15/08/2025
১৪ আগস্ট ১৯৪৭ 💔💔 দেশ দু টুকরো হয়ে গেলো।
***********************************************
আজ "দেশভাগ দিবস'। ভারত ভাঙলো। একটা বাংলা হলো দু টুকরো - পশ্চিম বঙ্গ আর পূর্ব পাকিস্তান। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারটা যেদিন ভেঙেছিল, পাশের পাড়ার নতুন বাড়িতে আমরা উঠে এলাম, সেদিন সারারাত বাবা ঘুমোননি, দুটো হাতের মধ্যে থুতনি রেখে নিশ্চল পাথরের মতো বসেছিলেন দক্ষিণের বারান্দায়।
‘দেশভাগ দিবস’ কথাটা প্রথম শুনেছি আমার ছোটোবেলায়, বাবার মুখে। এখন তো ফিরে ফিরে প্রতিবছরই আসে। সেদিন উৎসবের আমেজ, পরের দিন ভারত স্বাধীন হবে। আনন্দ মুখরতায় মগ্ন সকলে। স্বাধীনতা কী, তা এমন কী জিনিস আলাদা করে বোঝার বয়েস তখনও আমার হয়নি। বাবা সকলকে ডেকে বলেছিলেন 'আনন্দ করছিস, কর। কিন্তু ভুলে যাসনি আজ 'দেশভাগ দিবস।' সেই প্রথম শুনেছিলাম "দেশভাগ", সেদিন বুঝিনি, আজ মর্মে মর্মে বুঝি, বোধে ব্যথায় বুঝি, শিরায় শোণিতে বুঝি। এখন ১৪ আগস্ট আসে যায়, আমরা কিন্তু সাতচল্লিশের স্মৃতি ভুলেই থাকি। এ শতাব্দীর মানব ইতিহাসে এতবড়ো বিভাজন ও বিয়োগান্ত ঘটনা আর দ্বিতীয়টি ঘটেনি। ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্য, ধর্মের অনাবৃত অহংকার, রাজনীতিকদের ধৈর্যহীন ক্ষমতার লোভ গোটা দেশের মাথায় অমানবিক এক ভয়ংকর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে গেলো। বাংলা ও পাঞ্জাব-এর বুকে ছুরিকাঘাতে তিন টুকরো হলো ভারতবর্ষের মানচিত্র । দেশের একদিকে যখন আনন্দ আর আতসবাজি, অন্যদিকে তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ ট্রেনে বাসে, পায়ে হেঁটে , নদী সাঁতরে, মাঠ ডিঙিয়ে, বাড়িঘর, ক্ষেত খামার , ভালোবাসার উঠোন ছেড়ে ঊর্ধশ্বাসে ছুটছে আর এক অজানা অপরিচিত ভূমিখণ্ডের উদ্দেশ্যে নতুন করে বাঁচবার আশায়। তাদের কাছে 'স্বাধীনতা' নয়, 'দেশভাগ'ই সাতচল্লিশের একমাত্র পরিচয়। একদিকে ফেলে আসা গ্ৰামের মসজিদে আজানের শেষ ধ্বনি আর অন্যদিকে হারিয়ে যাওয়া ভিটেমাটিতে লক্ষ্মীর পটের সামনে মঙ্গল শঙ্খের শেষ ফুঁ, দীর্ঘশ্বাসের মতো তাদের বুকে বেঁচে রইলো। ১৪ই সকাল থেকে এ-বাংলার মাঠ ঘাট, আম বাগান, জাম বাগান, স্টেশন প্ল্যাটফর্ম সুখহীন, আশাহীন, বাস্তুহীন উচ্ছিন্ন মানুষের হৈচৈ আর হাহাকারে ভরে উঠলো।
* ২ *
১৯২৫-২৬ , ••• তারপর থেকেই তলেতলে ধর্ম নিয়ে অশোভন দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে গেছে , সাগর থেকে পাহাড় পর্যন্ত ছড়ানো এত বড়ো দেশের এত বৈচিত্র্য এত বিস্ময় থেকে ধর্মটাকে আলাদা করে নিয়ে কিছু উন্মাদ মৌলবাদীর হট্টগোল এবং বিভেদের বিনিময়ে ক্ষমতা সংহত করার কৌশলে বিদেশি শাসকেরা 'দ্বিজাতিতত্ত্বে'র খেলা শুরু করে দিলো। সাভারকার প্রমুখদের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা আর মহম্মদ আলি জিন্নাহ'র নেতৃত্বে মুসলিম লীগের চিন্তা এবং দাবি ছিল প্রায় একই রকমের ‘one religion, one culture, one language, one nation'
১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার বার্ষিক সভায় সভাপতির ভাষণে সাভারকার খোলাখুলি বলে দিলেন ভারতবর্ষ ঐক্যবদ্ধ দেশ নয়, এর মধ্যে দুটো আলাদা আলাদা দেশ রয়েছে " there are two nations in the main; the Hindus and the Moslems, in India.”
১৯৪০ সালের মার্চে মুসলিম লীগও লাহোর সম্মেলনে ফজলুল হকের প্রস্তাব অনুসারে 'পাকিস্তান প্রস্তাব' অর্থাৎ মুসলমানদের জন্যে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি (Separate Homeland ) পাশ করিয়ে নিলো ।
বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তো আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। ১৯৪৬-এর ফেব্রুয়ারিতেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভার বঙ্গীয় শাখা হিন্দু বাঙালির জন্যে স্বতন্ত্র হিন্দু রাজ্য গঠনের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি তৈরি করে ফেলে। এই কমিটিরই ৪-৬ এপ্রিল একটি বিশেষ সমাবেশ হলো তারকেশ্বরে। সভায় বলা হলো ১৯০৫-এ কার্জনের কুখ্যাত 'বঙ্গভঙ্গ' নাকি সঠিক ছিল। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছিল ভাঙা বাংলাকে জোড়ার জন্যে তা ছিল অসঙ্গত, ভুল পদক্ষেপ। ঢাকার নবাব,সলিমুল্লাহ তো একই কথা বলেছিলেন। ধর্ম নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িকদের বলার কথা, আর গলার আওয়াজ একই রকম হয়। শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ভাষণে বললেন দেশভাগ না হলেও হিন্দুদের স্বার্থে বাংলা ভাগ হোক, "On 5 April, Syama Prasad, in his speech at the Bengal Hindu Conference at Tarakeshwar, suggested the partition of Bengal as the only solution..."। ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে তথ্য ও বিশ্লেষণে প্রমাণ করেছেন, বাংলায় দেশভাগের কলরব হিন্দু মহাসভারই তৈরি, তাঁর মতে "the partition of Bengal was demanded for the first time by the Bengal Provincial Hindu Mahasabha"
এরপর অবস্থা প্রায় প্রতিদিনই পাল্টাতে লাগলো মুসলিম লীগের "Direct Action"-এর ডাক ছিল এক সর্বনেশে পদক্ষেপ। উন্মত্ত সাম্প্রদায়িকদের মারামারি কাটাকাটিতে কলকাতা এবং নোয়াখালি রক্তাপ্লুত হলো। আইন শৃঙ্খলা বলতে কিছু রইলো না, পাঞ্জাবের অবস্থাও একই রকম। গান্ধিজি তো আগেই বলেছেন দেশভাগ হলে তা হবে তাঁর মৃতদেহের ওপর। এদিকে, হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক কামড়াকামড়িতে মজা লুটছে ব্রিটিশ রাজশক্তি, এপক্ষ ওপক্ষকে তাদের অযৌক্তিক প্রশ্রয় দান ও প্রশাসনিক শিথিলতায় দেশে দাঙ্গা ও মৃত্যুর প্রবাহ বেড়েই চলেছে। ঐতিহাসিক বিবেচনায় মত্যুর সংখ্যা "estimates of the loss of life accompanying or preceding the partition...... varying between several hundred thousand and two million." পাহাড়ের মতো উঁচু হয় উঠলো শবের স্তূপ। এ ভয়াবহতার তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার।
ইতিহাসের এই বাঁকে, '৪৬-এ জুনের ২ তারিখে "মাউন্টব্যাটন মিশন"-এর পূর্ণ সমীক্ষা ও বিচার বিশ্লেষণের জন্যে বড়োলাটের সঙ্গে এক টেবিলে আলোচনায় বসলেন কংগ্রেসের জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল এবং আচার্য কৃপালিনি ; মুসলিম লীগের পক্ষে মহম্মদ আলি জিন্না, আবদুর রব নিশতার এবং লিয়াকত্ আলি খান আর শিখ সম্প্রদায়ের পক্ষে বলদেব সিং। ভাবতে অবাক লাগে, কোটি কোটি মানুষের এই দেশ, বিচিত্র ও বিস্ময়কর সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বাসভূমির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন ৭ জন ক্ষমতাকাঙ্খী রাজনীতিক।
৩ জুন ১৯৪৭ , ভারত ইতিহাসের কলঙ্কিত দিন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রধান মন্ত্রী এ্যটলি'র '3rd June Plan' ঘোষণা।পরিকল্পনা হলো, ভারত হবে দ্বিখন্ডিত, পাঞ্জাব এবং বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ ঘটবে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বল্লভভাই প্যাটেলের জোরাজুরিতে দুঃখজনক সিদ্ধান্ত নিল যার নির্যাস:" Freedom is coming. We have 75 to 80 percent of India, which we can make strong with our genius."
অজ্ঞাত কারণে গান্ধিজি ওয়ার্কিং কমিটিতে হাজির হলেন না, খান আবদুল গফফার খাঁ বললেন নেকড়েদের মুখে আমাদের ছুঁড়ে দিলেন। মৌলানা আজাদ হতাশ হলেন।
রাজনীতিকদের সম্মতিতে ইংলন্ড থেকে উড়ে এলেন বিচারপতি স্যার সিরিল র্্যাডক্লিফ, একহাতে জনগণনার রিপোর্ট আর অন্যহাতে লাল পেনসিল নিয়ে। লাল দাগ টেনে টুকরো করে দিয় গেলেন ভারতকে। শতাব্দীর শ্রমে ও সাধনায় ভারতভূমির যে সভ্যতা ও ঐক্য গড়ে উঠেছিল তার বুকে ধর্মীয় রাজনীতির ছুরিকাঘাত দেশকে রক্তাক্ত ও খণ্ডিত করে দিয়ে গেলো। কোনো গণভোট নয়, আম জনতার কন্ঠস্বর ও প্রত্যাশার প্রতিফলন নয়, কয়েকজন ভারতীয় ও ব্রিটিশ রাজপুরুষের ইচ্ছায় দেশভাগ অনিবার্য হয়ে গেলো।
* ৩ *
গান্ধিজি স্বাধীনতার আনন্দ-উৎসবে থাকেননি। '৪৭-এর ১৫ই আগস্ট, বেলেঘাটায় তিনি মৌন অবলম্বনে অনশনে বসেছিলেন। দিনের শেষে উপবাস ভাঙলে , সন্ধ্যায় তাঁর বিচলিত উক্তি : "দুশো বছরের গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের কী অগৌরবজনক পরিণতি!"
দেশভাগ আর ভাঙা ঘরের কান্না নিয়ে কত গান, গল্প, উপন্যাস লেখা হলো, আজও হচ্ছে। তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র, সিরিয়াল। ঝত্বিক, তাঁর সারাটা জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন ক্ষতচিহ্ন লাঞ্ছিত, বিষাদমগ্ন বাংলার দিনযাপনের করুণ কাহিনি স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখতে। এ সবই বিবেক বুদ্ধিহীন, মনুষ্যত্বহীন অনাচারের দলিল হয়ে আছে এবং থাকবেও ভাবী কালের জিম্মায়। ইতিহাসের পাতাও ভরে আছে মর্মান্তিক মূঢ়তার বাস্তব বিবরণে।
*৪*
স্বাধীনতার ৭৮ বছরে 'মহোৎসব' উদযাপনের আয়োজনে অনেক নেতাই, স্বাধীনতা আন্দোলনে যাদের পূর্বসূরীদের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক, গণ-ঐক্য বিরোধী ও ব্রিটিশ শাসক তোষণের অনুকূলে, তাঁরা আজ 'দেশভাগ'-এর নামে নতুন করে ধর্মীয় বিভাজনের সর্বনেশে খেলায় যাতে গোটা দেশকে টেনে না নামায় তা দেখার ও বোঝার দায়িত্ব জনগণের।
ইতিহাস আমরা ভুলিনি, যদিও ইতিহাসের অঙ্গহানি ঘটিয়ে বিকৃত করার নতুন অধ্যায় এখন শুরু হয়েছে। কী থাকবে, কতটুকু থাকবে আর কতটুকুই বা মুছে ফেলা হবে জানি না। শুধু এটুকু বিশ্বাস করি, অশ্রুধারা ও রক্তস্রোতে লেখা ইতিহাসের অক্ষর ঝাপসা হয়না কোনো দিনও। দাঙ্গা ও দেশভাগ ঐতিহাসিক ঘটনা, ইতিহাসের প্রেক্ষিতেই, ঘটনার যথাযথ বাস্তব ও সঠিক তথ্যের নিরিখে মুক্ত মনে বিচার করতে হবে, শাসকেরা যা চাইছেন সেই ধর্মীয় আবেগ ও অসংযত, অন্যায় অপপ্রচারের বেলাগাম ঘূর্ণিপ্রবাহে নয়। এই ঘটনা আর কোনও দিন ঘটবে না, ঘটতে দেওয়া হবে না, এই হোক আজকের অঙ্গীকার।