15/04/2024
হাজারো "এয়ারফল্গসফ্যানদের" ভীড়ে একজন সত্যিকারের লেভারকুসেন ফ্যান
টবিয়াসের সাথে আমার পরিচয় বছর পাঁচেক আগে। শুরুতে কাজের সূত্রে কলিগ, তারপর সময়ের সাথে সাথে বন্ধুত্ব। জার্মানিতে আমার অন্যদেশের বন্ধুদের কাছে আমার আরেক নাম 'পডকাস্ট'। কারণটা কি জিজ্ঞেস করলে আমার বুলগেরিয়ান বন্ধু রাডো এক গাল হেসে আমাকে দেখিয়ে অন্যদের বলবে- এ জগতের এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে আশিস ঘন্টার পর ঘন্টা অনবরত গল্প করতে পারবো না। আমার নাকি একজন কথা বলার সঙ্গি হলেই হয়। হোক সেটা ছেলে বা মেয়ে, হোক সে যে কোনো দেশের, যে কোনো জাতি বা বর্ণের। এ জন্যই আমি এক রানিং পডকাস্ট। দেশে গেলে প্রতি সপ্তাহেই হোয়াটসঅ্যাপে রাডোর ম্যাসেজ- "জার্মানি কবে ফিরছো? কতোদিন তোমার পডকাস্ট শুনি না। "
কাজের সূত্রে সপ্তাহের অনেকটা সময়ই আমাকে কাটাতে হয় গাড়িতে ভ্রমণ করে। পৃথিবীর একমাত্র স্পিডলিমিটহীন হাইওয়েত জার্মান আওটোবানে বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলা গাড়িদের পাশ কাটিয়ে আরো তীব্র গতিতে ছুটে চলা গাড়ির স্টিয়ারিংএ টবিয়াস আর তার পাশের সিটে বসে চলে আমাদের পডকাস্ট। কোলনের পাশে ছোট এক শহরে জন্ম নেয়া টবিয়াসের সাথে ডুসেলডর্ফ-কোলন গামি রোডে প্রতি সপ্তাহে অন্তত কয়েকবার যাওয়া আসা হয় আমাদের। এ পথে গাড়ি নিয়ে গেলে প্রতিবারেরই যখন 'বায়ারিনা' স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে আমরা যাই তখনই যেন চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে টবিয়াসের। অথচ এর কিছুক্ষণ আগেই হাইওয়ের পাশে টবিয়াসের নিজের হোমটাউন যখন ক্রস করেছি তখন তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র ভ্রু-আক্ষেপ নেই।
জার্মানদের আবেগ এমনিতেই নাকি একটু কম। এজন্যই টবিয়াসকে যখন জিজ্ঞেস করি ছোটবেলা থেকে যে টাউনে বেড়ে উঠেছো সেখান দিয়ে গেলে কোনো রকম অনুভূতি কাজ করে না?
-"না। একদমই না।" আমাকে অবাক করে দিয়ে টবিয়াসের সোজাসাপ্টা উত্তর। এটাই হলো অনেকটা স্টিরিওটিপিক্যাল জার্মান এটিচিউড। মনে যা, মুখেও তা। মিথ্যা সুগারকোটিং আর ভনিতার কোনো জায়গা নেই এখানে। আমি আমার বাড়ি ছেড়েছি পাঁচ/ছ বছর আগে। আর এ পথে প্রায় প্রতিদিন কয়েকবার ড্রাইভ করি আমি। আমার শহরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় এখন কিছুই মনে হয় না আর। টবিয়াসের সরল ব্যাখ্যা।
তবে জীবনের একটা বড় অংশ এই বায়ারিনাতে কাটিয়েও, প্রায় প্রতি সপ্তাহে একবার করে এসেও যখন টবিয়াসের বারবার বিশেষ কিছু ফিল হয় তখন আমার কোনো এক ফুটবল ভক্তের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা মনে হয়- " ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি আমার ফুটবল ক্লাবের অপর নাম নাকি জীবন। বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি একথা সম্পূর্ণ ভুল। আমার ফুটবল ক্লাব আমার জীবনের চেয়েও অনেক বেশি কিছু।"
তাই বলে সব জার্মানদের জীবন মানেই কিন্তু ফুটবল না। আমার বেশ কিছু জার্মান বন্ধুদের কাছে এ জগতের সবচেয়ে অর্থহীন ব্যপার হলো এই ফুটবল ফ্যানদের উন্মাদনা। একবার এক জার্মান বন্ধুর সাথে সারা রাত একটানা বারো ঘন্টার বেশি জব করে আমি যখন বিছানায় এসে শুয়েছি, সেই বন্ধুকে সরাসরি সেখান থেকে শালকের ম্যাচ দেখতে স্টেডিয়ামে চলে যেতে দেখেছি। টবিয়াস ঠিক এরকমই একজন লেভারকুসেন ফ্যান।
গত পাঁচ বছরে নানা বিষয় নিয়ে কথা হলেও টবিয়াসের সাথে আমার বেশিরভাগই ফুটবল নিয়েই কথা হয়। টবিয়াসের ফুটবল জ্ঞান অবিশ্বাস্য রকম গভীর। জার্মান ফুটবলের যতো খুটিনাটি আর নারি-নক্ষত্র সব তার জানা। চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরোপা লিগ, বুন্দেস লিগা আর জার্মান কাপ ডিএফবি পোকাল থেকে শুরু করে জার্মান ফোর্থ ডিভিশন পর্যন্ত কোন ক্লাবের কি অবস্থা বা কোন প্লেয়ার কি করছে সবই যেন টবিয়াসের নখদর্পনে। সেই সাথে জার্মান আর ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের ইতিহাস তো আছেই। কোন ক্লাব কবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো, কবে রেলিগেটেড হয়েছিলো, ম্যারাডোনা কবে জার্মানিতে খেলতে এসেছিলো কোন কিছুই অজানা নেই তার।
জার্মানিতে তো সবাই হয় বায়ার্ন মিউনিখ, নয়তো বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের ফ্যান। এই রুহর রিজিউনে আর পুরো জার্মানিতে শালকের ফ্যানও তো কম না। যেখানে এফসি কোলোনের মতো ক্লাবও দুবার বুন্দেসলিগা জিতেছে সেখানে ইতিহাসে কখনোই বড় কিছু না জেতা লেভারকুসেনের তুমি এতো বড় ফ্যান কিভাবে? পাঁচ বছর আগে যখন এ প্রশ্ন করেছিলাম জবাবে টবিয়াস আমাকে বলেছিলো " আমি তো কোনো এয়ারফলগস ফ্যান না। আমি ট্রু ফ্যান।"
'এয়ারফল্গসফ্যান' এই কথাটা জার্মান ফুটবলে অনেক বেশি প্রচলিত। যার ইংরেজি অনুবাদ হয় সাকসেস ফ্যান। বড় বড় ক্লাবের বেশিরভাগ ফ্যানরাই আসলেই এয়ারফল্গসফ্যান। যে ক্লাব যতো বেশি সফল তাদের সুখের সময়ের ততো বেশি ফ্যান। সত্যিকারের ফুটবল ফ্যান হলো টবিয়াসের মতো ফ্যানরা। ক্লাবের জন্য ফ্যানদের ডেডিকেশন কেমন হয় তা এই ছেলেকে দেখে আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছি৷ সারা বছর স্টেডিয়ামে বসে নিজের ক্লাবের ম্যাচ দেখতে এ ছেলে জার্মানির এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়ায়। এ সিজনের ইউরোপা লিগে লেভারকুসেনের এওয়ে ম্যাচ দেখে সারারাত গাড়ি চালিয়ে বেলজিয়াম থেকে জার্মানি এসে আবার দুপুরে কাজে যোগ দিয়েছে। এরকম ফুটবল ফ্যানরা আছে বলেই এখনো সব ফুটবল ক্লাবের ফিফটি পার্সেন্ট মালিকানা আর কর্তৃত্ব সাংগঠনিকভাবে ফ্যানদের হাতে রাখতে জার্মান ফুটবলে বলবত আছে এখনো ফিফটি প্লাস ওয়ান রুল।
একশো কুড়ি বছরের ক্লাবের ইতিহাসে কখনো সেরকম কিছু না জিতেও লেভারকুসেনের প্রতি টবিয়াসের এরকম সমর্থন। সিজনটা কেমন যাচ্ছে এ প্রশ্নের জবাবে টবিয়াসের উত্তর প্রতিটা ম্যাচই যেন স্বপ্নের মতো। এইতো কিছুদিন আগে বুন্দেসলিগায় বায়ার্নের সাথে লেভারকুসেনের পয়েন্টের ব্যবধান যখন দশ তখন টবিয়াসকে বলেছিলাম বুন্দেসলিগা জয়ে অগ্রিম অভিনন্দন। জবাবে টবিয়াস বলেছিলো - "না। এখনো বলা যাচ্ছে না। অনেক কিছুই হতে পারে। আমি কোনো কিছু জিংক্স করতে চাই না।"
টবিয়াসদের একশো বিশ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে বায়ার্ন মিউনিখের বারো বছর পর রাজত্ব শেষ করে বায়ার লেভারকুসেন আজ পাঁচ ম্যাচ হাতে রেখেই বুন্দেসলিগার শিরোপা জিতেছে। জাবি আলোনসোর হাত ধরে এখনো পর্যন্ত ইউরোপের টপ ফাইভ লিগের একমাত্র অপরাজিত দল লেভারকুসেনের জার্মান কাপ জেতাও অনেকটা সময়ের ব্যপার এখন। আছে ইউরোপা লিগ জিতে ট্রেবল জয়ের সমূহ সম্ভাবনাও।
এরকম ট্রেবল জয়ের সম্ভাবনা লেভারকুসেন অবশ্য আরো একবার জাগিয়েছিলো ২০০১/০২ সিজনে। টবিয়াসের মুখে অসংখ্যবার শুনেছি বাইশ বছর আগের সেই লেভারকুসেন ট্র্যাজেডির কথা। মাইকেল বালাকের অপ্রতিরোধ্য লেভারকুসেন সেবার এপ্রিল মাসের শেষে বুন্দেস লিগা, জার্মান কাপ আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার নিশ্বাস ছোঁয়া দূরত্বে ছিলো। বুন্দেসলিগায় তিন ম্যাচ বাকি থাকতে সেবার দ্বিতীয় স্থানে থাকা ডর্টমুন্ডের থেকে পাঁচ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলো লেভারকুসেন। জার্মান কাপের ফাইনালে প্রতিপক্ষ অফ ফর্মে থাকা শালকে। ইতিহাস গড়ার অপেক্ষায় থাকা লেভারকুসেন ফ্যানদের হতাশ করে বুন্দেসলিগায় নিজেদের পরের দুই ম্যাচে টেবিলের নিচের সারির দল ব্রেমেন আর রেলিগেশন জোনে থাকা নুরেনবার্গের সাথে হেরে ডর্টমুন্ডের কাছে খোয়া গেলো প্রথমবার বুন্দেসলিগা জয়ের সুযোগ। পরের সপ্তায় প্রথন হাফে ১-০ গোলে এগিয়ে থেকেও শালকের কাছে জার্মান কাপের ফাইনালে ৪-২ গোলে পরাজয়।
তবে লেভারকুসেন ফ্যানদের জন্য সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি তখন বাকি। গ্লাসগোতে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে কোনঠাসা বানিয়ে যখন সমানতালে লড়ে যাচ্ছিলো লেভারকুসেন তখনই জিনেদিন জিদানের অবিশ্বাস্য ভলিতে করা সেই গোলে আবারো স্বপ্নভঙ্গ।
সে বছর কোরিয়া-জাপানে অনুষ্ঠিত ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে মাইকেল বালাকসহ দুর্দান্ত এই লেভারকুসেন টিমের পাঁচ জন প্লেয়ার জার্মান ন্যাশনাল টিমের হয়ে খেলেছিলো। ফলাফল ব্রাজিলের কাছে ফাইনালে হেরে রানারআপ।
ইতিহাস শুধু প্রথমদেরই মনে রাখে, দ্বিতীয়দের না। এ কথা লেভারকুসেন ফ্যানদের চেয়ে ভালো বোধহয় আর কেউ বেশি জানে না। 'এতো কাছে অথচ কতো দূরে' অনূভুতি হওয়া হৃদয়ভাঙ্গা সে সিজন শেষে লেভারকুসেন ফ্যানদের কাটা গায়ে নুনের ছিটা হয়ে ক্লাবের সেরা প্লেয়ার আর কিংবদন্তি বালাক লেভারকুসেন ছেড়ে নাম লেখান বায়ার্ন মিউনিখে।
লেভারকুসেন ফ্যানদের সেই দুঃস্বপ্নের ২০০১-০২ সিজনের দুঃখ ভোলাতেই বোধহয় জাবি আলোনসো আর এই ২০২৩-২৪ সিজনের আগমন। লেভারকুসেনের ইতিহাস সৃষ্টি করার প্রথম ধাপ সম্পন্ন হওয়ায় বন্ধু টবিয়াসের জন্য সত্যি আমি অনেক আনন্দিত। বায়ারিনা স্টেডিয়াম থেকে তাদের বাধভাঙ্গা ফুর্তি আর উজ্জাপনের সেলফি আর ভিডিও টবিয়াস অলরেডি আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে। আমি মন থেকে কামনা করি যেন লেভারকুসেন এবার ট্রেবল জিতে লাখো-কোটি এয়ারফল্গসফ্যানদের ভীড়ে টবিয়াসেদের মতো ট্রু ফুটবল ফ্যানদের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুলে।
বুখোম, জার্মানি
১৪ এপ্রিল ২০২৪
#পান্থজনের_কচড়া