09/05/2025
ডিভোর্সের ৩৭ বছর পর নিজের পরিচালিত বৃদ্ধাশ্রমের এক কোণে হঠাৎ চেনা এক মুখ দেখে যেন আমার নিঃশ্বাসটা গলায় আটকে গেল। কিছুতেই বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এত বছর পর মানুষটিকে এভাবে দেখতে হবে—এটা একেবারেই অকল্পনীয় ছিলো।
লোকটা একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে, শরীর নুইয়ে পড়েছে, মুখে কোনো রঙ নেই। এক নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধতা তাঁকে যেন ঘিরে রেখেছে। কিছুটা সংকোচ আর দ্বিধা নিয়ে ধীরে ধীরে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই—তার চোখে নেই কোনো চেনার ছাপ। তখন বুঝলাম, লোকটা চোখে দেখতে পায় না।
৩৯ বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিলো সমীরের সঙ্গে। শান্ত, মধুর সম্পর্ক ছিল আমাদের। একান্নবর্তী পরিবারে সবাই মিলে থাকতাম। সংসারে ভালোবাসা ছিল, শ্রদ্ধা ছিল, অন্তত আমি তো তাই ভাবতাম। বিয়ের দু’বছর পেরিয়ে গেলেও যখন আমাদের কোনো সন্তান হলো না, তখন ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলো পরিবেশ।
চিকিৎসা জানাল—আমি কখনো মা হতে পারব না। এরপরই শুরু হয় পারিবারিক মানসিক অত্যাচার। নানা কথা, নানা ইঙ্গিত। তবুও মুখ বুজে সহ্য করছিলাম—কারণ, আমার বিশ্বাস ছিল সমীরের ভালোবাসায়। কিন্তু পরিবারের চাপ কিংবা তার নিজের ভেতরের কিছু দুর্বলতা—ধীরে ধীরে সেও যেন দূরে সরে যেতে লাগলো।
একদিন নিজের বাপের বাড়ি কিছুদিনের জন্য গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করতে চাইলাম। কিন্তু ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। বাপের বাড়ি যাওয়ার তিনদিন পর এক কুরিয়ার এলো—তাতে লেখা সমীরের নতুন বিয়ের খবর, সঙ্গে ডিভোর্স পেপার। সেই মুহূর্তে যেন মাটি আমার পায়ের নিচ থেকে সরে গেল।
প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম, প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম… কিন্তু কার কাছে যাব? যে মানুষটা একদিন আমার জীবনের অংশ ছিল, সে-ই তো আমার দরজায় তালা মেরে দিয়েছে। শেষমেশ সই করে পাঠিয়ে দিলাম ডিভোর্স পেপারে।
এরপর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলাম। মনে হতো, এ পৃথিবীতে থাকার আর দরকার নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম, জীবন শুধুই নিজের জন্য নয়। অনেকেই আছে, যারা আমার মতোই অবহেলিত—তাদের জন্য কিছু করতে হবে।
নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে একদিন গড়ে তুললাম একটা অনাথালয়, একটি বৃদ্ধাশ্রম, বিধবা ও একাকী নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের আয়োজন করলাম। সমাজের সেই সকল মানুষদের পাশে দাঁড়ালাম, যারা তুচ্ছ কারণে পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আজ এত বছর পর, সেই বৃদ্ধাশ্রমেই নিজের প্রাক্তন স্বামীকে দেখে এক আশ্চর্য অনুভূতি হল। জানতে পারলাম—তাঁর সন্তানরা বিদেশে, কেউ ফিরেও তাকায় না। তাই বৃদ্ধাশ্রমই তার শেষ ঠিকানা।
এক সময় যে মানুষ নিঃসন্তান স্ত্রীকে ত্যাগ করেছিল, আজ সেই মানুষটাই নিজের সন্তানদের দ্বারা ত্যাগপ্রাপ্ত। এটা কি সৃষ্টিকর্তার ন্যায্য বিচার নয়?
শেষ কথায়:
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, কাউকে কাছে টানি, কাউকে দূরে সরাই। কিন্তু প্রতিটি সম্পর্কের পেছনে থাকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাই কাউকে ত্যাগ করার আগে ভাবুন—ভবিষ্যতেও কি আপনি সেই সিদ্ধান্তে শান্তি পাবেন?
আমাদের জীবনে যা নেই, তা নিয়ে দুঃখ করে নয়—যা আছে, তা দিয়েই জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তুলুন। কারণ মহান সৃষ্টিকর্তা জানেন, কাকে কী দিলে তার জীবনের ভারসাম্য ঠিক থাকবে।
জীবন বদলায়, সময় ঘুরে ফিরে আসে — ৩৭ বছর পর সেই মানুষটিকে এভাবে দেখতে হবে, তা কখনো continue….