23/05/2025
প্রখ্যাত দার্শনিক আল্লামা ইকবাল লিখেছিলেন,
"প্রিয়া আমার, এক পাত্র বিষ দিয়ে কইলো, পান করো!
আমি পান করিলাম।
যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম
সে বাহু ধরে কইলো—
আমার অনুমতি ছাড়া মরতেও পারবে না!"
বাংলাদেশ তেমনই এক গভীর প্রেমের প্রতিচ্ছবি, যেখানে রাজনীতি নামক প্রিয়া জাতিকে একের পর এক বিষপাত্র হাতে তুলে দেয়। আর জাতি, ভালোবাসার আশায়, প্রিয়ার নির্দেশে বিষ পান করে—আবার যখন যন্ত্রণায় কাতর হয়, তখন সেই প্রিয়া বলে—“মরারও অনুমতি নেই”।
এই কথাগুলো আজ যেন নিছক কাব্য নয়, বরং আমাদের রক্তে গাঁথা বাস্তবতা। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসে। তবে গত এক বছরে সংস্কার প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়েছে এবং ড. ইউনুস তার পদত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব এবং জনসাধারণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ।
অন্তর্বর্তী সরকার যেনো একটি অসমাপ্ত কবিতার মতো হয়ে যাচ্ছে। ড. ইউনুস হলেন সেই সাধু কবি, যিনি রাজনীতির আঁধারে আলো জ্বালাতে এসেছিলেন। কিন্তু রাজনীতি তো আর ছায়া সহ্য করে না—আলো চাইলে তাকে শোষণ করে। তাই আজ তিনিও হতাশ; তাঁর সংস্কারের কথা হারিয়ে গেছে ষড়যন্ত্রের শব্দবন্যায়। তিনি বাধ্য হয়ে বলছেন—“আমি থাকতে পারছি না”, অথচ জাতি বলছে—“আপনি ছাড়া আমরা মরতে পারি না !”।
অপর দিকে সেনাবাহিনী নিয়তির বাহক না বিধাতার প্রতিনিধি তা কেউ বলে বুঝাতে পারছেনা। জেনারেল ওয়াকার যেন সেই অতৃপ্ত রাখাল যিনি বাঁশির সুরে নয়—শিসে জনগণকে ডাকেন। তাঁর ভাষায় ডিসেম্বরের ভেতর নির্বাচন চাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভোট কি শুধু একটি দিন? নাকি এটি একটি চেতনা? সেনাবাহিনী রাজনীতির মাঝখানে দাঁড়ালেই যে জাতি নিরাপদ তা কিন্তু নয়—অথচ আজ সেই নিরপত্তাই সবচেয়ে অনিশ্চিত। জেনারেল ওয়াকার যেন সময়ের দূত। তাঁর কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয় “ডিসেম্বরে নির্বাচন চাই”, তখন অনেকের কানে তা আশার বার্তা, আবার অনেকের কাছে হুমকির ধ্বনি। এক সেনাপ্রধান যখন নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করেন তখন প্রশ্ন উঠে—কাদের হাতে রাষ্ট্র? জাতি তখন প্রিয়ার বিষের চেয়ে বেশি ভয় পায় অস্ত্রের ঠাণ্ডা ইশারা।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলো করে প্রেমের নামে প্রতারণা! বিএনপি আজ চায় নির্বাচন। জামায়াত বলে আগে বিচার করো। এনসিপি বলে তোমরা কেউই প্রিয়া নও আমরাই নতুন প্রেমিক!
আর জনগণ? তারা বসে আছে বিষ পানের পরে, জানে না কার কথা সত্য কার হাতেই আছে পরবর্তী পাত্রটি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ—তবু এখনও ছায়ার মতো রাজনীতির আঙিনায়। যেন বিদায়ের পরে প্রেমিকের চিঠি—ছেঁড়া, পুরনো, কিন্তু ফেলা যায় না।
নিকট অতীতে শাহবাগ আবার গর্জেছে এনসিপি ও ছাত্রসমাজ মিলে। তারা বলেছে, প্রেমিকদের বদলাও, নইলে জাতি মরবে।”
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—তিনটি দল, তিনটি ভাষা কিন্তু একটি অভিন্ন আকুতি ক্ষমতার হিস্যা। বিএনপি নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে, জামায়াত সংস্কারের পূর্বশর্তে ভোট আটকে রাখতে চায়, আর এনসিপি শহরের রাস্তায় শাহবাগের প্রেতাত্মা ফিরিয়ে এনেছে।
রাজনীতি আজ চায় ঘর অথচ তারা দেয় শ্মশান।
অন্যদিকে ইশরাক হোসেন—তরুণ নেতৃত্বের একটি নতুন চিত্র। তিনি যেন বিষপাত্রে একটি তাজা ফুল, যিনি বলছেন “রাজনীতি মানে মৃত্যু নয়—আবার বাঁচা যায়”।
প্রিয়া যদি বিষ দিয়ে বলে “পান করো”, আর সেই বিষও যদি ভালোবাসার নামে হয়, তবে প্রশ্ন জাগে—ভালোবাসা কি শর্তহীন হতে পারে না?
শাসকের মুখে মধু, হাতে শিকল। জনগণের ইচ্ছা যেন মৃতপ্রায় আর ন্যায়বিচার যেন কারো ব্যক্তিগত গৃহপালিত পোষা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে (১) রাজনৈতিক সদিচ্ছা। (২) নিরপেক্ষ ও বাধ্যবাধকতাহীন নির্বাচন। (৩) সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক নয়—সাংবিধানিক ভূমিকা।
(৪) সবচেয়ে জরুরি—জনগণের গণচেতনায় জাগরণ।
রাজনীতি আজ সেই প্রিয়ার মতো—যে ভালোবাসার নামে বিষ দেয়, আবার মৃত্যুরও অধিকার কেড়ে নেয়। আমরা সেই প্রেমিক জাতি যারা শতবার প্রতারিত হয়েও অপেক্ষা করি—হয়তো একদিন প্রিয়া বিষ নয়, জল দেবে। কিন্তু এখন সময় এসেছে প্রেমিকের জেগে ওঠার। শাসককে বলতে হবে—
“বাহু ধরে রাখলে হবে না, এবার আমরাও বলতে শিখেছি— তুমি যতই প্রিয়া হও, আমরা আর বিষ খাবো না।”
লেখক: মাহবুবুর রহমান চৌধুরী
সাবেক সাধারন সম্পাদক
গোলাপগঞ্জ প্রেসক্লাব