25/09/2025
প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের এই সংঘর্ষময় পরিস্থিতিতে , ব্যক্তি ভোগলিপ্সার বশবর্তী হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বাত্মক উন্নতির পথ খুঁজে পেতে দিশাহারা।
তাই ভারতের ষড়দর্শনের যুগানুকূল প্রয়োগের উদ্দ্যেশ্যে , সাধারণে পক্ষে বোধগম্য দর্শন 'একাত্ম মানবদর্শন' নিয়ে ১৯৬৫ সালে গোয়ালিয়র অধিবেশনে উপস্থিত হয়েছিলেন পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়। ষড়দর্শনের যুগানুকূল ব্যাখ্যা ও সংক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমে পন্ডিত দীনদয়াল ভারতবর্ষের সমাজনীতি , অর্থনীতি , রাজনীতি , শিক্ষানীতি ,গ্ৰাম-বিকাশের নীতির দিকনির্দেশ করেন।
আমরা জানি , দীর্ঘ বৈদেশিক আক্রমণ শুধু আমাদের ভূমি দখল করেনি , শুধু আমাদের সম্পদ লুঠ করে নি , বিদেশি শত্রুর এই আক্রমণ ছিল সর্বাত্মক। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি , চিন্তা ভাবনার মধ্যেও একপ্রকারের ঔপনিবেশিকতা , দাসত্ব প্রবেশ করাতে তারা সমর্থ হয়েছিল।
স্বামী বিবেকানন্দ পরাধীন ভারতবর্ষে সনাতন ভারতীয় জ্ঞান-পরম্পরা কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তে ব্যাখ্যা করে সারা বিশ্বের সামনে রেখেছিলেন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরেও , আমরা রাষ্ট্র-পরিচালনার বিভিন্ন নীতি তে দেখেছি বৈদেশিক তত্ত্বের অনুকরণ।
এই অবস্থায় পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় এর 'একাত্ম মানবদর্শন' দেশকে 'স্ব'-তন্ত্র অর্থাৎ ভারতবর্ষের নিজস্ব পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনার নীতি দিয়ে দেশ কে আক্ষরিক অর্থে বিদেশি মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার পথ দেখিয়েছিলেন।
তাঁকে ভারতবর্ষের একজন আধুনিক ঋষি বললে অত্যুক্তি হবে না।
আজ , ভারতবর্ষে রাষ্ট্র-পরিচালনায় যে সাংস্কৃতিক উত্থান দেখা যাচ্ছে তার পেছনে 'জনসঙ্ঘ' এর এক সফল রাজনীতিক পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় এর যোগদান অনস্বীকার্য।
পন্ডিত দীনদয়াল এর জীবন ছিল , তাঁর দ্বারা প্রচারিত তত্ত্বের জীবন্ত স্বরূপ।
মতাদর্শে অবিচল থেকে যে এক সফল রাজনৈতিক জীবন গড়ে তোলা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পন্ডিত দীনদয়াল।
ভারতবর্ষ কে পরমবৈভবশালী করতে , পুনরায় বিশ্বগুরুর আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে , আমাদের ভারত-আত্মা কে , তার নিজস্ব পদ্ধতিকে জানতে হবে।
পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় ২৫ শে সেপ্টেম্বর , ১৯১৬ সালে নিজ মাতুলালয় রাজস্থানের ধনকিয়ায় জন্মগ্ৰহণ করেন।
বাবা ছিলেন ভগবতী প্রসাদ ও মা ছিলেন রামপ্যায়ারী।
তাঁর পিতা রেলের স্টেশন-মাস্টার ছিলেন।
তাঁর ভাইয়ের নাম ছিল শিবদয়াল।
আড়াই বছর বয়সে তাঁর পিতা মারা যান এবং ৮ বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন।
তাঁর ভাই শিবদয়াল নিউমোনিয়া তে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।ফলে দীনদয়াল ১৪ বছর বয়সে অনাথ হয়ে যান।ছোটোবেলা থেকেই তিনি পড়াশোনা তে আগ্ৰহী ছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়াশোনা তিনি রাজস্থানেই করেছিলেন , পরে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করবার জন্য কানপুরের সনাতন কলেজে ভর্তি হন। তিনি বহু পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন , পুরস্কৃত হয়েছিলেন এবং ছাত্র বৃত্তিও পান। প্রশাসনিক সেবা পরীক্ষায় সফল হবার পরেও তিনি
চাকরিতে যোগ দেন নি।
পিতা-মাতা , ভাই বোন সহ আত্মীয় পরিজনদের অকাল প্রয়াণ , দীনদয়াল জী কে ভাঙ্গতে পারে নি। তাঁর অনাসক্ত বৈরাগী মন সমাজ সেবার মধ্যে নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছিল।
১৯৩৭ সালে তাঁকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে পরিচয় করান , মাননীয় ভাউরাওজী দেওরস। মাননীয় বাপুরাও মোঘে , ভাইয়াজী সহস্রবুদ্ধে , নানাজী দেশমুখ ,বাপু যোশী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তখন উত্তরপ্রদেশের সঙ্ঘের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৪১ সালে তিনি B.T ডিগ্ৰী নেন। যিনি ভবিষ্যতে সর্বব্যাপক জীবন-দর্শন শিক্ষা দিবেন স্বদেশ ও বিশ্ব কে , তিনি নিতে গেলেন শিক্ষকের ট্রেনিং!
১৯৪২ সালে পন্ডিত জী উত্তরপ্রদেশের লখীমপুর জেলায় প্রচারক জীবন আরম্ভ করেন।
১৯৪৭ সালে , তিনি প্রান্ত-প্রচারক থাকার সময় সাপ্তাহিক 'পাঞ্চজন্য' ও 'দৈনিক স্বদেশ' এই দুটি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর ; যখন স্বাধীনতা আন্দোলনের মঞ্চ 'ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস' , মহাত্মা গান্ধীর পরামর্শ উপেক্ষা করে একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হলো এবং একটি কাল্পনিক মিশ্র-সংস্কৃতির তত্ত্বে দেশ-পরিচালনা শুরু করলো , তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে এলো স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা যে সংস্কৃতি হাজারো বৈদেশিক আক্রমণ সত্ত্বেও ভারতবর্ষ কে বাঁচিয়ে রেখেছে , তাকে পুনরুজ্জীবিত করবে কে ?
তখন সারা বিশ্বে সমাজবাদ মতাদর্শের স্রোতধারা।
সোভিয়েত রাশিয়ার উত্থান কে চিরস্থায়ী ভেবে কংগ্ৰেস ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যখন সমাজবাদ কেই নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বেছে নিয়েছে , তখন সেই প্রতিকূল পরিবেশে 'জনসঙ্ঘ' এর মাধ্যমে , শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় সনাতন ভারতীয় দর্শন কে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের পথ দেখালেন।
তিনিই সেই সময় সমাজবাদের সামনে বিচার , বিশ্লেষণের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ রেখেছিলেন।
বিপক্ষের নেতারা জনসঙ্ঘ কে পুঁজিবাদী বলে অপপ্রচার করেছিলো। কিন্তু সমাজবাদ ও পুঁজিবাদ ছাড়াও যে একটি পথ হতে পারে ; যা ভারতবর্ষের নিজস্ব , এমন ধারণা তখন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছিলই না। আসলে দীনদয়াল জী যেমন ছিলেন সমাজবাদ বিরোধী , তেমনি ছিলেন পুঁজিবাদ বিরোধী। তাঁর কাছে সমাজবাদ ও পুঁজিবাদ একই মুদ্রার দুই পিঠ ছিল।সমাজবাদের ধারণায় ব্যক্তি সমাজের শত্রু আর পুঁজিবাদ এর ধারণায় সমাজ হয় ব্যক্তির শত্রু।দীনদয়াল জী এই দুটি কেই বিদেশী ও সাম্রাজ্যবাদের দুটি দিক রূপে দেখতেন। তিনি জাতীয় জীবন দর্শনের শূন্যস্থান পূরণ করতে ভারতীয় মতবাদের পরম্পরা কে 'একাত্ম মানববাদ' দর্শনের মধ্যে পুনরুজ্জীবিত করতে চেষ্টা করলেন।
' ভারতীয় জনসঙ্ঘ' এর রাজনৈতিক আদর্শ কি হবে ? এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পন্ডিত জী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক পরম পূজনীয় শ্রী মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার এর নিকটে পথনির্দেশ চাইতে গেলে ; শ্রী গুরু জী পন্ডিত জী কে এর উত্তর খোঁজার যোগ্যতম উল্লেখ করেন।
শ্রী গুরুজী বলতেন
"*অনেকে আমাদের জিজ্ঞাসা করে ,আপনাদের 'ইজম' কি ? বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রশ্নকর্তারা ইউরোপীয় পদ্ধতিতে চিন্তা করার ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে এবং ইউরোপীয় 'ইজম্' ছাড়া অন্য কোনো ধরনের চিন্তা করতে তারা অক্ষম। তারা ভাবতেই পারেনা যে আমাদেরও নিজস্ব চিন্তা-পদ্ধতি আছে ,আমাদের একান্ত আপন সুদৃঢ় এক ভিত্তি আছে যার উপরে আমরা এক আদর্শ রাষ্ট্রীয় জীবন নির্মাণ করতে পারি।*
ভারতীয় জনসঙ্ঘ পন্ডিত দীনদয়াল এর নেতৃত্বে , শ্রী গুরুজীর দেখানো পথেই পা বাড়ালো।
১৯৫২ সালে কানপুর অধিবেশনে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ভারতীয় জনসংঘের সর্বভারতীয় সম্পাদকের দায়িত্ব তুলে দেন।
ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যুর পরে জনসঙ্ঘের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দীনদয়াল জীর উপর এসে পড়ে। তাঁর নেতৃত্বেই ' ভারতীয় জনসঙ্ঘ' এক শক্তিশালী দল রূপে আত্মপ্রকাশ করে।