21/09/2025
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হঠাৎ এত আগ্রহের নেপথ্যে কী?
বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নিয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ এ একটি সংবাদ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বরাতে। সেখানে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের সব ক্রয় প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে।' একথা বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পত্রিকাটি বলছে, প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের জন্য সব ধরনের ক্রয় প্রক্রিয়া পুরোপুরি উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ করতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে বিগত সরকারের অধীনে চলমান সব সরাসরি দরকষাকষি বা আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে। শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদন ২০২৫-এ এ তথ্য জানানো হয়েছে।' (সূত্র কালের কণ্ঠ)
এই খবরের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক শোরগোল হচ্ছে। আলোচনা-সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছে বর্তমান ইউনুস প্রশাসন। বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ বিষয়ে যক্তরাষ্ট্রের অযাচিত মন্তব্য বা হস্তক্ষেপ হিসেবেও দেখছেন অনেকে বিষয়টিকে।
যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে কেন এমন মন্তব্য কেন করলো তার কারণ খুঁজতে গিয়ে যা জানা যাচ্ছে তাহলো নিন্মরূপ।
বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরেই খনিজ সম্পদ উত্তোলন, অনুসন্ধানে বড় ধরণের বিনিয়োগ করতে চায়। গ্যাস উত্তোলনে বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগও রয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান শেভরনের এবং দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটি এক্সিলারেট এনার্জির। তার মানে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে তেল-গ্যাস খাতে বিনিয়োগ করে আসছে এবং এর পরিমাণ আরো বাড়াতে চায় তারা।
২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ-এর বাসভবনে সাক্ষাৎ করে এক্সন মোবিলসহ আরো বহুজাতিক মার্কিন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আগ্রহের কথা জানান। এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও আরো অধিক পরিমাণ মার্কিন বিনিয়োগ চাওয়া হয়। এর পর ২০২৩ সালের ৫ আগস্টে যমুনা টিভি একটি প্রতিবেদ প্রকাশ করে যে,তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সন মবিল। এজন্য দ্বিতীয় দফায় প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ-এর কাছে এক্সন মোবিলের পক্ষ থেকে চিঠিও দেয়া হয়। সে মাসেরই ৩১শে আগস্ট সচিবালয়ে ইউএস–বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। পরে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জনানো হয় বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
সাংবাদিকদের ইউএস–বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের সভাপতি অতুল কেশপ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে খুবই আগ্রহ দেখাচ্ছে। গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান সম্ভব। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে তেল-গ্যাসের দাম উত্তরোত্তর বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায়। ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার প্রতিফলন, পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি ও অভিজ্ঞতা আদান–প্রদান করতে পারলে দুপক্ষই লাভবান হবে। সেই মার্কিন প্রতিনিধি দলে ছিলেন এক্সিলারেট এনার্জির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টিভেন কোবস, ব্ল্যাক স্টোনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনন্দ ঝাঁ, এক্সোনমবিলের নতুন অপরচুনিটি ম্যানেজার জনাথন উইলসন, করটোভার গভ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাফেয়ার পরিচালক আনুজা কাদিয়ান, এইচএসবিসি ব্যাংকের হেড অব মাল্টিন্যাশনাল আন্দালিব মির্জা ও দক্ষিণ এশিয়ার ইউ এস গ্রেইন্স কাউন্সিলের পরিচালক রিসি কানাডি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই সময় ব্যাপক আলোচনায় থাকা ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ কেন হলোনা? এখানেই রয়েছে ঘটনার আসল চমক।
এক্সন মোবিল সেই সময় থেকেই চাচ্ছিল বাংলাদেশে তারা তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করবে কিন্তু সেটা বাংলাদেশকে দিতে হবে আনসোলিসিটেডভাবে। কোন প্রকার টেন্ডার ছাড়াই বিশেষ আইনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের অনশোর ও অফশোর মিলে মোট ২৪টি ব্লকের একক আধিপত্য মার্কিন কোম্পানি এক্সন মোবিলকে আনসোলিসিটেডভাবে দিলে বঙ্গোপসাগরের বিশাল সমুদ্রসীমায় মার্কিন কোম্পানির স্বার্থ বা নিরাপত্তা রক্ষায় মার্কিন রণতরী মোতায়েন হবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য গঠিত মার্কিন জোট কোয়াডে বাংলাদেশকে ভেড়াতে না পেরে এমন একটি উদ্যোগের জন্য মর্কিন সরকার সেই সময়ে মুখিয়ে ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সেই সময় বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের মত এত বিশাল একটি বিষয়কে আনসোলিসিটেডভাবে কাউকে দিতে চায়নি। পরবর্তী বছর ২০২৪ সালের ১০ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মত অফশোর বিডিং রাউন্ড ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে যারা যোগ্য তারাই কাজ পাবে এমন নীতিতে ছিল শেখ হাসিনার সরকার সেই সময়।
দু:খজনক হলেও সত্য যে, আওয়ামী লীগের সময় পর্যন্ত ৭টি আন্তর্জাতিক কোম্পানি দরপত্র কিনলেও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোন প্রতিষ্ঠানই আর আগ্রহী হয়নি। এখন স্বচ্ছতার নামে এমন কোন কোম্পানিকে দেয়ার জন্য তলে তলে আলোচনা শুরু হচ্ছে কিনা জানা নাই কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে খুবই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান কোম্পানি এক্সন মোবিল যদি ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে আসে তবে ধরে রাখতে পারেন যে, তাদে সঙ্গে আমাদের বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীও আসবে।
20250926