01/08/2025
আইজিপি মামুনের জবানবন্দী নিয়ে আমাদের কিছু কথা
আদালতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের কথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর একটা কপি হাতে পেলাম। এটি দেখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু কথা না বললেই নয়।
যে ব্যক্তি একসময় দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে ছিলেন, সেই ব্যক্তি আজ এক বছর সলিটারি কনফাইনমেন্টে কাটিয়ে অবৈধ সরকারের অবৈধ ট্রাইব্যুনালে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা কোনোভাবেই একটি স্বতঃস্ফূর্ত, বিবেকনির্ভর বক্তব্য হতে পারে না। এটি একটি সুপরিকল্পিত, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এবং ভবিষ্যতে সুবিধা লাভের আশায় প্রস্তুত করা আত্মরক্ষামূলক বিবৃতি—যার উদ্দেশ্য হলো দেশের নিরাপত্তা বাহিনী, অতীত সরকারব্যবস্থা ও একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী রাষ্ট্রবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ও সন্দেহ সৃষ্টি করা। এই অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে একটি অবৈধ, অগণতান্ত্রিক, পাকিস্তানপন্থী ও জঙ্গিবাদ লালনকারী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়।
আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই—বর্তমান তথাকথিত 'ইউনুস সরকার' একটি অবৈধ গোষ্ঠী। এটি সংবিধান, গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকারকে পদদলিত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। এই অবৈধ সরকারের কাছে আমাদের কোনো দাবি নেই। বরং আমাদের একমাত্র লক্ষ্য—এই অবৈধ, পাকিস্তানপন্থী, মৌলবাদপুষ্ট শাসনব্যবস্থা ও তাদের প্রতিটি ষড়যন্ত্রকে একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে সমূলে ধ্বংস করা।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন তার জবানবন্দির শুরুতে নিজের দীর্ঘ কর্মজীবনের বর্ণনা দিয়েছেন, যেন তিনি একজন অভিজ্ঞ, দায়িত্বশীল, রাষ্ট্রসচেতন ব্যক্তি। অথচ তিনি পরক্ষণেই বলেন, "আমি জানতাম না", "আমি কিছু করতে পারিনি"—যা তার নিজস্ব বক্তব্যের সাথেই সাংঘর্ষিক। একদিকে তিনি ‘কোর কমিটি’র বৈঠকে অংশ নিয়েছেন যেখানে রাষ্ট্রের জনগণ, সম্পদ রক্ষা এবং জান মালের হেফাজতে আইনানুগ সিদ্ধান্ত হয়েছে; অন্যদিকে বলছেন, এসবের দায় তিনি নিতে পারেন না। এই দ্বৈত বক্তব্য একজন সাহসী, বিবেকবান রাষ্ট্রকর্মীর নয়; বরং একজন আত্মরক্ষামূলক, সুবিধাবাদী ও ভীতচিত্ত কর্মকর্তা যিনি বর্তমান অবৈধ সরকারের খুশি অর্জনের আশায় নিজের অতীতের গৌরবকে আজ বিকিয়ে দিচ্ছেন।
তিনি তার জবানবন্দিতে যেটিকে "বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন" বলেছেন, সেটি প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি সুসংগঠিত উগ্রবাদী জঙ্গি-চক্রান্ত। জামাত-শিবির, হিযবুত তাহরীর এবং আন্তর্জাতিক ইসলামি মৌলবাদী সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এই 'হামলার' লক্ষ্য ছিল গণভবন অভিমুখে কোনো শান্তিপূর্ণ মিছিল নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে দেশের মূল কাঠামোকে ধ্বংস করে একটি পা'কিস্তান-পন্থী ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া। এই চক্রান্ত রুখতে দেশের পুলিশ, সেনা ও গোয়েন্দাবাহিনী যে দায়িত্বশীলতা দেখিয়েছে, তা ছিল সময়োপযোগী ও রাষ্ট্ররক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আইজিপি মামুন এই প্রতিরোধকে আজ অনুতাপের ভাষায় ব্যাখ্যা করে নিজেকে হাস্যকর হিসেবে উপস্থাপন করলেন। তিনি দাবি করছেন, র্যাবের TFI সেলে গোপনে বন্দি রাখা, নির্যাতনের ঘটনাগুলো তার জানার বাইরে ছিল। অথচ, তিনিই তখন র্যাবের মহাপরিচালক! এই বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে তিনি সেই পদে দায়িত্ব পালনের জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য ছিলেন; আর যদি মিথ্যা হয়, তাহলে তিনি বিশ্বাসঘাতক এবং ইতিহাস বিকৃতিকারী।
এই ব্যক্তির পারিবারিক ইতিহাসও গুরুত্বপূর্ণ। তার পিতা মান্নান চৌধুরী ছিলেন সুনামগঞ্জের একজন পরিচিত রা'জাকার-মনস্ক ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এলাকায় আত্মগোপন করে ছিলেন। তার নানা ছিলেন কুখ্যাত মুসলেম রা'জাকার, যিনি কিশোরগঞ্জে গণহত্যায় জড়িত ছিলেন। মামুন এই পরিবারের আদর্শে বড় হয়েছেন। এই তথ্য কোনো কল্পনা নয়—সুনামগঞ্জের প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী তাঁর বই "ভাটি বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ: আমার অহংকার"-এর ২৩২ নম্বর পাতায় লিখেছেন, “এক রাতে শ্রীহাইলের আবদুল মান্নান চৌধুরী এসে হাজির হলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদের বন্ধু এবং শাল্লা আওয়ামী লীগের নেতা। যুদ্ধ চলাকালে ভয়ে পালিয়ে ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে এক পা'কিস্তানী দালালের আশ্রয়ে ছিলেন স্বীকার করে অনুরোধ জানালেন, শাল্লার সাময়িক প্রশাসনের দায়িত্ব দিয়ে তার মর্যাদা রক্ষা করার।” এই ইতিহাস মামুনের রাজাকার-ঘনিষ্ঠ মনস্তত্ত্বেরই প্রমাণ।
সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, আইজিপি মামুন তার বক্তব্যে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা, সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম, অভ্যন্তরীণ বৈঠকের তথ্য, কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং অপারেশনাল কার্যক্রম জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন—যা স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পরিপন্থী ও রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ড। এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার ভিত নড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা, যার প্ররোচনায় রয়েছে বর্তমান অবৈধ সরকার ও তার পা'কিস্তানপন্থী পৃষ্ঠপোষকরা। যে বাহিনী শীর্ষ পদে সে ছিলো তাদের উপর পরিচালিত গণহ'ত্যা নিয়ে মামুনের কোন বক্তব্য নেই। তার বিবেক বন্ধক দেয়া না হলে এমনকি হবার কথা নয়।
এই স্বীকারোক্তি কোনো "বিবেকের তাড়না" থেকে আসেনি। এটি একটি পরিকল্পিত নাটক। এটি এসেছে রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তি একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী পুলিশ, সেনা, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের মনোবল ভেঙে দিতে চায়। আমরা ভুলে যাইনি—এই দেশ রক্ত দিয়ে গড়া। আমাদের চেতনার মূলভিত্তি গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা। আমরা জানি কারা এই ভিত্তিকে নষ্ট করতে চায়, এবং কারা তাদের হয়ে স্বেচ্ছায় নাটকের অংশ হয়ে উঠছে।
আমরা আইজিপি মামুনের এই স্বীকারোক্তিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে বলি—বর্তমান অবৈধ ইউনুস সরকার ও তাদের দোসরদের প্রতিটি ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হলে, রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে 'একাত্তরের পক্ষের' শক্তিকে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। এই সময়, এই মুহূর্ত, এই চক্রান্তের বিপরীতে আমাদের এখন এক দফা এক দাবিই—চূড়ান্ত প্রতিরোধ ও রাষ্ট্রীয় মুক্তি।
20250801