08/10/2025
From Prof Kamru Hasan Mamun
সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতি বছরই এক ধরনের আগ্রহ দেখা যায়—এইবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার কে পেলেন? শুধু বিজ্ঞানীরাই নয়, বিজ্ঞানে আগ্রহী সাধারণ মানুষও জানতে চান, এবার কোন আবিষ্কার পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রাখছে।
২০২৫ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জন ক্লার্ক (John Clarke), মিশেল এইচ. দেভোরে (Michel H. Devoret) এবং জন এম. মার্টিনিস (John M. Martinis)। তারা পুরস্কার পেয়েছেন কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য—“macroscopic quantum mechanical tunnelling” এবং “energy quantisation in electric circuits”। অর্থাৎ, তারা দেখিয়েছেন কীভাবে কোয়ান্টামের রহস্যময় আচরণ, যা সাধারণত ক্ষুদ্র কণার জগতে ঘটে, তা বাস্তব, বড় পরিসরের জগতেও দেখা সম্ভব। এই আবিষ্কার শুধু বিজ্ঞানেই নয়, ভবিষ্যতের প্রযুক্তি—বিশেষ করে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে—নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
তাদের কাজকে বুঝতে হলে আগে টানেলিং কি বোঝা জরুরি। তাহলে আসুন আগে tunnelling কি সেটা সহজ ভাষায় একটু বোঝার চেষ্টা করি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এমন এক শাখা, যা খুব ছোট জগতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করে—যেখানে সব কিছু একেকটা কণার মাত্রায় ঘটে। এই ক্ষুদ্র জগৎ এতটাই ছোট যে সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়েও তা দেখা যায় না।
অন্যদিকে আমরা যে জগতে বাস করি, সেটাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ম্যাক্রোস্কোপিক জগৎ—যেখানে অসংখ্য কণার সমষ্টিতে বড় জিনিস তৈরি হয় যেইগুলোকে আমরা হাতে ধরতে পারি। যেমন, একটি ফুটবল মিলিয়ন বিলিয়ন অণু দিয়ে গঠিত, কিন্তু সেখানে কোয়ান্টাম নিয়মে কিছু ঘটে না। আমরা জানি, বলটি যদি দেয়ালে ছুঁড়ে মারি, সেটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে। যতবার ছুঁড়ে মারব ততবার নিশ্চিতভাবে ফিরে আসবে এবং এটাই আমাদের পরিচিত বাস্তব নিয়ম। কিন্তু একক কণার জগতে ব্যাপারটা একেবারেই অন্যরকম। সেখানে কোনো কোনো সময় কণা এমন দেয়াল বা বাধা পেরিয়ে যেতে পারে, যা সাধারণ নিয়মে পেরোনো অসম্ভব মনে হয়। কণাটি যেন দেয়ালের ভেতর দিয়ে ‘টানেল’ তৈরি করে অপর পাশে চলে যায়। এই অদ্ভুত ঘটনাটিই কোয়ান্টাম জগতে টানেলিং (tunnelling) নামে পরিচিত। কিন্তু দেয়ালের উচ্চতা যদি অসীম হয় তখন আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভাষায় দৃঢ় দেয়াল বলি যেটি কোন কোয়ান্টাম কণাও সসীম শক্তি নিয়ে পার হতে পারে না।
এইবার আসুন আরেকটু বিস্তারিত বোঝা বা জানার চেষ্টা করি। এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন জন ক্লার্ক, যিনি এখন ৮৩ বছর বয়সী। ১৯৮০-এর দশকে তিনি তরুণ গবেষক মিশেল দেভোরে ও জন মার্টিনিসকে সঙ্গে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলেতে একটি দল গঠন করেন। তাঁদের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা আজ নোবেল পুরস্কারে স্বীকৃত হলো—একইসঙ্গে শিক্ষক-শিষ্যের যৌথ সাফল্যের এক অনন্য দৃষ্টান্তও তৈরি করল।
তারা তৈরি করেন একটি বৈদ্যুতিক সার্কিট, যেখানে ব্যবহৃত হয়েছিল দুটি সুপারকন্ডাক্টর—এমন পদার্থ যা কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে। এই দুটি সুপারকন্ডাক্টরের মাঝখানে রাখা হয় এক পাতলা ইনসুলেটর, যা নিজে কোনো বিদ্যুৎ পরিবহন করে না। এই ব্যবস্থা তৈরি করে এক ধরনের “Josephson Junction”, যা আজকের কোয়ান্টাম সার্কিটের মূল উপাদান।
এই পরীক্ষায় দেখা যায়, সুপারকন্ডাক্টরের ভেতরের সব চার্জযুক্ত কণাগুলো একসঙ্গে এমনভাবে আচরণ করে যেন তারা একটি একক কণায় রূপ নিয়েছে, যা পুরো সার্কিট জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এই সিস্টেমে বিদ্যুৎ প্রবাহ চললেও কোনো ভোল্টেজ তৈরি হয় না—এ অবস্থাকে বলা হয় zero-voltage state। কিন্তু কখনো কখনো এই সিস্টেমটি হঠাৎ করেই কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে সেই অবস্থার বাইরে “লাফিয়ে” বেরিয়ে আসে, এবং তখনই সার্কিটে একেবারে হঠাৎ করে বৈদ্যুতিক ভোল্টেজ সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেন, এই সিস্টেমটি কোয়ান্টাইজড—অর্থাৎ এটি শক্তি শোষণ বা নির্গমন করতে পারে কেবল নির্দিষ্ট, বিচ্ছিন্ন পরিমাণে। ধারাবাহিকভাবে নয়। এটি ছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের এক সরাসরি পরীক্ষামূলক প্রমাণ, সেটিও দৃশ্যমান, বাস্তব পরিসরে মেক্রোস্কোপিক দুনিয়ায়!
তাদের এই গবেষণা আজকের কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির অন্যতম ভিত্তি। গুগল, আইবিএম, ইন্টেলসহ বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যে সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিট (superconducting qubit) নিয়ে কাজ করছে, তার মূলেই রয়েছে এই নোবেলপ্রাপ্ত তত্ত্ব ও পরীক্ষা।এছাড়া এই প্রযুক্তি থেকে তৈরি হয়েছে অত্যন্ত সংবেদনশীল সেন্সর, যা ক্ষুদ্রতম ভোল্টেজ, চৌম্বক ক্ষেত্র বা পরিবেশগত পরিবর্তন শনাক্ত করতে পারে। ভবিষ্যতে এই সেন্সর ব্যবহৃত হবে মেডিকেল ইমেজিং (যেমন MRI), ভূতাত্ত্বিক জরিপ এবং মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায়। সবচেয়ে বড় কথা, এই আবিষ্কার কোয়ান্টাম আচরণকে ব্যবহারযোগ্য বাস্তব প্রযুক্তিতে রূপ দিয়েছে। এর ফলে এখন কোয়ান্টাম এনক্রিপশন—অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিরাপদ তথ্য প্রেরণ—বাস্তবে সম্ভব হচ্ছে। ভবিষ্যতের যোগাযোগব্যবস্থা তাই হতে চলেছে প্রায় “অভেদ্য”।
তাদের এই কাজ এক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে—কোয়ান্টামের জগত কোথায় শেষ হয়, আর আমাদের সাধারণ (ক্লাসিকাল) জগত কোথা থেকে শুরু হয়? তাদের পরীক্ষাই প্রথমবারের মতো দেখিয়েছে, সেই সীমারেখা আসলে এতটা দূর নয়; আমাদের পরিচিত পৃথিবীর ভেতরেই কোয়ান্টামের রহস্যময় নিয়ম কাজ করছে। তবুও পথ এখনো সহজ নয়। কোয়ান্টাম সার্কিটকে স্থিতিশীল রাখা (অর্থাৎ decoherence ঠেকানো) এখনো কঠিন! এছাড়া এই প্রযুক্তিকে বড় স্কেলে কার্যকর করা, ত্রুটি কমানো, এবং অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রার বাইরে ব্যবহারযোগ্য করা এখনো গবেষণার বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও, বিজ্ঞানীরা থেমে নেই। মানুষ এখন এমন এক অভিযাত্রায় পা রেখেছে, যার গন্তব্য—মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার।
আজ কোয়ান্টামের রহস্য আর কেবল ল্যাবরেটরির ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়—এটি এখন আমাদের প্রযুক্তির হৃদস্পন্দনে বেঁচে আছে।