29/08/2025
আজকের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে “মব” আর “মাস পিপল”, দুটোই ট্যাগ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে জঙ্গি, মৌলবাদী বা fringe গোষ্ঠী নিজেদেরকে ‘জনমানুষের’ প্রতিনিধি দাবি করে, আর সেই পরিচয়টি রাষ্ট্রীয় নীরবতা বা নরম-সমর্থনের আড়ালে মাঠে নামানো হয়। সাম্প্রতিক হামলা, মব-অভিযান এবং রাজনৈতিক হিংসার তরঙ্গ এই প্রবণতাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
আজকের ঘটনা, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে 'মঞ্চ ৭১' আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় প্রবীণ রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করা এবং পরে পুলিশ ভ্যানে তুলে নেওয়া, এই কৌশলগুলোর বাস্তব চিত্র।
আলোচকরা আওয়ামীলীগ বা ছাত্রলীগের ব্যানারে প্রোগ্রাম করছিলেননা। তাহলে কেন মব দিয়ে অনুষ্ঠানটি পণ্ড করতে হলো? সাংবাদিক ও অধ্যাপকদের হেনস্তা করা হলো, এবং সদর্পে মব পার্টিরা এগিয়ে এসেছিলো ।
রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও বিপজ্জনক। পুলিশ হামলাকারীদের আটক না করে ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও অধ্যাপকদের গ্রেপ্তার করেছে, অবাক করার মতো বিষয়, right? এর মানে রাষ্ট্র সহিংসতা দমন করছে না, বরং ভিন্নমত নিশ্চিহ্ন করার জন্য তার ক্ষমতা ব্যবহার করছে। এটা নীতি-ভিত্তিক failure এবং institutionalized bias ।
হামলাকারীদের একজনের নাম প্রকাশ্যে এসেছে, শাকিবুল হাসান, জামাত-শিবির ক্যাডার, এটা কি প্রমাণ করে, রাষ্ট্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীকে tactical instrument হিসেবে ব্যবহার করছে?
৭১ এবং সংবিধান এই গোষ্ঠীর কাছে হুমকিস্বরূপ, কারণ মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে, এই কাঠামো সরাসরি তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে। জাতির প্রতিষ্ঠাবাদী ইতিহাস এবং তার নৈতিক-আইনি ভিত্তি সংরক্ষিত থাকলে জামায়াত বা সমতুল্য গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অবস্থান, রাজনৈতিক পুনরুদ্ধারের দাবি এবং বিকল্প ধারাভাষ্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য তাদের স্বার্থ হলো ৭১ এর ন্যারেটিভকে দুর্বল, বিকৃত বা প্রশ্নবিদ্ধ করা।
মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান নিয়ে আলোচনা তাদের জন্য অস্বস্তিকর, কারণ এগুলো accountability, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়, আর সংবিধান রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব ও নাগরিক অধিকারের আইনি-নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। এর ভেতর জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সংরক্ষণ এবং ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা সুরক্ষিত থাকে, যা তাদের historical revisionism, ideological legitimation ও ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের প্রকল্পকে ব্যাহত করে। ফলে যখন রাষ্ট্র সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহিংস মবকে ব্যবহার করে এবং সংবিধানসিদ্ধ ন্যারেটিভকে দমন করে, তখন তা কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং সংবিধানকে ওভাররাইট করে ক্ষমতা কনসোলিডেশনের প্রক্রিয়া।
আর যখন রাষ্ট্র নিজের পথ বিপরীতমুখী করে ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করে, তখন মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান নিয়ে যেকোনো আলোচনা তাদের কাছে সরাসরি হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে। আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্য স্পষ্ট, জনগণকে বিকল্প কণ্ঠস্বর এবং স্বাধীন তর্ক-বিতর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা।
Gramscianর হেজিমনি এবং memory politics থেকে দেখা যায়, রাষ্ট্র শুধু আজকের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কাজ করছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি আর ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এজন্য তারা বাইরের মতবাদ আর অর্থায়নকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে।
মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ এবং সংবিধান রাষ্ট্রের জন্য “inconvenient truths” হিসেবে দেখা হয়, তাই এই ইতিহাসকে দমন করা হয়, বিকৃত করা হয়, কিংবা নতুনভাবে সাজানো হয়, যাতে ভিন্নমত চাপা পড়ে আর শাসকের বৈধতা টিকে থাকে।
এখানে একটি আন্তর্জাতিক ও জিওপলিটিক্যাল প্রেক্ষাপটও আছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রাপ্ত অর্থায়ন, ধর্মীয় নেটওয়ার্ক, বিদেশি জঙ্গি বা fringe আইডিওলজি সবই দেশে ভিন্নমত দমন ও রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে (European Union Agency for Asylum, albd.org)। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী Islamist networks, বা মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক radical funding, কখনো কখনো স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে tactical alliance তৈরি করে। এর ফলে শুধু দেশীয় রাজনীতি নয়, সামরিক ও সিকিউরিটি কৌশলও জটিল হয়ে ওঠে।
ক্ষমতাসীনদের এই আচরণকে বুঝতে গেলে দু’টি কৌশল লক্ষণীয়: প্রথম, স্মৃতি-রাজনীতির রিভিশন, ইতিহাসকে পুনর্লিখন বা ব্যাখ্যা বদলানো। দ্বিতীয়, মাঠে ভীতির রাজনীতি, মব, মরাল পলিসিং বা ভিত্তিহীন গালি-ধর্মীয় আক্রমণের মাধ্যমে ভিন্নমতকে নিরুৎসাহিত করা। কখনও কখনও এই কৌশলগুলোকে আংশিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্যালকুলেশন সমর্থন করে, কখনও ‘নীরব সহমত’ বা ‘সেক্টোরিয়াল প্যাট্রোনেজ’ হিসেবে কাজ করে।
ফলাফল ভয়াবহ। মব বা সংগঠিত সহিংসতা রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠছে। রাষ্ট্র tacit approval দিয়ে সহিংসতা sustain করছে। মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান ও নাগরিক অধিকারের প্রশ্নগুলো রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে যাচ্ছে। এটি isolated ঘটনা নয়, এটি structural crisis of democracy, rule of law, civil society এবং historical memory এর প্রকাশ। রাষ্ট্র যখন স্বাধীনমনা শিক্ষকের কণ্ঠস্বর, প্রবীণ রাজনীতিকের উপস্থিতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দাবিকে ভয় দেখিয়ে দমন করে, তখন সেটি তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক বৈধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
৭১ ও সংবিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ইতিহাস-দ্বন্দ্ব নয়, এটা রাজনৈতিক পুনর্লিখন, বৈধতা পুনরুদ্ধার এবং ক্ষমতায় ফেরার কৌশল। রাষ্ট্রীয় intolerance, extrimism, এবং জিওপলিটিক্যাল leverage একত্রে কাজ করছে, এবং মুক্তিযোদ্ধা গ্রেপ্তার, সাংবাদিক ও শিক্ষকের হেনস্তা, মব ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আচরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ড. লুবনা ফেরদৌসী