
01/07/2025
সকালবেলার সেই দিনগুলো
সকালটা তখন এমন ছিল না যেমনটা এখন। এখনকার মতো ব্যস্ততা, মোবাইল, স্কুলের হোমওয়ার্ক, কিংবা ঘুমিয়ে থাকা শহর তখন ছিল না। ছিল না গ্যাজেটের ঘোর, কিংবা চোখে ক্লান্তি। বরং তখন সকাল মানেই ছিল — পবিত্রতা, সাদাসিধে জীবন আর তাজা বাতাসে ভরে থাকা একটা গ্রামীণ সুন্দর সময়।
সেই সময়ে, ভোরের আজান যখন শোনা যেত, তখন গ্রামের প্রতিটা ঘরে একটু একটু আলো জ্বলত। শীতের সকালে কুয়াশায় ঢাকা উঠানে দাঁড়িয়ে মা হাঁক দিত,
— "ও খোকা, ওঠ! আজান হইছে। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হ।"
খোকা তখন চোখ কচলাতে কচলাতে উঠত। পাশের ঘরে চাচীও তার ছেলেকে জাগাচ্ছেন। কারও হাতে কাঁথা মোড়ানো কোরআন শরীফ, কেউ আবার পিড়িতে বসে নরম স্বরে কোরআন পড়ছেন। একটা ঘর থেকে ভেসে আসত,
"আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম… বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম…"
চারপাশে পবিত্র এক ধ্বনি ছড়িয়ে যেত। মনে হতো, পুরো গ্রামটাই যেন এখন জান্নাতের মতো পবিত্র।
এরপর শুরু হতো আমাদের মক্তব যাত্রা। সাদা টুপি পরে, মেয়েরা মাথায় ওড়না দিয়ে, আমরা সবাই দল বেঁধে হাঁটতাম গ্রামের মসজিদের দিকে। কারো হাতে খাতা, কারো হাতে বোর্ড, কেউ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিচ্ছে, কারো পকেটে কিছু বাদাম। যেন এক আনন্দমিছিল।
মক্তবের উস্তাদ ছিলেন আবু বকর সাহেব। তিনি খুব রাগী ছিলেন, কিন্তু তাঁর মুখে যখন কোরআনের আয়াত শুনাতেন, তখন মনে হতো যেন একজন ফেরেশতা কোরআন পড়ছেন। তিনি সবার নাম জানতেন, কার মুখস্থ কতটুকু, কে খেলাধুলা করে বেশি — সব জানতেন।
মক্তব শুরু হতো কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে। তারপর আমরা পড়তাম আমপারা, দোয়া, নামাজের নিয়ম, আর কেউ কেউ ক্বারী হতো, সবার সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে সুর করে পড়ত:
"ওয়াদ্দুহা — ওয়াল লায়লি ইজা সাজা..."
আমরা হিমেল হাওয়ার মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে কোরআন পড়তাম, আর মাঝে মাঝে পেছনে তাকিয়ে দেখতাম— গ্রামের গরুগুলো মাঠে যাচ্ছে, হালচাষ শুরু হয়েছে, মায়েরা উঠানে চাল ছেঁটে নিচ্ছেন।
মক্তব শেষ হলে উস্তাদ জিজ্ঞেস করতেন—
— “কে কে আজকে পুরো ক্বারআন মুখস্থ করসে?”
আর আমরা হাসতাম, কারো মুখে পাকা দুষ্টুমি, কারো চোখে ভয়— কিন্তু একসাথে ছিলাম, শেখার আনন্দে ছিলাম।
বাড়ি ফিরে গেলে দেখা যেত মা এখনও পিড়িতে বসে কোরআন পড়ছেন। বাবাও কাজে বের হননি, যেন মায়ের কণ্ঠের সুর শুনেই ঘরের আশীর্বাদ শুরু হয়।
আজ সব কিছু বদলে গেছে।
আজ মক্তবের সেই সকাল নেই, মা-চাচীদের পবিত্র পড়ার আওয়াজ নেই। বাচ্চারা এখন ঘুমিয়ে থাকে মোবাইলের পাশে। কারও হাতে আর বোর্ড নেই, নেই সেই "ওয়াদ্দুহা" তেলাওয়াতের প্রতিযোগিতা।
কিন্তু মন মাঝে মাঝে কাঁদে… যদি আবার ফিরে যেতে পারতাম সেই দিনে—সেই কুয়াশামাখা ভোরে, যেখানে পবিত্রতা, শিক্ষা আর ভালোবাসা ছিল একসাথে।