাদে, কোথাও বা ধর্মশালায়, বেদান্তবার্তা প্রচার করিতে করিতে বেড়াইতে থাকিলেন। গুরুভ্রাতাদের পরিত্যাগ করিয়া একাকী তিনি সমগ্র ভারত-তীর্থ পর্যটন শেষ করিয়া ভারতের দক্ষিণপ্রান্তে কন্যাকুমারিকার শেষ প্রস্তরখণ্ডের উপর বসিয়া ধ্যাননেত্রে নিরীক্ষণ করিলেন, তাঁহার মাতৃভূমির করুণ মূর্তি। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অজ্ঞতা সমগ্র দেশের স্তরে স্তরে দেশকে জর্জরিত করিয়া তুলিয়াছে। এমন সময় শ্রীগুরুর নির্দেশ লাভ করিলেন, সমুদ্র পার হইয়া বিদেশ হইতে এই গ্লানি দূর করিবার উপায় নির্ধারণ করিতে হইবে। আমেরিকার চিকাগো
শহরে তখন বিশ্বধর্ম মহাসভার আয়োজন চলিতেছিল। জননী সারদামণি দেবীর আশীষ বানি লাভ করিয়া স্বামীজী ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দের মে মাসে বোম্বাই হইতে জাহাজে রওনা হইলেন সেই ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিবার জন্য।
আমেরিকায় পৌঁছাইয়া নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও স্বামীজী ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর চিকাগো ধর্ম মহাসভায় বক্তৃতা করিবার সুযোেগ পাইলেন। প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি সমগ্র আমেরিকাবাসীর আপনার জন হইয়া গিয়াছিলেন। ফলে সেই 'Cyclonic Hindoo monk'-কে ঝড়ের বেগেই আমেরিকার একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে বক্তৃতা-আলোচনা করিয়া ঘুরিতে হইত। পাশ্চাত্যের জনগণ মুগ্ধবিস্ময়ে শুনিত ভারতীয় বেদান্তদর্শনের অপূর্ব সাম্যের বার্তা, অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী ধর্ম বিষয়ের। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতমণ্ডলী শ্রদ্ধাভরে সেই তরুণ সন্ন্যাসীর পদপ্রান্তে মস্তক অবনত করিল। ১৮৯৫ খৃষ্টাব্দে লণ্ডনে আসিলেন স্বামীজী, মাস-তিনেক পরে আবার আমেরিকায় ফিরিয়া আসিলেন। ইতিমধ্যে তাঁহার বিখ্যাত রাজযোগ, জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ ও ভক্তিযোগের বক্তৃতামালা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়া গিয়াছে। ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে নিউইয়র্কে একটি স্থায়ী বেদান্ত কেন্দ্র স্থাপন করিয়া পুনরায় লণ্ডনে ফিরিয়া আসিলেন। সেখানে পণ্ডিতপ্রবর ম্যাক্সমূলার ও মিস্ মার্গারেট নোক্সের (ভগিনী নিবেদিতা) সহিত তাঁহার আলাপ হয়। এবারে তিনি ভারতের অভিমুখে যাত্রা করিলেন ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বরে। পাশ্চাত্ত্য হইতে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে সিংহলে তাঁহকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা করা হয়। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসে মাদ্রাজে তাঁহাকে রাজোচিত সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। মাদ্রাজবাসীদের উৎসাহেই তাঁহার বিদেশ যাত্রা সম্ভব হইয়াছিল, তাই তাহাদের উৎসাহের অন্ত ছিল না।
১৮৯৭ এর ২৫শে ফেব্রুয়ারি কলিকাতায় আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তথাকার জনগণ বিরাট অভিনন্দন জানায়।
দেশে ফিরিয়া আসিয়া স্বামীজী শ্রীগুরুর ত্যাগ ও সেবার অত্যুজ্জ্বল জীবনাদর্শ সর্বসাধারণে প্রচারের নিমিত্ত 'রামকৃষ্ণ মিশন' প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দের ১লা মে। দীর্ঘ পরিশ্রমে ক্লান্ত সন্ন্যাসী চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে শীতপ্রধান অঞ্চল আলমোড়া যাত্রা করিলেন। পাঞ্জাব, কাশ্মীর হইয়া কলিকাতায় ফিরিয়া বেলুড় মঠের জমি ক্রয় করিলেন ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে। দ্বিতীয় বার উত্তরাখণ্ডের কাশ্মীর, অমরনাথ, ক্ষীরভবানী দর্শন করিয়া আসিয়া স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে নিবেদিতার স্থাপিত বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিলেন ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দের কালীপূজার দিন। উহার পূর্বদিন বেলুড়ের নূতন জমিতে পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণী প্রথম পদার্পণ করিলেন। ১৮৯৯
খৃষ্টাব্দের ২রা জানুয়ারি বেলুড়ে নূতন বাড়ীতে মঠ স্থানান্তরিত হয়। এইভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ-সংঘকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া চিকিৎসকদের নির্দেশে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য স্বামীজী দ্বিতীয়বার বিদেশ যাত্রা করিলেন ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দের ২০শে জুন। শারীরিক দৌর্বল্যনিবন্ধন এ-যাত্রায় প্রায় এক বৎসরের মতো লণ্ডন ও আমেরিকায় কাটাইয়া প্যারিসের ধর্মেতিহাস সম্মেলনে যোগ দিবার জন্য শেষবারের মতো আমেরিকা পরিত্যাগ করিলেন। প্যারিসের সম্মেলনে যোগদানান্তর ইউরোপের বহু স্থান দর্শন করিয়া ১৯০০ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি বেলুড় মঠে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার প্রিয় পাশ্চাত্যদেশীয় শিষ্য সেভিয়ার সাহেবের দেহত্যাগের সংবাদে ব্যাকুল হইয়া কয়েকদিন পরেই স্বামীজী মায়াবতী যাত্রা করিলেন। কিছুদিন পর সেস্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া পূর্ববঙ্গাভিমুখে যাত্রা করিলেন। পূর্ববঙ্গ ও আসামের তীর্থাদি দর্শন করিয়া ১৯০০ খৃষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় মঠে ফিরিয়া আসিলেন। শরীর তাঁহার রোগে জীর্ণ, মনও ঊর্ধ্বমুখী। জনৈক সেবককে একদিন বলিলেন, "বাবা অমরনাথ আমায় ইচ্ছামৃত্যু বর দিয়েছেন।" ১৯০১ খৃষ্টাব্দে মঠে প্রতিমায় দুর্গাপূজা করান হইল।
১৯০২ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে প্রসিদ্ধ জাপানী শিল্পী ওকাকুরার সহিত বোধগয়া দর্শন করিয়া আসিলেন। শরীর তাঁহার ক্রমশঃই ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। জুলাই মাসের প্রথম দিকে একদিন মঠের জমিতে পাদচারণ করিতে করিতে বিল্বমূলের নিকটে একটি স্থান নির্দেশ করিয়া বলিলেন, "আমার শরীর ত্যাগ হলে এই স্থানে সৎকার করবি।” ৪ঠা জুলাই সারাদিন দিব্যভাবে বিভোর স্বামীজী ধ্যানান্তে মন্দির হইতে নামিবার সময় অস্ফুটস্বরে বলিতে লাগিলেন, "যদি আর একটি বিবেকানন্দ থাকত, তবে বুঝতে পারত বিবেকানন্দ কি করে গেল!"
সন্ধ্যায় সন্ধ্যাবন্দনাদি সাঙ্গ করিয়া শয্যায় শয়ন করিলেন, আর সেই অবস্থাতেই শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠতম সন্তান, যোগিশ্রেষ্ঠ বিবেকানন্দ মর্ত্যলীলার অবসান ঘটাইয়া মহাসমাধিমগ্ন হইলেন।
যুগযুগ ধরিয়া ভারতের তত্ত্বদর্শী ঋষিকুল ধ্যানের গভীরে যে সত্যের আস্বাদন করিয়াছেন তাহারই বাত্ময় মূর্তি বিকীর্ণ হইয়া আছে উপনিষদের প্রতিটি মন্ত্রে। তাঁহারা অনুভব করিয়াছিলেন বিশ্বচরাচর ব্রহ্মেরই সৃষ্টি, ব্রহ্মেই বিধৃত হইয়া আছে, আবার ব্রহ্মেতেই লীন হইবে। অর্থাৎ ব্রহ্মময় এই জগৎ। দ্বেষ-হিংসা কাহাকে করিবে, আর কে-ই বা করিবে? 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম'-ভারতাত্মার এই শাশ্বত বাণীই ভারত-ইতিহাসের পুনরাবর্তনের সাথে সাথে নব নব সুরে নানা কণ্ঠে বারে বারে উচ্চারিত হইয়াছে।
ভারতের বিস্মৃতপ্রায় চিরন্তন এই সত্যানুভূতিই বর্তমান যুগে আরও উজ্জ্বল এবং সুস্পষ্টভাবে রূপায়িত হয় ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনায়। সব সাধনার অন্তে পৌঁছাইয়া তিনি আশ্চর্য সহজ সরল ভাষায় ঘোষণা করিলেন, 'যত্র জীব তত্র শিব', 'যত মত তত পথ'। শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাবধারার শ্রেষ্ঠতম বাহক ও ধারক স্বামী বিবেকানন্দ সেই পুণ্য সুরধুনিকে-ভারতের চিরপুরাতন সত্যকে, ছড়াইয়া দিলেন বিশ্বের সর্বত্র। দিক্ হইতে দিগন্তরে ছড়াইয়া পড়িল বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের কম্বুকণ্ঠের উচ্চ নিনাদ :
"ব্রহ্ম হ'তে কীট পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়, মন প্রাণ শরীর অর্পণ, কর সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার,
ছাড়ি' কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।"
ভারতীয় সাধনার চরমতম কাম্য হইতেছে ঐ স্বরূপ উপলব্ধি-সর্বত্র ব্রহ্ম দর্শন। আর এই অবস্থা লাভের জন্য সনাতন বৈদিক ধর্মে প্রধানতঃ চারটি পথের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। শাস্ত্রে সেই এক-একটি পথের নাম যোগ বা উপায়। একমাত্র ঈশ্বরই সত্য, আর সব অনিত্য-বিচারের দ্বারা এই জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হইয়া যিনি সর্বভূতে সেই আত্মাকেই অনুভব করিয়া থাকেন তিনি জ্ঞানযোগী। যিনি ইষ্টকেই আপনার সর্বস্ব জ্ঞান করিয়া প্রেমে তাঁহাতেই তন্ময় হইয়া আত্মনিবেদন করেন তিনি ভক্তিযোগের উপাসক। যিনি সর্বকর্ম-ফলাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করিয়া সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাম হইয়া, ঈশ্বরের প্রীতির জন্য কর্ম করিয়া থাকেন তিনি কর্মযোগের সাধক। আর বিশ্বচরাচরের আকর্ষণী মায়ার রাজ্য হইতে বিক্ষিপ্ত চিত্তকে গুটাইয়া আনিয়া, উহার সমস্ত বৃত্তিকে নিরুদ্ধ করিয়া, যিনি স্ব-স্বরূপে অবস্থান করিতে যত্নপর তিনি রাজযোগ বা ধ্যানযোগের সাধন করিতেছেন।
বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন অবতারে পূর্বোক্ত ভাবের কোন কোনটির বিশেষ প্রকাশ দেখা গিয়াছে। কিন্তু বর্তমান যুগে ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণের যুগ-প্রয়োজনানুযায়ী জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ও ধ্যান, এই যোগচতুষ্টয়ের সমন্বয় অপূর্বভাবে দেখা গিয়াছিল।
সমন্বিত যোগের ঘনীভূতমূর্তি শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠতম সন্তান, যুগাচার্য বিবেকানন্দেও এই সমন্বয়ের ভাব পূর্ণরূপে বিকশিত।
শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের ভাষ্য-স্বামী বিবেকানন্দেও
আমরা দেখি-কখনও শ্রীগুরুর অমৃতময়ী 'যত্র জীব তত্র শিব', বাণীর ব্যাখ্যা শ্রবণে উদ্গ্রীব, কখনও 'শিবজ্ঞানে জীবসেবা' এই মহাবাক্য শ্রবণে রোমাঞ্চিত, আর সেই সুরেই তাঁহার কণ্ঠে শুনি-'Each soul is potentially divine'। জ্ঞানবিচারের সুরে বাঁধা নরেন্দ্রনাথের জীবনতন্ত্রীতে তাই অহর্নিশ 'এক' ব্রহ্মানুভূতিরই অনুরণন প্রতিধ্বনিত।
আবার মহাজ্ঞানী বিবেকানন্দ ঠাকুরের চরণে আত্মসমর্পণ করিয়া বলেন-'তুমিই আমার সব-আমি অন্যকিছু জানি না।' 'দাস তব জনমে জনমে দয়ানিধে... সশক্তিক নমি তব পদে।' ভক্তির মূর্তবিগ্রহ--আত্মনিবেদনের মূর্তপ্রতীক!
শ্রীরামকৃষ্ণসমীপে লব্ধজ্ঞান দেশদেশান্তরে ছড়াইয়া দিবার জন্যে, অন্ধমোহাচ্ছন্ন জাতিকে স্ব-ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য এই প্রেমিক সন্ন্যাসী তিলে তিলে বুকের
রক্তমোক্ষণ করিয়া দেন। কর্মযোগের, নিষ্কাম কর্মের এতবড় দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।
তিনিই আবার যোগের উপদেশ করিতে বসিয়া মুহূর্তমধ্যে সমগ্র চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করিয়া গভীর সমাধিতে ডুবিয়া যাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ-গতপ্রাণ বিবেকানন্দেও তাই আমরা চারিটি যোগেরই সমভাবে বিকাশ দেখিতে পাই। ভারতীয় অধ্যাত্মচিন্তার মূল সুর-'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' ইহার ব্যাখ্যাই দেখিতে পাই শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের জীবনাদর্শে। স্বামীজী বলিয়াছিলেন-জীব স্বরূপতঃ ব্রহ্মাই। জ্ঞান-কর্ম-ভক্তি অথবা যোগ যে-কোন উপায়েই হউক না কেন, ঐ স্বরূপ উপলব্ধিই মনুষ্যজীবনের লক্ষ্য। ঘটে ঘটে সেই এক ব্রহ্মকে-জীবের মাঝেতে শিবকে খুঁজিয়া পাওয়াই আমাদের সাধনা। আমার মধ্যে যিনি রহিয়াছেন, বিশ্বচরাচরে সর্বত্র তিনিই বিরাজিত। আর্ত, পতিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র-রুগ্ন-মূর্খ-পণ্ডিত, জীবজন্ত-পশু-পক্ষী সকলের মধ্যে তিনিই রহিয়াছেন, যিনি আমার মধ্যে রহিয়াছেন। এই বোধ হইলে আর ভেদ কোথায়-পর কে, আলাদা কিসের? সবই তো এক। এই একত্বে প্রতিষ্ঠিত হইয়া আত্মবুদ্ধিতে যখন কোন কাজ করা যায় তখন তাহাই হইবে সেবা-- 'শিবজ্ঞানে সেবা'। তখন জীব বলিয়া কিছু নাই। এক ব্রহ্মেরই অর্চনা হইতেছে তখন ব্রহ্মের দ্বারাই। ইহাই হইতেছে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রদর্শিত সেবার মূলকথা।
বেদান্তের এই চরমতম লক্ষ্যে পৌঁছাইবার সাধনরূপে স্বামীজী জ্ঞান-কর্ম-যোগ-ভক্তির সমন্বিত পথে বর্তমান যুগ-মানসকে উদ্বোধিত করিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অভিন্ন-বিগ্রহ স্বামীজীর মনন ও ধ্যান ঐ সমন্বয়ের পথ ধরিয়া আমাদের জীবনকে মহীয়ান্ করিবে।
জয় জয় স্বামীজী মহারাজের জয় ♥️♥️🙏🙏🌹🌹
()
#মা #সারদা #রামকৃষ্ণ