23/06/2025
ইরানের ইতিহাস একটি অতিপ্রাচীন এবং ঐতিহাসিক সংস্কৃতি এবং সভ্যতার ধারাবাহিকতা, যা হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইরান, যা পূর্বে পারস্য নামে পরিচিত ছিল, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন দেশ এবং সভ্যতার জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত। এর ইতিহাস অনেকগুলি রাজবংশ এবং সাম্রাজ্যের মধ্যে বিভক্ত, যা একাধিক ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন পেরিয়ে বর্তমান যুগে পৌঁছেছে।
১. প্রাচীন পারস্য (Achaemenid Empire)
প্রাচীন পারস্যের ইতিহাসের সূচনা ঘটে ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বে, যখন কিরোস দ্য গ্রেট পারস্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই সাম্রাজ্য, যা আখেমেনিড সাম্রাজ্য নামে পরিচিত, একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে এবং ভারত থেকে মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। কিরোস দ্য গ্রেটের শাসনকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তিনি প্রাচীন পৃথিবীর প্রথম মানবাধিকার সনদ, সিলিন্ডার অফ কিরোস তৈরি করেছিলেন। আখেমেনিড সাম্রাজ্য মেধা, বাণিজ্য এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব ঘটায়।
২. পার্থিয়ান ও সাসানিয়ান সাম্রাজ্য (Parthian and Sassanid Empires)
পার্থিয়ান সাম্রাজ্য (২২৪ খ্রিষ্টপূর্ব - ২৪১ খ্রিষ্টাব্দ) এবং পরবর্তী সাসানিয়ান সাম্রাজ্য (২৪১ খ্রিষ্টাব্দ - ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ) পারস্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পার্থিয়ানরা রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পরবর্তী সাসানিয়ানরা ইরানকে এক অভূতপূর্ব শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করে। সাসানিয়ানরা পারস্যে জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নতির জন্য সুপরিচিত ছিল।
৩. ইসলামী পারস্য (Islamic Iran)
৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম বাহিনী পারস্যে আক্রমণ করে এবং সাসানিয়ান সাম্রাজ্য পতিত হয়। পারস্য ধীরে ধীরে ইসলামী শাসনাধীনে চলে আসে এবং শিয়া ইসলাম এখানে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে। ৭ম শতাব্দীতে ইসলামের বিস্তার ঘটে এবং শিয়া ইসলামের অনুপ্রেরণায় ইরান এক বিশাল সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ইরান বিশ্বের শিয়া মুসলিমদের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
৪. সাফাভিড সাম্রাজ্য (Safavid Empire)
সাফাভিড সাম্রাজ্য ১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ছিল ইস্মাইল I। সাফাভিডরা পারস্যকে একত্রিত করে এবং শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। সাফাভিড সাম্রাজ্য বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে এবং এটি পশ্চিম এশিয়ায় ইসলামি শাসনের ভিত্তি তৈরি করে। সাফাভিডদের শাসনামলে পারস্য একটি সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ দেখতে পায়।
৫. কাজার সাম্রাজ্য (Qajar Dynasty)
১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে কাজাররা পারস্যে ক্ষমতা দখল করে এবং তাদের শাসনামলে পারস্যে আধুনিকীকরণের প্রয়াস দেখা যায়। তবে, কাজারদের শাসনকালে পারস্যের রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিদেশী শক্তির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ব্রিটেন ও রাশিয়া পারস্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপক হস্তক্ষেপ করে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণের চেষ্টা করা হয়।
৬. পাহলভি রাজতন্ত্র (Pahlavi Dynasty)
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে রেজা শাহ পাহলভি পারস্যে একটি নতুন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। রেজা শাহ আধুনিকীকরণ এবং পাশ্চাত্যীকরণের জন্য নানা ধরনের সংস্কার প্রবর্তন করেন। তার শাসনামলে, পারস্য আধুনিক শিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করে। তবে, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং অর্থনৈতিক অসন্তোষের কারণে, ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব ঘটে এবং রেজা শাহের রাজতন্ত্র পতিত হয়।
৭. ইসলামী বিপ্লব (1979)
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব ইরানে একটি বিশাল রাজনৈতিক পরিবর্তন আনে, যেখানে আয়াতুল্লাহ খোমেনি নেতৃত্বে ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিপ্লবের মাধ্যমে পারস্যের প্রাচীন রাজতন্ত্র ভেঙে যায় এবং ইরান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী বিপ্লব ইরানের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে দেয়। খোমেনির নেতৃত্বে শিয়া ইসলামের ভিত্তিতে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
৮. বর্তমান ইরান
১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর, ইরান বর্তমানে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের শাসন ব্যবস্থাটি শিয়া ইসলামের উপর ভিত্তি করে গঠিত এবং এর শীর্ষ নেতা (Supreme Leader) হলেন ধর্মীয় নেতা, যার হাতে ব্যাপক ক্ষমতা থাকে। ইরান তার পরমাণু কর্মসূচী, মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কারণে বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে।
ইরানের ইতিহাস তার সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত, ইরান একাধিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে, কিন্তু এটি আজও পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী দেশ হিসেবে পরিচিত।
゚viralシ